পুঁজিবাদ বিশ্বের সবচেয়ে প্রচলিত অর্থনৈতিক ব্যবস্থা
পুঁজিবাদ বা ধনতন্ত্র হল এমন একটি অর্থ ব্যবস্থা যেখানে বাজার অর্থনীতিতে মুনাফা তৈরির লক্ষ্যে বাণিজ্য, কলকারখানা, বাজার সহ উৎপাদনের সকল যন্ত্র কতিপয় ব্যক্তির হাতে এবং এই পুঁজিবাদকে কেন্দ্র করে যে সমাজ কাঠামো গড়ে উঠে তাকে পুঁজিবাদী সমাজ বলে।
পুঁজিবাদ বিশ্বের সবচেয়ে প্রচলিত অর্থনৈতিক ব্যবস্থা
পুঁজিবাদ বলতে এমন এক আর্থ-সামাজিক ও রাজনৈতিক ব্যবস্থাকে বোঝায় যেখানে কল-কারখানাসহ সব ধরনের উৎপাদনযন্ত্রে ব্যক্তি-মালিকানার নিশ্চয়তা থাকে। এই ব্যবস্থায় ব্যক্তিগত মুনাফা অর্জনের স্বার্থে সবাই অর্থনৈতিক কাজ-কর্মে ব্যস্ত হয়ে ওঠে এবং সমাজে প্রতিযোগিতা বৃদ্ধি পায়। সাথে সাথে বৈষম্য বৃদ্ধি পায় এবং শ্রেণী শোষণ চলতে থাকে।
পুঁজিবাদী শব্দটির অর্থ পুঁজির মালিক। পুঁজিবাদ Capital (পুঁজি) থেকে উদ্ভূত হয়েছে। ১২ থেকে ১৩তম শতাব্দীতে ক্যাপিটালের উদ্ভব হয়েছিল তহবিল, পন্যের স্টক, অর্থের যোগফল বা সুদ বহনকারী অর্থ বোঝাতে। ১২৮৩ সাল নাগাদ এটি ট্রেডিং ফার্মের মূলধন সম্পদ অর্থে ব্যবহার করা হত এবং প্রায়শই সম্পদ, অর্থ, তহবিল ইত্যাদি অন্যান্য শব্দের পরিবর্তে ব্যবহার করা হয়।
১৯ শতকে পৃথিবীর সবচেয়ে শক্তিশালী পুঁজিবাদী দেশ ছিল বৃটেন ও ফ্রান্স। পৃথিবীর অধিকাংশ দেশ ছিল তাদের কলোনি। তৎকালীন সময়ে ইতালি এবং জার্মানি নতুন পুঁজিবাদী দেশ হিসাবে আত্মপ্রকাশ করে। পুঁজিবাদের বৈশিষ্ট্য অনুসারে দেশ দুটিতে অর্থনৈতিক মন্দা, উৎপাদন বন্ধ, শ্রমিক ছাটাই ইত্যাদি কারনে শ্রমিক বিপ্লবের আশংকা দানা বাধতে থাকে।
বিশ্বব্যাপী সমাজতান্ত্রিক অর্থব্যবস্থার পতনের পর পুঁজিবাদের ব্যাপক উত্থান ঘটে। বিশ্বে জনপ্রিয় দুটি অর্থনৈতিক ব্যবস্থার মধ্যে সমাজতন্ত্র এবং পুঁজিবাদ অন্যতম। পুঁজিবাদকে একটি মুক্ত বাজার অর্থনীতি হিসাবে বিবেচনা করা হয় যেখানে উৎপাদনের উপকরণসমূহ ব্যক্তিগত মালিকানার নিয়ন্ত্রণ থাকে। অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির পাশাপাশি বৈষম্যও বৃদ্ধি পায়।
পুঁজিবাদের সংজ্ঞা
বিভিন্ন সমাজবিজ্ঞানী ও তাত্ত্বিক ভিন্ন ভিন্ন দৃষ্টিকোণ থেকে পুঁজিবাদের সংজ্ঞা প্রদান করেছেন। সিডনি উলফ এর মতে- ‘পুঁজিবাদ হচ্ছে সমাজ উন্নয়নের একটি স্তর, যেখানে ব্যক্তিমালিকানাধীন উৎপাদন ব্যবস্থা বিদ্যমান এবং শিল্পকারখানা ও শ্রমিকের শ্রম নিয়ন্ত্রণ করে মালিক উৎপাদিত দ্রব্যের একচেটিয়া অধিকার ভোগ করেন। শ্রমিকগণ উৎপাদিত দ্রব্যের মুনাফা থেকে বঞ্চিত হয়।’
অধ্যাপক ডি. এম. সি. রাইট বলেছেন- ‘পুঁজিবাদ এমন এক এক ধরনের ব্যবস্থা যেখানে অর্থনৈতিক কার্যক্রমের অধিকাংশ ক্ষেত্রে ব্যক্তিগত উদ্যোগ গৃহীত হয় এবং অবাধ প্রতিযোগিতা ও মুনাফা অর্জনের লক্ষ্যে পরিচালিত হয়।’
আর. টি. শেফার এবং আর. পি. ল্যাম বলেছেন- ‘পুঁজিবাদ হচ্ছে এমন এক ধরনের অর্থব্যবস্থা যেখানে উৎপাদনের উপায়ের বৃহৎ অংশ ব্যক্তির হাতে ন্যস্ত থাকে এবং আর্থিক কর্মের মূল উত্তেজক হচ্ছে সঞ্চিতি লাভ।’
পূঁজিবাদের সংজ্ঞায় লেলিন বলেন- ‘পুঁজিবাদ বলতে এক বিশেষ সমাজব্যবস্থাকে বোঝায়। এই সমাজব্যবস্থায় জমিজমা, শিল্পকারখানা, যন্ত্রপাতি প্রভৃতির মালিকানা কুক্ষিগত থাকে মুষ্টিমেয় জমিজমার মালিক ও পুঁজিপতিদের হাতে। এবং জনসাধারণের সংখ্যাগরিষ্ঠ অংশের হাতে কোন সম্পদই থাকে না, বা নামমাত্র কিছু থাকে।’
পুঁজিবাদের উৎপত্তি ও বিকাশে ওয়েবারীয় ব্যাখ্যা
সমাজবিজ্ঞানী ম্যাক্স ওয়েবার পুঁজিবাদের উদ্ভব ও বিকাশে একটি মনস্তাত্তিক ব্যাখ্যা দেন। প্রটেস্ট্যান্ট ধর্ম বিশেষ করে কেলভিনবাদ পেশা ও কর্মকে একটা খৃস্টধর্মীয় কর্তব্য বলে প্রচার করে মানুষকে পুঁজিসঞ্চয়ে উদ্বুদ্ধ করে। ওয়েবার বলেন অলস, অক্ষম, কুসংস্কারচ্ছন্ন, অদক্ষ মানুষ দিয়ে পুঁজির বিকাশ সম্ভব নয়।
ওয়েবার পুঁজিবাদ বিকাশে বেনজামিন ফ্রাংকলিন এর কিছু উক্তির উদ্ধৃত্তি দেন। সেগুলো হল- ‘সময়ই অর্থ’। ‘টাকাই টাকা আনে’। ‘সত্যই উৎকৃষ্ট পন্থা’। যে পাঁচ শিলিং হারায় তার শুধু পাঁচ শিলিং ক্ষতি হয় না, এই অর্থ খাটিয়ে যে লাভ হত তাও সে হারায়’। বস্তুত প্রটেস্ট্যান্ট ধর্মে ‘কাজই ধর্ম’ এমন একটা দার্শনিক ব্যাখ্যা দেয়া হয়।
ওয়েবার বলেন ফ্রাংলিনের উক্তি এবং প্রটেস্ট্যান্ট ধর্মীয় মতবাদ পাশ্চাত্যে পুঁজিবাদী অনুপ্রেরণা সৃষ্টি ও পুঁজিবাদ বিকাশের জন্য দায়ী। এসব ব্যাখ্যার দ্বারা পাশ্চাত্যের মানুষ অনুপ্রাণিত হয়েই সৎপথে অর্থ সঞ্চয়ের মাধ্যমে পুঁজিবাদের বিকাশে প্রয়াস চালান। এ কারনেই প্রটেস্ট্যান্ট দেশ যেমন ইংল্যান্ড, হলান্ড, আমেরিকা ইত্যাদি দেশে পুঁজির বিকাশ হয়েছিল।
পুঁজিবাদের উৎপত্তি ও বিকাশে মার্কসীয় ব্যাখ্যা
ঐতিহাসিক বস্তুবাদের অমোঘ নিয়মে সামন্ততন্ত্রের অবক্ষয়ে পুঁজিবাদী সমাজের ভিত্তিভূমি তৈরি হয়ে যায়। পুঁজিবাদ বিকাশের জন্য দুটি শর্ত অপরিহার্য। এক. গুটি কতক ব্যক্তির হাতে কুক্ষিগত সম্পদ ও দুই. নিঃস্ব ছিন্নমূল জনগনের আবির্ভাব। পুঁজিপতির কঠিন শর্তে তারা তাদের শ্রম পুঁজির বিনিময়ে অস্তিত্ব বজায় রাখে।
বুর্জোয়া সমাজ পুরাতনের স্থলে নতুন সামাজিক শ্রেণী সৃষ্টি করে। শোষণের নবতর পন্থা উদ্ভাবন করে এবং শ্রেণী সংগ্রামের নতুন দিগন্ত উম্মোচন করে। মার্কস বলেন যে, ধর্ম ও রাজনীতির মায়াজালের অন্তরালে বুর্জোয়া শক্তি নগ্ন, নির্লজ্জ, প্রত্যক্ষ ও বর্বর শোষণ চালিয়ে যায়। ডাক্তার, আইনজীবি, পুরোহিত, কবি ও বিজ্ঞানীকে মজুরে পরিণত করেছে।
মানুষের সঙ্গে মানুষের সামাজিক, আত্মিক সম্পর্ককে অর্থের সম্পর্কে রুপান্তরিত করে। ব্যবসা-বাণিজ্যের বৃদ্ধির সাথে সাথে বুর্জোয়া শ্রেণীর শক্তি ও সংখ্যা বাড়তে থাকে। শ্রমিকদের নামমাত্র মজুরি দিয়ে মুনাফার সিংহভাগই মালিকের পকেটে যায়। এই পুঁজি তথা পুঁজিবাদ বিকাশে বলিষ্ঠ ভূমিকা পালন করে।
পুঁজিবাদের বৈশিষ্ট্য
পুঁজিবাদী ব্যবস্থার বিকাশ ও পরিবর্তনশীলতার আলোকে এর প্রধান বৈশিষ্ট্যগুলিকে সংক্ষেপে তুলে ধরা হল- ১. উদ্দ্যোক্তার স্বাধীনতা : পুঁজিবাদী ব্যবস্থায় প্রত্যেক ব্যক্তি কোনো হস্তক্ষেপ ছাড়াই তাদের নিজস্ব অর্থনৈতিক সিদ্ধান্ত নেয়ার অধিকার রাখে। এই অর্থ ব্যবস্থায় সম্পদের ব্যক্তিগত মালিকানা থাকে এবং পূঁজি বিনিয়োগের মাধ্যমে যে কেউ উদ্যোক্তা হতে পারে।
২. ব্যক্তিগত মালিকানা : এটি পুঁজিবাদের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বৈশিষ্ট্য। ব্যক্তিগত মালিকানা পুঁজিবাদের মৌল ভিত্তি। এ ব্যবস্থায় কারখানা বা ব্যবসা প্রতিষ্ঠানের যাবতীয় সরঞ্জাম ব্যক্তিগত সম্পত্তি বা কোম্পানির মালিক গণের মালিকানাধীন থাকে।
৩. মুনাফা লাভের উদ্দেশে উৎপাদন : মুনাফা অর্জনই হল পুঁজিবাদী উৎপাদনের মূল প্রেরণা। পুঁজিপতিরা অধিক মুনাফা অর্জনের ব্যাপারে তাদের উদ্যোগকে অব্যাহত রাখে। মুনাফা অর্জন ও তাকে সর্বোচ্চ পর্যায়ে উন্নীত করাই হল পুঁজিবাদী উৎপাদন ব্যবস্থার বৈশিষ্ট্য।
৩.সরকারি হস্তক্ষেপ মুক্ত : পুঁজিবাদী অর্থনীতির দৈনন্দিন কর্যক্রমে সরকার কোন রকম হস্তক্ষেপ করে না। ভোক্তা এবং উৎপাদক যে কোন পণ্য বা পরিষেবা সম্পর্কে তাদের নিজস্ব সিদ্ধান্ত নিতে সম্পূর্ণ স্বাধীন থাকে। বাজারে চাহিদা এবং সরবরাহ অনুযায়ী পণ্যের মূল্য নির্ধারণ করা হয়।
৪. উৎপাদন শক্তির উন্নতি : পুঁজিবাদী উৎপাদন ব্যবস্থায় উৎপাদন শক্তির দ্রুত উন্নতি ও ব্যপক বিকাশ ঘটে। কারিগরি বিদ্যা ও প্রযুক্তিগত কলাকৌশলের অভাবনীয় অগ্রগতি ঘটে। ফলে শ্রমিকদের উৎপাদন শক্তি বৃদ্ধি পায়।
৫. শ্রেণীবিভাগ : এই উৎপাদন ব্যবস্থায় সম্পদের মালিকানার ভিত্তিতে উচ্চবিত্ত, মধ্যবিত্ত ও নিম্নবিত্ত ইত্যাদি শ্রেণীবিভাগ সৃষ্টি হয়। সমাজে আয় ব্যয় বৈষম্য সৃষ্টি হয়। ধনীরা আরও ধনী হতে থাকে এবং দরিদ্ররা আরও দরিদ্র হতে থাকে।
৬. অবাধ প্রতিযোগিতা : বিভিন্ন উৎপাদক গোষ্ঠী ও ব্যবসায়ী প্রতিষ্ঠানের মধ্যে অবাধ প্রতিযোগিতা পরিলক্ষিত হয়। পুঁজিপতি উৎপাদকরা নিজেদের উৎপাদিত পণ্যের জন্য বাজার দখলের উদ্দেশ্যে পরস্পরের সঙ্গে প্রতিযোগিতা করে।
৭. এলিটদের প্রাধান্য : পুঁজিবাদী ব্যবস্থায় উৎপাদনের উপাদানসমূহের মালিকানা কেন্দ্রীভূত থাকে পুঁজিপতিদের হাতে। শ্রমিক শ্রেণী সকল প্রকার মালিকানা থেকে বঞ্চিত থাকে। অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে প্রভাবশালীদেরই প্রাধান্য প্রতিষ্ঠিত হয়। জনসাধারণও রাজনীতিক ক্ষমতার সুযোগ-সুবিধা থেকে কার্যত বঞ্চিত থাকে।
৮. শ্রমিক শোষণ ও শ্রমশক্তি বিক্রয় : এই ব্যবস্থায় আপাতদৃষ্টিতে শ্রমিক শ্রেণী স্বাধীন ও মুক্ত বলে বিবেচিত হয়। পুঁজিপতিরা শ্রমিকদের নাম মাত্র মজুরি দেয়। নায্য পাওনা থেকে বঞ্চিত ও শোষণ করা হয়। এই অসহায় অবস্থা থেকে বাচার জন্য শ্রমিকরা শ্রম বিক্রি করতে বাধ্য হয়।
পুঁজিবাদ আজ বিশ্বের সবচেয়ে প্রচলিত অর্থনৈতিক ব্যবস্থা। বর্তমানে বিভিন্ন দেশে বিভিন্ন ধরনের অর্থনৈতিক ব্যবস্থা চালু আছে। এটি বিশ্ব অর্থনীতির প্রায় ৮০% নিয়ন্ত্রণ করে। পুঁজিবাদের সুবিধা অসুবিধাগুলি বিবেচনা করে এর উন্নতি ও সংস্কার করা জরুরী।
পুঁজিবাদের ব্যর্থতা
পুঁজিবাদই ইতিহাসের শেষ কথা নয়। একর পর এক বিপর্যয়ে পর্যুদস্ত পুঁজিবাদী ব্যবস্থা। এক সঙ্কট সামাল দিতে আরেক ধাক্কা। পুঁজিবাদের এই ব্যর্থতা ক্রমশ স্পষ্ট হয়ে উঠছে। কার্ল মার্কস বলেন- এটি পুঁজিবাদের সাধারণ সংকট। এই সংকট অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি মন্দার মধ্যে ঘুরপাক খায়। ফলে কয়েক দশক ধরে এই বিপর্যয় পুঁজিবাদের অনিবার্য পরিণতি ছাড়া আর কিছুই নয়।
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর পুঁজিবাদের মূল হাতিয়ারে পরিণত হয় বিশ্বব্যাংক ও আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল। এই প্রতিষ্ঠানগুলি কম সুদে ঋণের বিনিময়ে দেশে দেশে অর্থনৈতিক সংস্কার চাপিয়ে দেয়। পুঁজিবাদের নীতি অনুযায়ী মুনাফার জন্য মালিক শ্রেণী কর্মীদের বঞ্চিত করে। এতে মধ্যবিত্ত ক্রমে গরিব হতে থাকে এবং সম্পদ কিছু মানুষের হাতে জমতে থাকে।
জোড়াতালি দিয়ে সময়ে সময়ে পুঁজিবাদের সঙ্কটের মাত্রা কমিয়ে আনা গেলেও তা কখনো মুনাফার কারনে স্থিতিশীলতা নিশ্চিত করতে পারেনা। পুঁজিবাদের নয়া উদারবাদ ও মুক্তবাজার নীতি যে মানুষের জীবন-জীবিকার সমস্যার ন্যূনতম সমাধান দিতে পারে না। আর সে কারনেই দেশে দেশে জেগে উঠেছে মানুষ, যার মধ্যে নিহিত আছে বিপ্লবের বীজ।
অর্ডিনারি আইটির নীতিমালা মেনে কমেন্ট করুন। প্রতিটি কমেন্ট রিভিউ করা হয়।
comment url