সমাজতন্ত্রে ব্যক্তিগত মালিকানার উৎখাত ঘটায়
সমাজতন্ত্র এমন একটি সামজিক-অর্থনৈতিক ব্যবস্থা যেখানে সম্পদ ও অর্থের মালিকানা সমাজিক বা রাষ্ট্রীয় নিয়ন্ত্রণাধীন অর্থাৎ কোনো ব্যক্তিমালিকানা থাকে না। জনসাধারণের প্রয়োজন অনুসারে পণ্য উৎপাদন হয়। কলকারখানা, খনি, জমি ইত্যাদি রাষ্ট্রীয় সম্পত্তি হিসাবে পরিগণিত হয়।
সমাজতন্ত্র ব্যক্তিগত মালিকানার উৎখাত ঘটায়
সমাজতন্ত্র হল সাম্যবাদী সমাজের প্রথম পর্যায়। সমাজতান্ত্রিক মালিকানা হলো এর অর্থনৈতিক ভিত্তি। সমাজতন্ত্র ব্যক্তিগত মালিকানার উৎখাত ঘটায় এবং মানুষে মানুষে শোষণ, অর্থনৈতিক সঙ্কট ও বেকারত্বের বিলোপ ঘটায়। উম্মুক্ত করে উৎপাদনী শক্তির পরিকল্পিত বিকাশ এবং সমাজের প্রতিটি লোকের সার্বিক বিকাশ সাধন।
সমাজতন্ত্রের মুলনীতি হলো প্রত্যেকে কাজ করবে তার সামর্থ অনুযায়ী এবং প্রত্যেকে গ্রহণ করবে তার প্রয়োজন অনুযায়ী। সমাজতন্ত্র দুই ধরনের : কল্পলৌকিক সমাজতন্ত্র ও বৈজ্ঞানিক সমাজতন্ত্র। সোভিয়েত ইউনিয়নে সমাজতান্ত্রিক রাষ্ট্র কায়েম হয় ১৯১৭ সালে। সমাজতন্ত্র বা Socialism শব্দটি ১৮২৭ সালে ইংল্যান্ডে রবার্ট ওয়েন প্রথম ব্যবহার করেন।
সমাজতন্ত্রের সাধারণ সংজ্ঞা হচ্ছে এমন একটি অর্থনৈতিক ও এর পরিপূরক সামাজিক-রাজনৈতিক ব্যবস্থা, যেখানে উৎপাদনের উপায়ের ওপর ব্যক্তি-মালিকানার পরিবর্তে সামাজিক মালিকানা প্রতিষ্ঠিত, যার উদ্দেশ্য ব্যক্তিগত মুনাফা নয় বরং সামাজিক প্রয়োজন মেটানো। সামাজিক মালিকানা যেমন, রাষ্ট্রীয়, সাম্প্রদায়িক, সমবায়িক ও কর্মী মালিকানা ইত্যাদি বিভিন্ন রূপ থাকতে পারে।
মার্কসের প্রধান রচনাবলির মধ্যে কমিউনিস্ট মেনিফেস্টো অন্যতম। মার্কসের সবচেয়ে নামকরা গ্রন্থ হচ্ছে ‘ডাস ক্যাপিটাল’ যাকে সমাজতন্ত্রের বাইবেল বলা হয়। ঊনবিংশ ও বিংশ শতাব্দীতে বিভিন্ন দেশে বিভিন্ন ধরনের সমাজতন্ত্র দেখা যায়। এমনকি মার্কসবাদীরা সবাই সমাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠার উপায় সম্পর্কে একমত নয়।
সমাজতন্ত্র সম্পর্কে মার্কসের তত্ত্ব
১. কার্ল মার্কসের মতে যে কোন যুগে যে কোন সমাজে অর্থনৈতিক অবস্থাই নৈতিক, সামাজিক, রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক বিষয়াদি নিয়ন্ত্রণ করে। অর্থাৎ মৌল কাটামো অধিকাঠামোকে নিয়ন্ত্রণ করে।
২. পৃথিবীর আসল ইতিহাস হচ্ছে শ্রেণী দ্বন্দের ইতিহাস। এর একটি হল মালিক শ্রেণী অন্যটি হল সর্বহারা শ্রমিক শ্রেণী। এই সর্বহারা শ্রেণীই সংখ্যায় বেশি এবং মালিক শ্রেণীর উৎপাদন যন্ত্রে মজুরির বিনিময়ে কাজ করতে বাধ্য।
৩. মালিক শ্রেণী দ্বারা শ্রমিক শ্রেণী সর্বদাই শাসিত, শোষিত ও নিয়ন্ত্রিত। মুনাফার অনেক কম অর্থই সে মজুরি হিসাবে পেয়ে থাকে। বাকি সিংহ ভাগই মালিকের পকেটে যায়।
৪. রাষ্ট্রের গড়ন বা কাটামো যাই হোক না কেন রাষ্ট্র সর্বদাই মালিক শ্রেণীর স্বার্থে আইন রচনা করে এবং স্বার্থ রক্ষা করে। অতএব মার্কসের মতে রাষ্ট্র হচ্ছে মুলত শোষণের হাতিয়ার।
৫. ঐতিহাসিক প্রয়োজনে সর্বহারা শ্রমিক শ্রেণী পর্যায়ক্রমে সংগঠিত হয় এবং পুঁজিবাদী শোষক সরকারকে উৎখাত করবে। তারা মালিকদের কাছ থেকে উৎপাদন যন্ত্র ছিনিয়ে নেবে এবং সম্পদের নায্য বন্টনের নিশ্চয়তা বিধান করবে।
বস্তুত মার্কসের মতে উপরোক্ত পন্থায়ই সমাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠিত হতে পারে। উৎপাদন যন্ত্রের উন্নতি এবং উৎপাদন সম্পর্কের মধ্যে পরিবর্তনই হল সমাজ পরিবর্তনের মূল কারন। বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন সমাজ বিবর্তনের জন্য পরস্পর স্বার্থ-বিরোধী শ্রেণীসমূহের দ্বন্দ বা শ্রেণী সংগ্রামকে দায়ী করেন। চূড়ান্ত বিপ্লবে সর্বহারা শ্রেণীর মালিকানা প্রতিষ্ঠিত হবে এবং প্রতিষ্ঠিত হবে সমাজতান্ত্রিক সমাজ।
মার্কসবাদী দর্শনে সমাজ-ইতিহাসে পাঁচটি প্রধান পর্যায় দেখা যায়। প্রতিটা পর্যায়ের উৎপাদন প্রণালীর সঙ্গে সামাজিক শ্রেণীসমূহের এক একটা নির্দিষ্ট সম্পর্ক রয়েছে। পর্যায়গুলো নিম্নরূপ-
১. আদি পর্যায় ২. দাসব্যবস্থা পর্যায় ৩. সামন্ত পর্যায় ৪. বুর্জোয়া পর্যায় ৫. পুঁজিবাদী পর্যায় ৬. সমাজতান্ত্রিক পর্যায়।
সমাজতন্ত্রের ইতিহাস
সমাজতন্ত্রের ইতিহাসের উৎপত্তি ১৭৮৯ সালের ফরাসি বিপ্লব এবং তার থেকে উদ্ভূত পরিবর্তনের ভেতরে নিহিত। যদিও এটি আগের আন্দোলন এবং ধারনা থেকেও বিভিন্ন ধারনা গ্রহন করেছে। এছাড়া ১৯ শতকের কল্পলৌকিক সমাজতান্ত্রিকদের দ্বারা কল্পিত নানা ব্যবস্থাগুলো পরবর্তীকালে পরিণত হয়েছিল বৈজ্ঞানিক সাম্যবাদের নানা তাত্ত্বিক উৎসে।
প্রথমদিকের সমাজতন্ত্র
প্রাচীনকাল থেকেই সমাজতান্ত্রিক ধারণায় সাধারণ বা জনমালিকানা সমর্থন করা ছিল বা বিদ্যমান ছিল। গ্রিক দার্শনিক প্লেটো, এরিস্টটল এজমালি সম্পত্তি এবং জন মঙ্গলকর ব্যবস্থার পক্ষ সমর্থন করেছিলেন। আবু যার আল-গিফারীকে ইসলামী সমাজতন্ত্রের একজন প্রধান পূর্বগামী হিসাবে অনেকেই কৃতিত্ব দিয়ে থাকেন।
সমাজতন্ত্রের বৈশিষ্ট্য
এক. সমাজতান্ত্রিক ব্যবস্থার প্রধান বৈশিষ্ট্য হল, কলকারখানা, জমি এবং উৎপাদনের উপকরণের উপর রাষ্ট্রীয় মালিকানা স্বীকৃত থাকবে।
দুই. এই ব্যবস্থায় ব্যক্তিগত সম্পদ ও মুনাফা অর্জন নিষিদ্ধ। ফলে সমাজে শ্রেণী বৈষম্য ও শ্রেণী শোষণ বিলুপ্ত হবে।
তিন. প্রত্যেক ব্যক্তি তার নিজ নিজ যোগ্যতা অনুযায়ী কাজ করবে এবং কাজ অনুযায়ী পারিশ্রমিক পাবে। এভাবে সামাজিক ন্যায় বিচার প্রতিষ্ঠিত হবে।
চার. দেশের উৎপাদন ও বন্টন ব্যবস্থা দেশ বা সমাজের কল্যাণের দিকে লক্ষ্য রেখে করা হয়। সামাজিক কল্যাণ সাধনই এই অর্থ ব্যবস্থার মুল উদ্দ্যেশ্য।
পাঁচ. সমাজতান্ত্রিক ব্যবস্থায় শ্রমিকদের শোষণের কোন সুযোগ থাকে না এবং প্রত্যেকেই সমান সমান সুবিধা ভোগ করে। শ্রমিকদের স্বার্থ রক্ষিত হয়।
ছয়. সমাজতান্ত্রিক অর্থনীতিতে মানুষের সকল মৌলিক প্রয়োজনীয়তা যেমন- খাদ্য, বস্ত্র, বাসস্থান, শিক্ষা, চিকিৎসা ইত্যাদির নিশ্চয়তা বিধান করা হয়।
সাত. এ অর্থ ব্যবস্থায় কেন্দ্রীয় কর্তৃপক্ষের পরিকল্পনা মাফিক অর্থনৈতিক সিদ্ধান্ত নেয়া হয় বলে বেকারত্ব ও মুদ্রাস্ফীতির সম্ভাবনা থাকে না।
আট. অতি উৎপাদন বা কম উৎপাদনজনিত সঙ্কট দেখা দেয় না। কেন্দ্রীয় পরিকল্পনা কর্তৃপক্ষই দ্রব্যসামগ্রীর দাম নির্ধারণ করে থাকে।
সমাজতন্ত্রের তত্ত্ব ও প্রকার
সমাজতন্ত্রের তত্ত্ব ও প্রকার বিবিধ যেমন, মার্কসবাদীরা মার্কস এর সমাজতন্ত্রকে বৈজ্ঞানিক সমাজতন্ত্র বলে দাবী করেন। মার্কসবাদীদের দাবী অনুসারে বৈজ্ঞানিক সমাজতন্ত্রের স্বরূপ হচ্ছে সর্বহারা শ্রেণীর একনায়কত্ব, যা সর্বহারা শ্রেণীর নেতৃত্বাধীন বিপ্লবে পুঁজিপতি শ্রেণীকে উৎখাত করে প্রতিষ্ঠা করতে হয়।
মার্কসবাদীদের মতে, শ্রেণী নিরপেক্ষ কোনো গণতন্ত্র নাই। তাদের মতে প্রচলিত গণতন্ত্র হচ্ছে পুঁজিপতি শ্রেণীর গণতন্ত্র, যা শব্দান্তরে শ্রমজীবী শ্রেণীর ওপর পুঁজিপতিদের একনায়কতন্ত্র। আর এর বিপরীতে সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষের গণতন্ত্র হচ্ছে পুঁজিপতি শ্রেণীকে ক্ষমতাচ্যুত করে দমিত রাখার উদ্দেশে সর্বহারা শ্রেণীর একনায়কতন্ত্র।
ইতিহাস বলে যে মার্কসবাদী সমাজতন্ত্র বিশ্বযুদ্ধের পরিস্থিতিতে কোনো কোনো দেশে ও রাষ্ট্রে প্রতিষ্ঠিত হলেও তা কয়েক দশক পর ভেঙ্গে পড়ে - যেমন সোভিয়েত ইউনিয়ন। অবশ্য মার্কসবাদীরা ধর্মবাদীদের মতোই তাদের আদর্শ বা তত্ত্বের ভুল স্বীকার করতে নারাজ। তাদের মতে ভুল আদর্শের নয়, ভুল হচ্ছে প্রয়োগের।
আরেক ধরনের সমাজতন্ত্র যেমন গণতান্ত্রিক সমাজতন্ত্র যাকে মার্কসবাদীরা একটি গালির মত মনে করে। গণতান্ত্রিক নীতিকে শুধু রাজনীতির ক্ষেত্রে আবদ্ধ না রেখে অর্থনীতির সকল ক্ষেত্রে প্রয়োগ করলেই তা সমাজতন্ত্রের সাধারণ রূপ পরিগ্রহ করে। তাই গণতান্ত্রিক সমাজতন্ত্রীরা মনে করেন যে, গণতান্ত্রিক সমাজ নির্মাণ ছাড়া সমাজতন্ত্র নির্মাণ করা যায় না বা টিকিয়ে রাখা যায় না।
বর্তমান কালের সংকটের মূলে রয়েছে পুঁজিবাদী সমাজের অর্থনৈতিক নৈরাজ্য। সমাজতান্ত্রিক ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠার মধ্য দিয়েই এই মন্দ দিকগুলো দূর করা যেতে পারে। প্রত্যেক সমর্থ ব্যক্তির কর্মকে সমভাবে বিতরণ করবে এবং পুরুষ-নারী ও শিশু নির্বিশেষে জীবনধারণের উপায় নিশ্চিত করবে।
বাংলাদেশে জাতীয়তাবাদ, গণতন্ত্র ও ধর্মনিরপেক্ষতার পাশাপাশি মূল সংবিধানে রাষ্ট্রীয় মূলণীতির চারটি মৌলিক নীতির মধ্যে সমাজতন্ত্র অন্যতম। সমাজতন্ত্রকে সংবিধানে একটি শোষণমুক্ত সমাজ প্রতিষ্ঠার উপকরণ হিসাবে বিবেচনা করা হয়েছে। সংবিধানে রাষ্ট্রের পাশাপাশি ব্যক্তি মালিকানা ও সমবায়কে সমর্থন করে। সংবিধান বিনামূল্য ও বাধ্যতামূলক শিক্ষার ঘোষণা দেয়।
অর্ডিনারি আইটির নীতিমালা মেনে কমেন্ট করুন। প্রতিটি কমেন্ট রিভিউ করা হয়।
comment url