ধর্মনিরপেক্ষতাবাদে রাষ্ট্র কোন ধর্মীয় বিশ্বাসে বিশ্বাসী হবে না
ধর্মনিরপেক্ষতাবাদ বা সেকুলারিজম বলতে সাধারণত রাষ্ট্র আর ধর্মকে পৃথকভাবে প্রকাশ করাকে বুঝায়। রাষ্ট্রকে ধর্ম বা ধর্মীয় রীতিনীতির বাইরে রেখে পরিচালনা করাকে বোঝায়। রাষ্ট্রের আইন কোন নির্দিষ্ট ধর্মের উপর নির্ভরশীল থাকবে না। তবে ধর্মীয় স্বাধীনতাকে গুরুত্ব দেয়া হয়।
ধর্মনিরপেক্ষতাবাদে রাষ্ট্র কোন ধর্মীয় বিশ্বাসে বিশ্বাসী হবে না
ধর্মনিরপেক্ষতাবাদ কোন ধর্মকে পক্ষপাত করে না। সরকার কোনরূপ ধর্মীয় হস্তক্ষেপ করবে না এবং রাষ্ট্র কোন ধর্মীয় বিশ্বাসে বিশ্বাসী হবে না। কোন ধর্মকে কোন প্রকার অতিরিক্ত সুবিধা প্রদান করবে না। কাউকে ধর্ম পালনে বাধ্য করা হবে না। সকল ধর্মের মানুষ সমান অধিকার ভোগ করবে। ধর্মীয় বিশ্বাসের উপর নয় বরং রাষ্ট্রের সিদ্ধান্তগুলো তথ্য প্রমাণের উপর নির্ভর করবে।
ধর্মনিরপেক্ষতাবাদ শব্দটি ১৮৫১ সালে বৃটিশ লেখক জর্জ জ্যাকব ইলিয়ক প্রথম ব্যবহার করেন। তিনি সমাজে শৃঙখলা আনয়নের জন্য এই ধর্মনিরপেক্ষ ধারণা প্রকাশ করেন। আরও বিস্তৃত করে বলেন যে, ‘ধর্মনিরপেক্ষতা খৃষ্টধর্মের বিরুদ্ধে কোনো মতবাদ নয়। এটি একটি স্বাধীন সত্ত্বা। ধর্মের অস্তিত্ব নিয়ে প্রশ্ন তোলে না কিন্তু অন্যদের ধর্মনিরপেক্ষ হতে উৎসাহিত করে।’
এই মতবাদে সকল প্রকার ধর্মীয় ভেদাভেদ মুক্ত সমাজ গড়ার আহ্বান জানানো হয়। প্রকৃতপক্ষে সেকুলারিজম অর্থে উপমহাদেশে ধর্মনিরপেক্ষতা ব্যবহার করা হয় না। উপমহাদেশে ধর্মনিরপেক্ষতার প্রচলিত ধারনা হল, নাগরিকদের ধর্ম থাকবে তবে রাষ্ট্রের কোন ধর্ম থাকবে না। ধর্মের সাথে সম্পর্কহীন এই মতবাদ রাষ্ট্র, নৈতিক, শিক্ষা ইত্যাদি ধর্মীয় শাসন থেকে মুক্ত থাকা উচিত।
জর্জ জ্যাকব ১৮৯৬ সালে ধর্মনিরপেক্ষতার সংজ্ঞায় বলেন- ধর্মনিরপেক্ষতার জীবন বিশুদ্ধরূপে মানুষের বিবেচনার উপর প্রতিষ্ঠিত, যারা ধর্মের অনির্দিষ্ট বা অপর্যাপ্ত, অবিশ্বস্থ বা অবিশ্বাস্য ধর্মতত্ত্বকে বিশ্লেষণ করতে ইচ্ছুক তাদের জন্যই এই মতবাদ। পার্থিব জীবনের সার্বিক কল্যাণকেই বেশি প্রাধান্য দিতে হবে।
এটি হল এমন দর্শন যা সকল প্রকার ধর্মবিশ্বাসকে নাকচ করে দেয়। এনসাইক্লোপেডিয়া ব্রিটানিকাতে বলা হয়েছে যে, যারা কোন ধর্মের অন্তর্গত নয়, কোন ধর্মের সাথে সম্পৃক্ত নয়, কোন ধর্মে বিশ্বাসী নয় এবং আধ্যাতিকতা, জবাবদিহিতা ও পবিত্রতা বিরোধী তাদেরকেই বলা হয় ধর্মনিরপেক্ষ। অক্সফোর্ড ডিকশনারি-এর মতে আল্লাহতে বিশ্বাস ত্যাগ করে মানব জাতির কল্যাণ চিন্তার ওপর ভিত্তি করে নৈতিকতা গড়ে উঠবে।
বৃটিশ বিশ্বকোষে দেখা যায়- ‘এটি একটি সামাজিক আন্দোলন, যার একমাত্র লক্ষ্য মানুষদেরকে পরকাল মুখী থেকে ফিরিয়ে এনে দুনিয়া মুখী করা ‘ এটি এমন একটি দর্শন যা সকল প্রকার ধর্ম বিশ্বাসকে নাকচ করে দেয়। ধর্মনিরপেক্ষ রাজনীতি বলতে বুঝায়- ধর্মের প্রভাব মুক্ত রাষ্ট্র ব্যবস্থা। বলা হয়- ধর্ম যার যার রাষ্ট্র সবার।
ড. হাসানুজ্জামান বলেন, ধর্মনিরপেক্ষতা কেবল অল্প খারাপই নয়, এটি সত্য বিধ্বংসী ইবলিসী কালকুট। অর্থাৎ ধর্মনিরপেক্ষতাবাদ এমন একটি মতবাদ, চিন্তাধারা, বিশ্বাস যা পারলৌকিক ধ্যান-ধারণা ও ধর্মের সাথে সম্পর্কহীনভাবে সমাজ, রাজনীতি, অর্থনীতি, সংস্কৃতি, আন্তর্জাতিক সম্পর্ক ও রাষ্ট্র পরিচালনা করে। যা সম্পূর্ণভাবে ইসলামের সাথে সাংঘর্ষিক।
ধর্মনিরপেক্ষ মতবাদের জন্মকথা
সর্বপ্রথম খৃস্টপূর্ব ৫ম শতকে গ্রিকরা দর্শনচর্চা করতে গিয়ে ধর্মনিরপেক্ষতাবাদের উন্মেষ ঘটায়। সে সময় সক্রেটিসের চিন্তাধারাতে ধর্মনিরপেক্ষতার প্রভাব লক্ষ্য করা যায়। পরবর্তীতে রোমান সাম্রাজ্যেও এর প্রভাব লক্ষ্য করা যায়। এরপর মধ্যযুগের শেষের দিকে ধর্মনিরপেক্ষতার আধুনিক ভাবধারার বিকাশ ঘটতে থাকে।
পশ্চিম ইউরোপে স্কলাস্টিক ও লসিনলিস্ট দার্শনিকদের ধর্মনিরপেক্ষ চিন্তাধারা হতে এর ক্ষেত্র তৈরি হয়। লুথার কিং এর খৃস্টান প্রটেস্ট্যান্ট সংস্কার আন্দোলন যা ধর্মকে ব্যক্তিগত বিষয় হিসাবে আখ্যায়িত করে। ম্যাকিয়াভেলির নৈতিকতামুক্ত মতবাদ এবং ফরাসি বিপ্লবের ফলে সৃষ্ট রাষ্ট্রকে ধর্ম থেকে আলাদা করার আন্দোলন পরবর্তীতে ধর্মনিরপেক্ষতাবাদে রূপ নেয়।
ধর্মনিরপেক্ষতাবাদের মূল প্রবক্তা জ্যাকব ইলিয়ক ধর্মীয় পরিবেশে লালিত-পালিত হলেও যাজকদের দুর্নিতি এবং ধর্মকে নিজ স্বার্থে ব্যবহার দেখে তিনি চার্চের প্রতি বিমুখ হয়ে যান। তার সঙ্গীরা নাস্তিকতাবাদী আন্দোলনের বিকল্প অথচ সহধর্মী একটি আন্দোলন ১৮৪৬ সালে শুরু করেন। জনগণ যাতে তাদের আন্দোলনকে নাস্তিক্যবাদী মনে না করে সে জন্য তারা সুকৌশলে সেক্যুলারিজম শব্দটি ব্যবহার করেন।
এই আন্দোলনের সবাই ছিলেন কট্টর নাস্তিক্য এমনকি ব্রেডলাফ ও তার সহযোগীরা এটাকে নাস্তিক্যবাদী আন্দোলন বলে প্রচার করতে দ্বিধা করতেন না। তাদের মতে, ধর্মনিরপেক্ষতাবাদের আন্দোলনকে সফল করতে হলে অবশ্যই নাস্তিকতাও প্রচার করতে হবে। নাস্তিকতাবাদ ছাড়া ধর্মনিরপেক্ষতাবাদ টিকে থাকতে পারে না।
তারা এক সময় প্রচার করতে থাকে যে, এই আন্দোলন আস্তিকতাও নয় নাস্তিকতাও নয়। যদিও এ আবস্থার কোন বাস্তবতা নাই। ব্রেডলাফ ও তার সহযোগীদের কট্টর অবস্থা থেকে বিশ শতকের দিকে এসে ধর্মনিরপেক্ষতা আন্দোলন স্বতন্ত্র আন্দোলনের মর্যাদা লাভ করে। যার মূল উদ্দেশ্য হলো রাষ্ট্র পরিচালনা থেকে ধর্মকে আলাদা করা।
মুসলিম দেশে ধর্মনিরপেক্ষতাবাদ
ধর্মনিরপেক্ষতাবাদ গত আড়াই শত বছর থেকে এটা দুনিয়ার সর্বত্র একটি আদর্শের মর্যাদা লাভ করেছে। মুসলিম প্রধান দেশগুলোর মধ্যে সর্বপ্রথম কামাল পাশা তুরস্কে এই মতবাদ প্রতিষ্ঠিত করেন। ইতিপূর্বে কোন মুসলিম দুনিয়াময় এই মতবাদের দীক্ষা গ্রহন করেনি। এমনকি পাকিস্থান ধর্ম ভিত্তিক রাষ্ট্র হওয়ার পরও এক শ্রেণীর মুসলিম এই মতবাদের প্রকাশ্য সমর্থন করে।
আরব বিশ্বে এই মতবাদকে ‘লা দ্বীনিয়াহ’ বা ধর্মহীনতা বলা হলেও এ মতবাদের প্রবক্তারা ইলমানিয়াহ বা বিজ্ঞানময় শব্দটি ব্যবহার করেন। এ মতবাদটি প্রথমে ইউরোপে তারপর পাশ্চাত্যে ও সামাজতন্ত্রের প্রভাব-প্রতিপত্তির সুবাদে বিশ্বের অন্যান্য দেশে বিস্তার লাভ করে। ১৭৮৯ ফ্রান্সে শিল্প বিপ্লবের আগে ও পরে ধর্মনিরপেক্ষতার ব্যাপক প্রসার ঘটে।
ধর্মীয় প্রবণতাকে মানুষের ব্যক্তি জীবনে সীমাবদ্ধ রেখে সমাজ জীবনের সকল দিক ও বিভাগ থেকে মুক্ত রাখার নামই ধর্মনিরপেক্ষতাবাদ। সামাজিক, রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ও আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে ধর্মকে পরিত্যাগ করাই এর লক্ষ্য। তবে গণতান্ত্রিক ধর্মনিরপেক্ষতার বৈশিষ্ঠ্য হচ্ছে ধর্মীয় সমন্বয়বাদ আর সমাজতান্ত্রিক ধর্মনিরপেক্ষতার বৈশিষ্ট্য হচ্ছে ধর্মহীনতা।
সমাজে ধর্মের অবস্থানের ক্ষেত্রে অন্যান্য ইউরোপীয় দেশ এবং যুক্তরাষ্ট্রীয় দেশসমূহের মত ইসলামী রাষ্ট্রসমূহের মধ্যেও ভিন্নতা এবং পর্থক্য পরিরক্ষিত হয়। ধর্মনিরপেক্ষতাবাদকে প্রায়শই জনগণের জীবন এবং সরকারী বিষয়াবলী থেকে ধর্মীয় শিক্ষা এবং নির্দেশাবলীকে পৃথকীকরণ হিসাবে অর্থাৎ ধর্ম ও রাজনীতি পৃথকীকরণ হিসাবে ব্যাখ্যা করা হয়।
আধুনিক ধর্মনিরপেক্ষতার ইতিহাস
এই মতবাদটি কোন আধুনিক সৃষ্টি নয়। বর্তমানকালেও এর প্রচার চলছে। এটি আধুনিক ও প্রগতিশীল বলেই এক শ্রেণীর নিকট এর সুনাম আছে। ধর্মনিরপেক্ষতাবাদ প্রায় ২৫০ বছর পূর্বে ইউরোপে প্রথম প্রতিষ্ঠা লাভ করে। পনের শতাব্দীতে এর জন্ম হয় এবং দীর্ঘ সংগ্রামের পর ১৮ শতাব্দীর প্রথমার্ধে তা বিজয়ী মতাদর্শ হিসাবে কায়েম হয়।
ইউরোপের ধর্মযাজকদের জুলুম নির্যাতনের বিপরীতে মজলুম জনতা এই মতবাদের আবিস্কার করেন। বাংলাদেশের সংবিধানের ৪র্থ সংশোধনীতে চারটি মূলনীতির মধ্যে ধর্মনিরপেক্ষতা অন্যতম। ৫ম সংশোধনীর মাধ্যমে আমাদের সংবিধানকে তৎকালীন সরকার ধর্মনিরপেক্ষ মুক্ত করেছিল। এটি ছিল জনগণের আকিদা বিশ্বাসের সাথে ছিল সাংঘর্ষিক।
চার্চের যাজকদের অত্যাচারের বিরোধিতা করতে এই মতবাদের জন্ম হয়েছে যা কখনো মানুষকে মুক্তি দিতে সক্ষম নয়। রাষ্ট্রের এই ধর্মহীনতার সুযোগে রাষ্ট্রীয় যন্ত্র আরো অত্যাচারের সুযোগ পেয়ে যাবে। সঙ্গত কারনেই মুসলিম দেশে এই দর্শনের প্রয়োগ অযৌক্তিক।
অর্ডিনারি আইটির নীতিমালা মেনে কমেন্ট করুন। প্রতিটি কমেন্ট রিভিউ করা হয়।
comment url