মুহাম্মদ বিন কাসিম ভারতবর্ষে প্রথম মুসলিম বিজেতা
মুহাম্মদ বিন কাসিম ইসলামের ইতিহাসে একজন অমর বীর। একজন বিপ্লবী বা বিজেতা জীবিত থাকেন যুগ থেকে যুগান্তরে, প্রজন্ম থেকে প্রজন্মের কাছে। ইতিহাসে এমন অনেক বিজয়ী আছেন যারা একবারে কিশোর কিংবা তরুণ বয়সেই বিস্ময়কর বিজয় পেয়েছেন।
মুহাম্মদ বিন কাসিম ভারতবর্ষে প্রথম মুসলিম বিজেতা
ইসলামপূর্ব যুগ থেকেই আরব বণিকগণ ভারতীয় উপমহাদেশের সাথে ব্যবসা-বাণিজ্য করতো। আরব নাবিকগণ স্থানীয় রমণীদের বিয়ে-সাদি করে উপমহাদেশের পশ্চিম ও পূর্ব উপকূলে স্থায়ীভাবে বসবাস করার মধ্যদিয়ে বেশ কয়েকটি উপনিবেশ গড়ে তোলে। কিন্তু ইসলামের আবির্ভাবের প্রায় একশ বছর পর ভারতে মুসলমান শাসনের গোড়াপত্তন হয়।
মুহাম্মদ বিন কাসিম পৃথিবীর আলো-বাতাসে বেঁচেছেন মাত্র ২০ বছর। এই সময়েই মাত্র ১৭ বছর বয়সে তিনি সিন্ধু জয় করেন। ষোল বা সতের বছর বয়সে সম্মুখ সমরে তিনি নিজেকে একজন বীর যোদ্ধা হিসাবে প্রমান করেন। সৈনিক জীবনের সকল বৈশিষ্ট্য তার মধ্যে বিদ্যমান ছিল। সিন্ধু বিজয়ের মাধ্যমেই তিনি ভারতবর্ষে প্রথম মুসলিম বিজেতা হয়ে বদলে দিয়েছিলেন ভারতবর্ষের ইতিহাস।
মুহাম্মদ বিন কাসিম ৬৯৫ সালে আরব উপদ্বীপে জন্মগ্রহণ করেন। শৈশবেই তিনি পিতাকে হারান। ছোট বেলা থেকেই তিনি সমরশাস্ত্রে আগ্রহী ছিলেন। ঘোড়ায় চড়া, তলোয়ার চালানো ইত্যাদি বিষয়ে দক্ষতা অর্জনে তিনি সচেষ্ট ছিলেন। ছেলের এ আগ্রহ বুঝে মা তাকে উমাইয়া সেনা বাহিনীতে পাঠিয়ে দেন। উমাইয়া সেনাপতি হাজ্জাজ বিন ইউসুফ নিজ হাতে তাকে গড়ে তুলেন।
হজরত মুহাম্মদ সা. এর মৃত্যুর একশ বছরের মধ্যে আরবরা পারস্য দখল করে ভারতের দিকে অগ্রসর হয়। ভারতে প্রথম মুসলিম আক্রমণ শুরু হয় সিন্ধুতে। সে সময় সিন্ধুর রাজা ছিলেন ব্রাহ্মণ্যধর্মী দাহির। ইরাক ও খোরাসানের শাসক ছিলেন হাজ্জাজ। তিনি ভারতে আরব বা তুর্কী আক্রমণের সূচনা করেন। তিনি পরপর দুটি অভিযানেই ব্যর্থ হন।
৭১১ খৃস্টাব্দে হাজ্জাজ তাঁর ভ্রাতুষ্পুত্র ও জামাতা মুহাম্মদ বিন কাসিমকে তৃতীয় অভিযানের সেনানায়ক করে পাঠান। ৭১২ খৃস্টাব্দে মুহাম্মদ বিন কাসিম সিন্ধুর এক বন্দর দেবল দখল করে একের পর এক সিন্ধুর নগরগুলি অধিকার করেন। জাঠম, মেড় ও বৌদ্ধরা দলে দলে স্বদেশের বিরুদ্ধে শত্রুপক্ষে যোগ দেয়। অনেক হিন্দু সামন্তরাও আরবদের সাহায্য করে।
নিরুন দখল করে মুহাম্মদ বিন কাসিম সিন্ধু আক্রমণ করলে সেই যুদ্ধে দাহির পরাজিত ও নিহত হয়। উমাইয়াদের এ বিজয়ের ফলে সিন্ধু উমাইয়া খিলাফতের অন্তর্ভূক্ত হয়। ফলে সিন্ধুর শেষ হিন্দু রাজবংশের উৎখাত হয়। এরপর মুলতান আক্রমণ করলে সেখানকার বণিক ও শিল্পীরা বশ্যতা স্বীকার করে নেয়।
আরবদের এই সিন্ধু বিজয় ভারতের ইতিহাসের ওপর কোনো প্রভাব ফেলতে পারেনি। আরবরাই ভারতীয় সংস্কৃতির দ্বারা প্রভাবিত হয়ে তাদের সঙ্গীত, জোতিষ, চিত্রকলা, শাসনপ্রণালী প্রভৃতি বিষয় সাদরে গ্রহন করেছিল। এ বিজয়ের ফলে ভারতের সঙ্গে দক্ষিণ-পশ্চিম ও মধ্য এশিয়ার দেশগুলির বাণিজ্যিক সম্পর্ক গড়ে উঠে।
সিন্ধু আক্রমণের পটভূমি
তিন দিকের সুবিশাল পর্বতমালা ও ভারত মহাসাগর বিশ্বসভ্যতা থেকে ভারতকে বিচ্ছিন্ন করে রেখেছিল। যদিও আরব ও সিন্ধুর মধ্যে কোনো সংযোগ ছিল না। যুদ্ধ শুরু হয়েছিল আরব সাগরে জর্জরিত জলদস্যুদের ঘটনার কারনে। সেই সময়ে উমাইয়া খলিফা রাজা দাহিরকে সুরক্ষা দেয়ার শর্তে প্রস্তাব দিয়েছিলেন যে, জলদস্যুতা দমনে যেন তাকে সাহায্য করে।
সিন্ধুর রাজা দাহির সিন্ধু থেকে আরব বিদ্রোহীদের এবং তদুপরি মেডস এবং অন্যান্যদের ফিরিয়ে দিতে অস্বীকার করে। কাঠিয়াওয়ারে তাদের ঘাঁটি থেকে মেডস তাদের অভিযানের সময় শ্রীলঙ্কা থেকে আরবে ভ্রমণকারী মুসলিম মহিলাদের অপহরণ করেছিল। এভাবে সিন্ধু রাজা দাহিরের বিরুদ্ধে আরবদের যুদ্ধ করার সুযোগ করে দেয়।
রাজা দাহির বন্দীদের উদ্ধারে সাহায্য করতে অপারগতা প্রকাশ করেন এবং দুটি অভিযানের পর সিন্ধুতে পরাজিত হন। আল হাজ্জাজ প্রায় ৬০০০ সিরিয়ান অশ্বারোহী বাহিনী এবং ইরাক থেকে আসা মাওয়ালিদের দল, ছয়হাজার উটের আরোহী এবং মুহাম্মদ বিন কাসিমের অধীনে সিন্ধু পর্যন্ত ৩০০০ উটের দল সজ্জিত করেন। তার পাঁচটি ক্যাটাপল্টের কামান সমুদ্রপথে পাঠান।
সিন্ধুতে তার সাফল্যের পর মুহাম্মদ বিন কাসিম হিন্দের রাজাদের কাছে চিঠি লিখে তাদের আত্মসমর্পণ এবং ইসলাম ধর্ম গ্রহন করার আহ্বান জানান। তিনি ব্রাহ্মণ অভিজাতদের সম্মান করতেন। বিভিন্ন পদে পুনঃনিযুক্ত করেন। এই প্রথমবারের মত ভারতের বিস্তীর্ণ এলাকা মুসলিম অধিকারে আসে। পরবর্তী প্রায় ৩০০ বছর ভারতে মুসলমানদের আর কোন অভিযান প্রেরিত হয়নি।
হিন্দু ও বৌদ্ধদের প্রতিক্রিয়া
উমাইয়া আক্রমণের সময় সিন্ধুর জনসংখ্যার বেশিরভাগই হিন্দু ছিল। তবে একটি উল্লেখযোগ্য সংখ্যালঘু বৌদ্ধধর্মও পালনকারীও ছিল। সোভিয়েত ইতিহাসবিদ ইউ ভি গানকোভস্কি লিখেছেন যে, আরব আক্রমণগুলি কেবল সফল হয়েছিল, কারন বৌদ্ধ নেতারা ব্রাহ্মণ শাসককে ঘৃণা ও বিরোধিতা করতো। এমনকি সময়ে সময়ে আক্রমণকারীদের সহায়তা করতো।
উমাইয়াদের বিজয় এই অঞ্চলটিকে ইসলামের অধীনে নিয়ে আসে এবং উপমহাদেশে ইসলামের আবির্ভাব ঘটে। অনেক সিন্ধি মুসলমান ইসলামের স্বর্ণ যুগে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন। কিন্তু মুহাম্মদ কাসিমের ৭১৫ সালে অকাল মৃত্যুর কারনে ইসলাম একটি রাজনৈতিক শক্তি হিসাবে প্রতিষ্ঠিত হয়নি। পরবর্তীতে আল-হিন্দের রাজারা তাদের রাজ্যে ফিরে আসে।
সিন্ধু অভিজানের প্রত্যক্ষ কারন
মুসলিমদের জাহাজবহর আক্রান্ত ও লুণ্ঠিত হওয়া এবং যাত্রীদের অপহৃত হওয়া সিন্ধু অভিযানের প্রত্যক্ষ কারন। আরো কারন আছে। যেমন-
প্রথমত: হাজ্জাজ বিন ইউসুফ যখন পারস্যের সঙ্গে যুদ্ধরত তখন রাজা দাহির তার শত্রুদের সাহায্য করেন।
দ্বিতীয়ত: হাজ্জাজ বিন ইউসুফের শাসনকালে পারস্যের কিছু বিদোহী ভারতে পালিয়ে আসলে রাজা দাহির তাদের আশ্রয় দেন।
তৃতীয়ত: মুহাম্মদ বিন কাসিমের আগে যে দুটি সামরিক অভিযান রাজা দাহিরের বিরুদ্ধে প্রেরিত হয়, তাতে মুসলমানরা পরাজিত হলে যুদ্ধবন্দীদের নিষ্ঠুরভাবে হত্যা করা হয়।
বর্ণিত কারণগুলোর পরিপ্রেক্ষিতে মুসলমানদের জন্য ভারতে সামরিক অভিযান চালানো অপরিহার্য হয়ে যায়। কারনগুলো থেকে সহজেই প্রতীয়মান হয়, রাজা দাহিরের ঔদ্ধত্যপূর্ণ আচরণের সমুচিত জবাব হিসাবেই মুহাম্মদ বিন কাসিম সিন্ধুতে অভিযান চালান এবং বিজয় লাভ করেন।
সিন্ধু বিজয়ে হাজ্জাজ বিন ইউসুফের ভূমিকা সবচেয়ে বেশি। তিনিই এই বিজয় অভিযানের পরিচালক, নির্দেশক ও তত্ত্বাবধায়ক। চিঠিতে মুহাম্মদ বিন কাসিমকে নির্দেশ দেন- যেহেতু বিজিতরা এখন আমাদের জিম্মি, তাই তাদের জীবন ও সম্পত্তিতে আমাদের হস্তক্ষেপ করার কোনো অধিকার নাই। সুতরাং স্বধর্ম পালনে এবং স্বাচ্ছন্দে বসবাসে যেন কেউ বাধা না দেয়।
এ নির্দেশনা পেয়ে মুহাম্মদ বিন কাসিম ঘোষণা করেন- ধর্ম পালনে পূর্ণ অধিকার দেয়া হলো। কেউ তাদের ধর্ম পালনে বাধা দিতে পারবে না। তারা আগে ব্রাহ্মণদের অনুদান যেভাবে দিত এখনো দিয়ে যাবে। মন্দীরে তারা স্বাধীনভাবে পূজা করবে। সরকারী রাজস্ব থেকে শতকরা তিনভাগ ব্রাহ্মণদের জন্য বরাদ্দ থাকবে।
মুহাম্মদ বিন কাসিম গোটা দেশে সমতার নীতি ও ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠা করেন। সবকিছুই পূর্বের মত বহাল রাখেন। সুযোগ সুবিধা সকলের মধ্যে এমনভাবে বন্টন করেন যে, হিন্দুদের অনেকেই স্বেচ্ছায় ইসলাম গ্রহন করেন। খলিফা ওমরের সময় (৭১৭-৭২০) কয়েকজন হিন্দু রাজা ইসলাম গ্রহন করেন। ভয়ভীতি কিংবা প্রলোভনে পড়ে তাদের ইসলাম গ্রহনের প্রমান নাই।
সিন্ধু বিজয়ের বহুবিধ প্রভাব
সিন্ধু অঞ্চলে মুসলিম শাসন খুব বেশি দীর্ঘ না হলেও ভারতীয় সভ্যতা-সংস্কৃতিতে বহুমাত্রিক প্রভাব বিস্তার করে। ভারতবর্ষে সিন্ধু বিজয় অন্যতম যুগান্তকারী ঘটনা যা পরবর্তী সময়ের ওপর একটি স্থায়ী প্রভাব বিস্তার করে।
ধর্মীয় প্রভাব : সিন্ধু ও মুলতান অঞ্চলে ইসলাম ও ইসলামী সমাজের গোড়াপত্তন হয়। মুসলমানদের সহনশীল আচরণে স্থানীয়দের দৃষ্টিভঙ্গি পাল্টে যায় এবং তারা ইসলাম গ্রহনে আগ্রহী হয়।
রাজনৈতিক ও সামাজিক প্রভাব : এ অভিযানের মাধ্যমে স্থানীয় শাসকদের দুর্বল রাজনৈতিক ব্যবস্থা ও সামরিক শক্তির স্বরূপ উম্মোচিত হয়ে যায়। যা পরবর্তী সময়ে অন্য মুসলিম শাসকদের ভারত অভিযানে প্রলুব্ধ করে। স্থানীয় শাসকদের অন্তর্দ্বন্দ আরবদের রাজনৈতিকভাবে শক্তিশালী করেছিল।
সিন্ধু বিজয়ের আগে এ অঞ্চল ছিল উপজাতি শাসিত একটি বিচ্ছিন্ন অঞ্চল। আরব শাসনাধীন হওয়ার পর সিন্ধু সুবিশাল মুসলিম সাম্রাজ্যের সঙ্গে যুক্ত হয়। অন্যদিকে সিন্ধু আন্তর্জাতিক বাণিজ্য কেন্দ্র হওয়ায় মানুষের জীবনযাত্রার মানও উন্নত হয়।
সাংস্কৃতিক প্রভাব : সিন্ধু বিজয়ের পর আরব মুসলিমরা সহনশীলতার নীতি অবলম্বন করে। তারা ধর্মীয় স্বাধীনতা নিশ্চিত করে। ইসলামের সাথে সাংঘর্ষিক নয় এমন রীতি-নীতির স্বীকৃতি দেয়। ফলে সিন্ধু অঞ্চলে একটি সহনশীল মিশ্র সংস্কৃতির বিকাশ ঘটে।
আরবরা ছিল মহান কবি। ভাষা ও সংস্কৃতির প্রতি তাদের ছিল অগাধ ভালোবাসা। ফলে আরবি ও সংস্কৃত ভাষার মিশ্রণে সিন্ধি নামে একটি নতুন ভাষার জন্ম হয়। তাদের পৃষ্ঠপোষকতায় বহু বিখ্যাত কবির জন্ম হয়। সিন্ধি ভাষায় পবিত্র কোরআনের অনুবাদও হয়।
অর্থনৈতিক প্রভাব : সিন্ধু অঞ্চলে অসংখ্য ছোট শহর ছিল। আরবরা কৃষি ও শিল্পের বিকাশে অভূতপূর্ব অবদান রাখে। সিন্ধু আন্তর্জাতিক বাণিজ্যকেন্দ্র হয়ে উঠে। যোগাযোগের বাহন হিসাবে ঘোড়া ও উটের ব্যাপক প্রচলন ঘটায়। পরিকল্পিত নগর ব্যবস্থা ও সুরম্য প্রাসাদ ভারতীয় নগর সভ্যতায় ছাপ ফেলতে সক্ষম হয়।
মোটকথা আরব অভিযান সিন্ধু অঞ্চলের জন্য ছিল একটি ঐতিহাসিক মূহুর্ত। সামাজিক ও রাজনৈতিক উন্নয়ন এবং সমাজে শান্তি-শৃঙ্খলা প্রতিষ্ঠা করেন। মুসলিম শাসকদের সহনশীল মনোভাবের কারনে সিন্ধু ও মুলতান অঞ্চলে ইসলামি সমাজের সূচনা হয়।
অর্ডিনারি আইটির নীতিমালা মেনে কমেন্ট করুন। প্রতিটি কমেন্ট রিভিউ করা হয়।
comment url