তারিক বিন জিয়াদ ইউরোপ বিজয়ী প্রথম মুসলিম বীর
সেনাপতি তারিক বিন জিয়াদ ইউরোপ বিজয়ী প্রথম মুসলিম বীর। স্পেনে মুসলিম শাসনের সূচনা করেছিলেন। তারিকের বাহিনী ৭১১ সালে স্পেনের সীমানায় অবতরণ করে। বর্তমানে যা জিব্রাল্টা নামে পরিচিত। আরবী ‘জাবাল আত তারিক’ থেকে উদ্ভব তারিকের পাহাড়।
স্পেন বিজয়ের ঐতিহাসিক ও অবিস্মরণীয় ঘটনা
ভৌগলিক অবস্থানের দিক থেকে স্পেন একটি গুরুত্বপূর্ণ স্থান। প্রাচীনকাল থেকে স্পেন আইবেরীয় উপদ্বীপ নামে পরিচিত। অপরূপ সুন্দর এই উপদ্বীপটি মুসলিম শাসনামলে আন্দালুস নামে পরিচিতি লাভ করে। এটি ইউরোপের দক্ষিণ-পশ্চিমে অবস্থিত। উত্তর ও পশ্চিমে আটলান্টিক মহাসাগর এবং দক্ষিনে ভূমধ্যসাগর। স্পেনের একটি বিশাল অংশ পীরেনীজ পর্বত দ্বারা গঠিত।
খোলাফায়ে রাশেদীনের শাসনামলের পর ৬৬১ সালে উত্থান ঘটে উমাইয়া বংশের। বিস্তৃতি ঘটে মুসলিম সাম্রাজ্যের। একের পর এক সামরিক অভিযানে আসতে থাকে যুগান্তকারী বিজয়। তাদের হাত ধরে মুসলিম শাসনের ভিত্তি আরও মজবুত হয়। স্পেন বিজয়ও ঐতিহাসিক ও অবিস্মরণীয় ঘটনা। যা ইউরোপের বুকে ইসলামের মশাল প্রজ্জলিত করে।
স্পেনে মুসলিম অভিযান
৬৯৮ সালে মুসা বিন নুসায়ের ইফরিকিয়ার (লিবিয়া ও আলজেরিয়া) গভর্নর হয়ে সমগ্র উত্তর আফ্রিকার উপকূলে মুসলিম শাসন প্রতিষ্ঠার জন্য বাইজানটাইন নৌবহরের বিপরীতে গড়ে তুললেন শক্তিশালী নৌবহর। হিস্প্যানিয়া জয় করার জন্য স্পেন থেকে আসা এক খৃস্টান তাকে উদ্বুদ্ধ করে। তিনি ছিলেন সিউটার শাসনকর্তা ও বিজিগথ রাজা রডেরিকের একজন সামন্ত রাজা জুলিয়ান।
জুলিয়ান মুসা বিন নুসায়েরকে হিস্প্যানিয়ায় থাকা সম্পদের পাহাড়ের বিবরণ দিলেন এবং বললেন রডেরিকের কারনে তাদের রাজ্যে চলা অরাজকতার কাহিনী। মুসা বিন নুসায়ের তার সেরা সেনাপতি তারিক বিন জিয়াদকে হিস্প্যানিয়া জয় করতে পাঠালেন। তারিক নিজেই ছিলেন মুসা বিন নুসায়েরের একজন দাস। পরবর্তীতে তাকে মুক্ত করে বাহীনির প্রধান বানান।
৭১০ খৃস্টাব্দের দিকে স্পেনের ক্ষমতায় আসেন রডেরিক। রডেরিক ক্ষমতায় এলে সিউটার শাসনকর্তা জুলিয়ান প্রথানুযায়ী তাঁর কিশোরী কন্যাকে শিক্ষার্জনের জন্য রাজদরবারে পাঠান। কিন্তু রডেরিক জুলিয়ানের মেয়ে ফ্লোরিন্ডাকে ধর্ষণ করেন। প্রতিশোধের নেশায় জুলিয়ান হাত মেলান মুসলিমদের সঙ্গে। আমন্ত্রণ জানান তারিক বিন জিয়াদকে।
মুসলিমদের জিব্রাল্টা প্রণালী গোপনে পার করে দেয়ার ব্যাপারে জুলিয়ান তারিকের সঙ্গে চুক্তিবদ্ধ হন। তারিকের বাহিনী ৭১১ সালে জিব্রাল্টায় পৌঁছেই তারিক সব নৌযান পুড়িয়ে দেন। সৈন্য সংখ্যা সাত হাজার জন। রডেরিকের বিশাল সৈন্যবাহিনীকে মোকাবেলা করতে হবে শুনে তারিকের সৈন্যরা ভয় পেয়ে যায়।
অসীম সাহসী প্রেরণাদায়ী নেতা তারিক বিন জিয়াদ সৈন্যদের উদ্দেশে বলেন- ‘কোথায় তোমরা পালাবে? তোমাদের পেছনে সাগর, সামনে শত্রু, তোমরা বেঁচে থাকতে পারবে, যদি শত্রুর হাত থেকে নিজেদের জীবনকে ছিনিয়ে আনতে পার। এবং মনে রেখো এই যুদ্ধে আমিই সবার সামনে থাকব।’ তারিকের ভাষণ শুনে উজ্জীবিত সৈন্যরা রডেরিকের বাহীনির উপর ঝাপিয়ে পড়ল।
রডেরিকের বাহীনি তখন দ্বিধাবিভক্ত হয়ে পড়ে। তাছাড়া এই বাহীনি রডেরিকের অনুগতও নয়। এই সুযোগটাই কাজে লাগালো মুসলিমরা। তারিকের ৭ হাজার সৈন্যের সঙ্গে মুসা বিন নুসায়েরের পাঠানো আরো ৫ হাজার সৈন্য এসে যোগ দেয়। মোট ১২ হাজার সৈন্যের অসাধারণ রণকৌশলে ছত্রভঙ্গ হয়ে গেলো প্রায় লাখ সংখ্যার ভিজিগথ বাহীনি। যুদ্ধে নিহত হলো রডেরিক এবং প্রতিষ্ঠিত হল মুসলিম শাসন।
ইউরোপে নতুন সভ্যতার উন্মেষ
পরের বছরেই জিব্রাল্টার থেকে দক্ষিণ ফ্রান্স পর্যন্ত মুসলিমদের দখলে চলে আসে। মুসলিম শাসন সত্ত্বেও খৃস্টান আর ইহুদীরা স্বাধীনভাবে ধর্ম পালন করতে পারত। এর ফলে কয়েক বছরের মধ্যেই ব্যাপক পরিমান খৃস্টান ইসলাম গ্রহন করেছিল। ১০ম শতাব্দীর মধ্যেই আল-আন্দালুস পরিণত হলো ইউরোপ, আফ্রিকা আর মধ্যপ্রাচ্যের সফল রাষ্ট্র।
৭৫০ খৃস্টাব্দে উমাইয়া খিলাফতের পতনের পর মুসলিম বিশ্বে শুরু হয় আব্বাসীয় যুগ। গণহত্যার সময় উমাইয়া রাজপুত্র আবদ আল-রহমান পালিয়ে আন্দালুসে চলে আসেন। সেখানেই শুরু হয় তার নতুন রাজ্য শাসন এবং ঘোষণা করেন আন্দালুসকে স্বাধীন রাষ্ট্র হিসাবে। ৭৫৬ সালে নিজেকে আমির হিসাবে ঘোষণা করেন। ইউরোপের বুকে প্রতিষ্ঠিত হয় প্রথম মুসলিম রাষ্ট্র।
রোমানদের ইঞ্জিনিয়ারিং কৌশল আর ইসলামী স্থাপত্যকলা মিশিয়ে নতুন করে আন্দালুসকে গড়ে তোলা হল। কালের গর্ভে নষ্ট হয়ে যাওয়া মিশরীয় আর গ্রিক ডকুমেন্টগুলো বইয়ের আকারে পেতে শুরু করল। শহরে শহরে তৈরি করা হলো হাম্মামখানা, উম্মুক্ত করে দেয়া হর সকলের জন্য। নারীরা বিশেষ করে অভিজাতরা খৃস্টানদের তুলনায় অনেক বেশি স্বাধীনতা ভোগ করতো।
অন্যান্য ধর্মের লোকেরাও সমানভাবে নিজ নিজ ধর্ম পালনের সুযোগ পেত। তাদের উৎসব সহ সবকিছুই নিজেরাই নিয়ন্ত্রণ করতো। যদিও তাদেরকে নির্দিষ্ট পরিমানে জিজিয়া কর দিতে হত। খৃস্টানদেরকে ইসলামের দাওয়াতও দেয়া হত। এর ফলে অনেকে ধর্মান্তরিত হয়েছিল। কেউ কেউ ধর্মান্তরিত না হলেও ইসলামী সংস্কৃতিতে প্রভাবিত হয়েছিল।
মুহম্মদ ইবনু নাসর ও আল হামরা
স্পেনে মুসলিমদের শেষ রাজবংশ ছিল গ্রানাডার নসর বংশ। ১২৩৮ সালে মুহম্মদ ইবনু নাসর গ্রানাডা জয় করে দারু নদীর তীরে একটি প্রাসাদ নির্মাণের সূচনা করেন এবং নাম দেন আল হামরা। বলা হয়, ‘তাজমহল যদি হয় পৃথিবীর বুকে একটি গোলাপ, তবে আল হামরা হলো পৃথিবীর বুকে একটি গোলাপের বাগান।’ শত পান্নার মধ্যে মুক্তা যেমন জ্বলজ্বল করে, তেমনি শত সবুজের মাঝে স্পেনের বুকে আল হামরা প্রাসাদ উজ্জল হয়ে থাকে।
মুহম্মদ ইবনু নাসর বিজয়ী বেশে যখন গ্রানাডায় প্রবেশ করেন তখন তাঁকে স্বাগত জানিয়ে সমবেত জনতার উল্লাস ধ্বনি ছিল মারহাবান লি-ল নাসর অর্থাৎ ‘আল্লাহর কৃপায় বিজয়ীকে সুস্বাগত।’ তিনি বলেছিলেন, ‘লা গালিবা ইল্লাল্লাহ’ অর্থাৎ ‘অন্য কেউ বিজয়ী না, যদি না আল্লাহ চান।’ পরবর্তী সময়ে ‘লা গালিবা ইল্লাল্লাহ’ নাসর বংশের স্লোগান হয়ে যায়।
আল হামরার অলংকরণে এ বাক্যটি বিভিন্নভাবে ব্যবহার করা হয়েছে। দেয়ালে দেয়ালে স্বর্ণ ও পাথরে খোদাই করা আরবি ক্যালিওগ্রাফির অনুপম শিল্প নিদর্শন অত্যন্ত বিস্ময়কর ও দৃষ্টিনন্দন হয়ে ওঠে। কোরআন, হাদিস, কবিতা আর উপদেশ আল হামরার কক্ষ, খুটি, মিনার ইত্যাদিকে সুশোভিত করেছে। ২০ হাজার শ্রমিক প্রায় ৩৫ বছর পরিশ্রম করে এটি নির্মাণ করা হয়।
আল হামরা নির্মাণে ব্যবহৃত হয়েছে দামেস্ক, আরব, গ্রিস, রোম ও পারস্যের নানা নকশা ও স্থাপত্যকৌশল। আল হামরায় ব্যবহৃত হয়েছে- স্বর্ণ ১০০ মণ, রৌপ্য তিন হাজার মণ, মুক্তা ১৩ মণ এবং প্রচুর হিরা-পান্না ও জহরত। আল হামরার দৈর্ঘ ২৪৩০ ফুট, প্রস্থ ৬৭০ ফুট, স্তম্ভ ১২৮ টি, দরজা-জানালা ৭ হাজার। প্রাসাদটি প্রায় ১৫,৩০,০০০ বর্গ ফুট এলাকাজুড়ে বিস্তৃত।
স্পেনে মুসলিম শাসনের অবসান
স্পেনে মুসলিম শাসনে কর্ডোভা হয়ে ওঠে ইউরোপের সবচেয়ে মনোরম জনপদ। প্রায় ৫ হাজার মিল-কারখানা ছিল শুধু কর্ডোভাতেই। তখন ইউরোপে ৯৯% লোক ছিল অশিক্ষিত। তাদের মধ্যে গোসলখানার ধারণাই ছিল না। কর্ডোভাতেই ছিল ৮০০ পাবলিক স্কুল। ছিল ৭০ টি লাইব্রেরী এবং সবচেয়ে বড়টিতে ছিল ৬ লাখ বই। বছরে ৬০ হাজার বই প্রকাশিত হত।
অথচ ইতিহাসের অমোঘ বিধানে ১৪৯২ সালে স্পেনের তৎকালীন শাসক আবু আব্দুল্লাহ ফার্ডনান্ড ও ইসাবেলার কাছে আত্মসমর্পন করতে বাধ্য হন। পরাজয়ের ধারায় তিনি যখন বিজয়ীদের হাতে আল হামরার চাবি তুলে দেন তখন অঝোরে কাঁদতে দেখে আব্দুল্লাহর মা বলেছিলেন- ‘পুরুষের মত যা রক্ষা করতে পারনি, তার জন্য নারীর মতো কাঁদতে পারো না তুমি।’
১৪৯২ সালে নসর বংশের পতনের মধ্য দিয়ে স্পেনে মুসলিম শাসনের চির অবসান ঘটে। পরবর্তী প্রায় ১০০ বছর খৃস্টানদের ধর্মান্তকরণ, অত্যাচার, নিপীড়ন ও হত্যার মধ্য দিয়ে মুসলিমদের চুড়ান্ত উচ্ছেদ সম্পন্ন হয়। সপ্তদশ শতকের গোড়ার দিকে এই উচ্ছেদ প্রক্রিয়া শেষ হবার পর সেখানে প্রকাশ্যে কোন মুসলিমের অস্তিত্ব ছিল না। তবে দীর্ঘ ৮০০ বছর শাসন করে একটি সমৃদ্ধ সভ্যতার জন্ম দিয়েছিল।
অর্ডিনারি আইটির নীতিমালা মেনে কমেন্ট করুন। প্রতিটি কমেন্ট রিভিউ করা হয়।
comment url