একনায়কতন্ত্র একটি প্রচলিত প্রাচীন মতবাদ
একনায়কতন্ত্র একটি প্রচলিত প্রাচীন মতবাদ। প্রাচীনকালে যতগুলো মতবাদ প্রচলিত ছিল তারমধ্যে একনায়কতন্ত্র অন্যতম। বলতে গেলে এটি সম্পূর্ণ গণতন্ত্রের বিপরীতধর্মী শাসনব্যবস্থা। তৎকালীন গ্রিসেও স্বৈরতান্ত্রিক ব্যবস্থা বিদ্যমান ছিল এবং ক্ষমতা প্রায়ই একজনের কর্তৃত্বে ব্যবহৃত হতো।
এ শাসন ব্যবস্থা মূলত স্বেচ্ছাচারমূলক
একনায়কতন্ত্র এমন এক শাসনব্যবস্থা যাতে রাষ্ট্রের সার্বভৌম ক্ষমতা একজন ব্যক্তির হাতে ন্যস্ত থাকে। সামাজিকভাবে এটিকে নিকৃষ্ট শাসনব্যবস্থা হিসাবে দেখা হয়। এই শাসন ব্যবস্থায় আইনসভার কোন অস্তিত্ব নাই বলে শাসকরা নিজের খেয়াল খুশীমতো দেশ চালায়। এ শাসন ব্যবস্থা মূলত স্বেচ্ছাচারমূলক। প্রায় ক্ষেত্রে মানবাধিকার লঙ্ঘিত হতে দেখা যায়।
প্রাচীন গ্রীসে নগররাষ্ট্র কেন্দ্রীক রাজ্য দেখা যেত। এর শাসন কাজ করতেন নগরের গণ্যমান্য ব্যক্তিরা। তারা অধিকাংশ ক্ষেত্রে ইচ্ছামাফিক শাসন করতেন। গণতন্ত্র সে যুগে সেভাবে দৃশ্যমান ছিল না। শাসকদের মনোভাব ছিল অনেকটাই স্বৈরাচারী যাকে স্বৈরাচারতন্ত্র বলা হয়। এটি আসলে একনায়কতন্ত্রের একটি রূপ। এটি সে যুগে বহুল প্রচলিত বলে এরিস্টটল একে স্বাভাবিক সরকারের অন্তর্ভুক্ত করেন বলে মনে করা হয়।
একনায়কতন্ত্রের অর্থ ও সংজ্ঞা
গণতন্ত্রের ন্যায় একনায়কতন্ত্রের উৎপত্তিও প্রাচীন গ্রিস ও রোমে। কিন্তু আধুনিক একনায়কতন্ত্রের বিকাশ ঘটে প্রথম ও দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের মধ্যবর্তী সময়ে। বিশ্বযুদ্ধের প্রেক্ষাপটে মানুষের মনে গণতন্ত্রের বিরুদ্ধে তীব্র ক্ষোভ গড়ে উঠে। ফলে এ সময়ে জার্মানি ও ইতালিসহ কয়েকটি দেশে একনায়কতন্ত্রের পুনর্জন্ম হয় এবং একনায়করা যুদ্ধপরবর্তী দুর্দশা কাটিয়ে উঠার প্রতিশ্রুতি দেয়।
১৯২২ সালে ইতালির নেতা মুসোলিনীর নেতৃত্বে ফ্যাসিবাদী নামে একটি দলের উত্থান ঘটে। ১৯৩৩ সালে জার্মান রাষ্ট্রনায়ক হিটলারের নেতৃত্বে গড়ে উঠে নাৎসিজম নামে আরেকটি দল। এই দুই মতবাদই একনায়কতন্ত্রকে সমর্থন করে। একনায়কতন্ত্রের মূল ভিত্তি হলো সামরিক শক্তি তাই এ ধরনের সরকার সবসময় যুদ্ধকে প্রশ্রয় দেয়।
বর্তমানে গণতান্ত্রিক বিশ্বেও বিভিন্ন নামে ও ছদ্মবেশে অনেক রাষ্ট্রে স্বৈরাচার ও ফ্যাসিবাদের মতো একনায়কতন্ত্র চালু আছে। ক্ষমতা দখল, ক্ষমতা কুক্ষিগতকরণ, একচ্ছত্র আধিপত্য বিস্তার, বিরোধী মত ও পথকে রুদ্ধকরণ, সামরিকীকরণ প্রভৃতি একনায়কতন্ত্রের মূল ভিত্তি। প্রাচীনকালে কোনো কোনো দেশে স্বৈরাচারি রাজতন্ত্রকে একনায়কতন্ত্র বলে মনে করা হত।
একনায়কতন্ত্রের সংজ্ঞা
এক. আধুনিক রাষ্ট্রবিজ্ঞানী লর্ড ব্রাইস এর মতে, যে শাসনব্যবস্থায় সরকারের সকল ক্ষমতা কোনো একজন ব্যক্তি বা ব্যক্তিসমষ্টির হাতে কেন্দ্রীভূত হয় তাকে একনায়কতন্ত্র বলে।
দুই . গ্রিক রাষ্ট্রবিজ্ঞানী এরিস্টটল এর মতে, যখন রাষ্ট্রের শাসন ক্ষমতা একজনের হাতে ন্যস্ত থাকে এবং সে যদি নিজের স্বার্থের জন্য শাসন করে তখন তাকে একনায়কতন্ত্র বলা হয়।
তিন . রজার ইসক্রুটন বলেন, একনায়কতন্ত্র এমন এক শাসনব্যবস্থা যেখানে একজন ব্যক্তি বা একটি গোষ্ঠী বা দল সকল রাজনৈতিক কার্যক্রম পরিচালনা ও সকল জনসাধারণের নিকট থেকে আনুগত্য আদায় করে।
চার . অস্টিন রেনি এর ভাষায়, একনায়কতন্ত্র হচ্ছে এমন এক শাসনব্যবস্থা, যেখানে প্রশাসনিক চূড়ান্ত ক্ষমতা কেন্দ্রীভূত হয় একজন ব্যক্তি বা বাছাই করা কয়েকজনের হাতে।
পাঁচ . ইতালীর ফ্যাসিস্ট একনায়ক মুসোলিনি‘র মতে, একনায়কতন্ত্র হচ্ছে ঐ শাসনব্যবস্থা যেখানে সকল কিছু রাষ্ট্রের স্বার্থে করা হয়। কোনো কিছুই রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে নয়, আর রাষ্ট্রের বাইরেও কোনো কিছু নয়।
সুতরাং বলা যায়, একনায়কতন্ত্র হচ্ছে এমন এক শাসনব্যবস্থা যাতে সরকার গঠন, পরিচালনা ও নিয়ন্ত্রণে একজন বিশেষ ব্যক্তি, একটি গোষ্ঠী বা শ্রেণীর ব্যাপক ক্ষমতা বিদ্যমান। ঐ ব্যক্তি বা ব্যক্তিবর্গ ইচ্ছামত রাজনৈতিক ক্ষমতা দখল, ভোগ ও প্রয়োগ করে।
একনায়কতন্ত্রের প্রকারভেদ
প্রকৃত বিচারে একনায়কতন্ত্রকে তিনটি ভাগে ভাগ করা যায়। যেমন-
এক. ব্যক্তিগত একনায়কতন্ত্র : দেশের যাবতীয় ক্ষমতা একজন ব্যক্তি বা সামরিক নেতার হাতে ন্যস্ত থাকে। সাধারণত সাংবিধানিক সরকারকে উচ্ছেদ করে বা হটিয়ে ক্ষমতা দখল করে একনায়কতন্ত্র কায়েম করা হয়। কখনো কখনো সেনাবাহিনীর সহায়তায় শাসন ক্ষমতা দখল করে সামরিক প্রধান শাসন ক্ষমতা দখল করেন। যেমন- উত্তর কোরিয়া।
দুই . দলগত একনায়কতন্ত্র : একটি মাত্র রাজনৈতিক দল রাষ্ট্রের সর্বময় ক্ষমতা করায়ত্ব করে থাকে। এ ব্যবস্থায় একটি দল ছাড়া অন্য কোনো দলের অস্তিত্ব স্বীকার করা হয় না। যেমন, হিটলারের নাৎসি দল এবং মুসোলিনীর ফ্যাসিস্ট দলের কথা বলা যায়।
তিন . শ্রেণীগত একনায়কতন্ত্র : এটা এমন এক ধরণের শাসনব্যবস্থা যেখানে একটি বিশেষ শ্রেণীর স্বার্থ সংরক্ষণে রাষ্ট্র পরিচালিত হয়। এ ধরণের একনায়কতন্ত্রে রাষ্ট্র সংশ্লিষ্ট শ্রেণীর স্বার্থ সংরক্ষণের হাতিয়ার হিসাবে কাজ করে। এ ব্যবস্থায় শ্রেণী শোষণ ও শাসন স্বীকৃত হয়। পুঁজিবাদী ধনিক শ্রেণীর নেতৃত্বে এবং সমাজতান্ত্রিক সর্বহারা শ্রেণীর নেতৃত্বে এ ধরনের একনায়কতন্ত্র প্রতিষ্ঠিত হয়।
একনায়কতন্ত্রের আবির্ভাব
প্রজাতন্ত্রী রোমে একনায়কতন্ত্র ছিল সংবিধানসম্মত সামরিক সংকটকালীন শাসনব্যবস্থা মাত্র। বহিরাক্রমণ, গৃহবিবাদ ইত্যাদি কারনে কোন এক ব্যক্তির হাতে ক্ষমতা ন্যস্ত করার ব্যবস্থা ছিল। সংকটাবস্থার অবসানের সাথে সাথেই কিন্তু একনায়কতন্ত্রের অবসান হয়ে যেত। সাধারণ শাসনব্যবস্থা পুনঃপ্রবর্তন করা হত।
শাসনতান্ত্রিক অস্থায়িত্ব, অর্থনৈতিক সংকট, অন্তর্বিপ্লব বা অন্যান্য অসাধারণ অবস্থাতেই সাধারণত একনায়কতন্ত্রের আবির্ভাব হয়। যে সকল রাষ্ট্রে নিয়মতান্ত্রিক ঐতিহ্য সুপ্রতিষ্ঠিত নয় সেখানে একনায়কতন্ত্রের অভ্যুত্থান অপেক্ষাকৃত সহজ। যুদ্ধোত্তর সামাজিক, রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক বিশৃঙ্খলার ফলে ইতালি ও জার্মানিতে একনায়কতন্ত্র প্রতিষ্ঠিত হয়।
গণতন্ত্র ন্যায় ও সাম্যের নীতি প্রয়োগ করতে ব্যর্থ হয়। গণতন্ত্রের এই দুর্বলতা প্রকট হয়ে দাড়ায় প্রথম বিশ্বযুদ্ধোত্তর যুগে। যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশগুলিতে ব্যাপক বিশৃঙ্খলা দেখা দেয়। গণতান্ত্রিক ও সমাজবাদী গণতান্ত্রিক দলসমূহের নেতাদের ব্যর্থতার সুযোগ গ্রহণ করে ১৯২২ সালে ইতালিতে মুসোলিনি এবং ১৯৩৩ সালে জার্মানিতে হিটলার নিয়মতন্ত্রের সকল চিহ্ন মুছে ফেলেন।
একনায়করা সাধারণত সামরিক বলপ্রয়োগ কিংবা ভীতিপ্রদর্শনের দ্বারা ক্ষমতা হস্তগত করে। পরবর্তীতে নতুন নিয়মের মাধ্যমে নিজেকে আইনের মর্যাদা দেয়ার চেষ্টা করে। প্রতিদ্বন্দিতাহীন অন্যায় নির্বাচনের জন্য একটি সংবিধান অনুমোদন করে নেয়। আপাতদৃষ্টিতে একজন বা মুষ্টিমেয় কয়েকজন শাসককে দেখা গেলেও পশ্চাতে থাকে শ্রেণী বা গোষ্ঠী বিশেষের সমর্থন।
একনায়কতন্ত্রের কতিপয় ত্রুটি
এ ব্যবস্থায় কারো কাছে জবাবদিহিতা বা আলোচনা করতে হয় না বলে দ্রুত সিদ্ধান্ত নেয়া ও কাজ করা তার পক্ষে সম্ভব হয়। একইভাবে পরিচালিত হয় বলে অর্থনৈতিক ও সামাজিক উন্নতি এবং জাতীয় ঐক্য ও সংহতি দৃঢ় হয়। তবে একনায়কতন্ত্রে ব্যক্তিস্বাধীনতা থাকে না। বিভিন্ন মতবাদ জোরপূর্বক দমন করা হয়। উগ্র জাতীয়তাবাদ ও সামরিক শক্তির বিকাশ ঘটে। এটা অস্থায়ী এক শাসনব্যবস্থা। একনায়কের মৃত্যুর সাথে সাথে এ শাসনও শেষ হয়ে যায়।
১. স্বৈরতান্ত্রিকতা : একনায়কতন্ত্র মূলত একটি স্বৈরতান্ত্রিক ব্যবস্থা। সকল ক্ষমতা একজনের হাতে ন্যস্ত থাকে। কোন জবাবদিহি করতে হয় না। একনায়ক সংবিধান ও আইনের ঊর্ধ্বে উঠে নিজের ইচ্ছামত ক্ষমতা প্রয়োগ করে থাকেন।
২. ব্যক্তিস্বাধীনতার পরিপন্থী : ব্যক্তির ব্যক্তিত্ব, প্রতিভা ও জীবনের বিকাশ বাধাগ্রস্ত হয়। অর্থাৎ ব্যক্তিসত্তার অপমৃত্যু ঘটে।
৩. রাজনৈতিক শিক্ষা ও সচেতনতার অভাব : এখানে দলীয় সদস্যদেরও নিজস্ব মতামত প্রদানেরও সুযোগ নাই। তারা শুধু একনায়কের ইচ্ছা প্রচার করে মাত্র। বিরোধী দলের অস্তিত্বকে স্বীকার করা হয় না বিধায় রাজনৈতিক চিন্তার উন্মেষও ঘটে না।
৪. দায়িত্বহীনতা : দায়িত্বহীনতা একনায়কতন্ত্রের একটি বিশেষ ত্রুটি। একনায়ক তার নিজের কাজের জন্য জনগণের নিকট জবাবদিহি করতে হয় না।
৫. স্বায়ত্বশাসনের অনুপস্থিতি : স্থানীয় প্রতিষ্ঠানগুলোর স্বায়ত্বশাসন উপেক্ষিত হওয়ায় এ ব্যবস্থায় জনসাধারণ দেশ সম্পর্কে উদাসীন থাকে।
এ ছাড়া আইনের শাসনের উপেক্ষা, প্রহসনমূলক আইনসভা, সাম্য বিরোধিতা, বিপ্লবের আশঙ্কা, বল প্রয়োগ, সরকারি অর্থের অপচয়, শাসক ও শাসিতের সম্পর্কের অবনতি, অধিকার ও ন্যায় খর্ব, অস্থিতিশীলতা, উগ্র জাতীয়তাবাদ এবং সাহিত্য-সংস্কৃতির বিরোধি হিসাবে এ সরকার আত্মপ্রকাশ করে। এ সব কারনে বর্তমান শতাব্দীর সর্বাপেক্ষা বড় অভিশাপ বলেই গ্রহণ করা সমীচীন।
অর্ডিনারি আইটির নীতিমালা মেনে কমেন্ট করুন। প্রতিটি কমেন্ট রিভিউ করা হয়।
comment url