জাতীয়তাবাদ একটি ভাবগত বা মানষিক ধারণা বিশেষ

জাতীয়তাবাদ এমন একটি আদর্শ যা জাতিগত মূলবোধকে সবচেয়ে বেশি অগ্রাধিকার দেয়। একই বংশোদ্ভূত বা জনগোষ্ঠীর মধ্যে জাতিগত, সাংস্কৃতিক ও মানষিক ঐক্যবদ্ধ চেতনা। জাতিকে মানব সমাজের কেন্দ্রীয় অবস্থানে স্থাপন করা হয়। জাতির অর্জন সমূকে সামনে তুলে ধরা হয়।

জাতীয়তাবাদ একটি ভাবগত বা মানষিক ধারণা বিশেষ

জাতীয়তাবাদ একটি ভাবগত বা মানষিক ধারণা  বিশেষ


জাতীয়তাবাদ শব্দটি ইংরেজি ন্যাশনালিজম শব্দের বাংলা পরিভাষা। এই শব্দটি ১৮৪৪ সাল থেকে ব্যবহৃত হয়ে আসছে। যদিও মতবাদটি বহু আগে থেকে চলে আসছে। ১৬ শতকে ম্যাকিয়াভেলি সর্বপ্রথম এ মতবাদ প্রচার করেন। ১৯শ শতাব্দীতে এই মতবাদটি গুরুত্বপূর্ণ হয়ে ওঠে। সম্পূর্ণরূপে রাজনৈতিক দৃষ্টিকোণ থেকে জাতীয়তাবাদের লক্ষ্য দেশের জনপ্রিয় সার্বভৌমত্বকে রক্ষা করা।

সাধারণত কোনো জনসমষ্ঠির নিজেদের ইচ্ছানুযায়ী জাতীয় জীবন গড়ে তোলার মানসিক অনুভূতি ও অনুরাগকেই জাতীয়তাবাদ বলা হয়। অধ্যাপক লাস্কি বলেন- ‘জাতীয়তাবাদ হল এক প্রকার মানসিক ঐক্যবোধে উদ্বুদ্ধ জনসমাজ এবং এ ঐক্যবোধ উক্ত জনসমাজকে অন্য মানবসমাজ থেকে পৃথক করে।’ অধ্যাপক লয়েড বলেন- ‘জাতীয়তাবাদ একটি ভাবগত বা মানষিক ধারণা বিশেষ।’

জাতীয়তাবাদের ইতিবাচক ও নেতিবাচক দিক


জাতীয়তাবাদের ধারণা নানামুখী ইতিবাচক পরিবর্তন এনেছে। দার্শনিক ম্যাকিয়াভেলি জাতীয়তার ভিত্তিতে রাষ্ট্র গঠনের যে ধারনা দেন তার ফলে বর্তমান বিশ্বে জাতীয়তাবাদী রাষ্ট্র গড়ে উঠেছে। পূর্বের রাষ্ট্রগুলো ছিল নগর রাষ্ট্র। এ ছাড়াও জাতীয়তাবাদ মানুষকে ঐক্যবদ্ধ করে একটি সম্মিলিত শক্তির উত্থান ঘটায়।

নেতিবাচক অর্থেও এটি ব্যবহৃত হতে পারে। উগ্র জাতীয়তাবাদ তার একটি উদাহরণ। এটি মানুষকে ঐক্যবদ্ধ করলেও মূলত মানুষকে সংকীর্ণমনা করে দেয়। মানুষে মানুষে বিভেদ সৃষ্টি করে। আর যদি জাতীয়তাবাদের মধ্যে ধর্মের উপস্থিতি থাকে তাহলে এটি উগ্রতায় রূপ নিতে পারে। তখন ভিন্ন ধর্ম ও মতালম্বীরা নানাভাবে আক্রান্ত হতে পারেন।

গভীর জাতীয়তাবাদী মনোভাব যুদ্ধের ও জন্ম দিয়েছে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে হিটলার জার্মান জাতিকে উগ্র জাতীয়তাবাদে উদ্বুদ্ধ করে যুদ্ধের ময়দানে টেনে এনেছিল। নৃশংস সেই যুদ্ধে জার্মান বাহিনীর বর্বরতাকে উৎসাহীত করেছিল তাদের জাতীয়তাবাদী চেতনা। তারপরও জাতীয়তাবাদকে আধুনিক বিশ্বের রাজনীতির একটি প্রধান নিয়ন্ত্রণকারী শক্তি বলে গণ্য করা হয়।

ইবনে খালদুন আসাবিয়া বা সামাজিক সংহতিকে গোষ্ঠী সংহতি হিসাবে বিবেচনা করেছেন। তার মতে সমাজের ভিত্তিই হচ্ছে এই গোষ্ঠী সংহতি। রক্ত, জাতি এবং ধর্ম সম্পর্কর ওপর ভিত্তি করে সামাজিক সংহতি গড়ে উঠে। রাষ্ট্র ও সমাজের উৎপত্তির মূল কারন হচ্ছে গোত্র সংহতি। একে গোত্রপ্রীতি, দলপ্রীতি, স্বজনপ্রীতি, পক্ষপাতিত্ব বা জাতীয়তাবাদও বলা যায়।

জাতীয়তাবাদ ও ইসলাম


রাসুল সা. বলেছেন, যে ব্যক্তি আসাবিয়াতের বা গোত্র প্রীতির দিকে লোকদেরকে আহ্বান করে, নিজে আসাবিয়াতের ওপর যুদ্ধ করে এবং আসাবিয়াতের ওপর মৃত্যুবরণ করে সে ব্যক্তি আমাদের দলের নয়। রাসুল সা. আরও বলেন, যে ব্যক্তি লক্ষহীন নেতৃত্বের পতাকাতলে যুদ্ধ করে, গোত্র প্রীতির দিকে আহ্বান জানায় এবং গোত্র প্রীতির কারণেই সাহায্য করে, তার মৃত্যু জাহিলিয়াতের মৃত্যু।

জাতীয়তাবাদ মুসলিম উম্মার পারস্পরিক ভ্রাতৃত্ববোধ ধ্বংস করে দেয়। পৃথিবীর যে কোন প্রান্তে একজন মুসলিমের কষ্টে পৃথিবীর সমস্ত মুসলিম অন্তরে কষ্ট অনুভূব করবে, এটাই ইসলামের শিক্ষা। অথচ জাতীয়তাবাদ আমাদের সেই অনুভূতি নষ্ট করে দেয়। নিজ দেশের কিংবা নিজ জাতির মানুষ সুখে থাকলেই আমরা খুশি। এরূপ স্বার্থপরতাই হচ্ছে জাতীয়তাবাদ।

জাতীয়তাবাদের ইতিহাস


সাধারণ অনুভূতি সত্বেও লোকেরা তাদের দেশকে সেরা বলে বিশ্বাস করে। ১৮ শতকে আমেরিকান এবং ফরাসি বিপ্লবগুলিকে প্রায়শই জাতীয়তাবাদের প্রথম প্রভাবশালী অভিব্যক্তি হিসাবে বিবেচনা করা হয়। ১৯ শতকের সময় জাতীয়তাবাদ ল্যাটিন আমেরিকার নতুন দেশগুলিতে প্রবেশ করে এবং ইউরোপেও ছড়িয়ে পড়ে। বিংশ শতাব্দীর প্রথম দিকে এশিয়া ও আফ্রিকায় জাতীয়তাবাদের উদ্ভব ঘটে।

বাইবেল দ্বারা প্রভাবিত হয়ে ইংরেজ জাতীয়তাবাদের একটি অভিব্যক্তি আবির্ভূত হয়েছিল যেখানে লোকেরা তাদের অনুভূত মিশনকে প্রাচীন ইস্রায়েলের জনগণের সাথে সমতুল্য করেছিল। গর্ব ও আত্মবিশ্বাসে ফুলে ওঠা ইংরেজরা অনুভব করতে শুরু করে যে বিশ্বব্যাপী সংস্কার ও ব্যক্তি স্বাধীনতার একটি নতুন যুগের সূচনা করা তাদের লক্ষ্য।

লক, রুশো এবং অন্যান্য ফরাসি দার্শনিকদের দ্বারা উত্থাপিত স্বাধীনতার ধারনায় প্রভাবিত হয়ে উত্তর আমেরিকার বৃটিশ উপনিবেশের বসতি স্থাপনকারীদের মধ্যে আমেরিকান জাতীয়তাবাদের উদ্ভব হয়েছিল। ১৭৭৫ সালে আমেরিকান বিপ্লব এবং ১৭৭৬ সালে স্বাধীনতার ঘোষণার সাথে চুড়ান্ত হয়ে নতুন আমেরিকান জাতীয়তাবাদের প্রবাব ১৭৮৯ সালের ফরাসি বিপ্লবে প্রতিফলিত হয়েছিল।

আমেরিকা এবং ফ্রান্সে জাতীয়তাবাদ অতীতের কর্তৃত্ববাদ এবং অসমতার পরিবর্তে স্বাধীনতা ও সমতার ভবিষ্যতের প্রগতিশীল ধারণার একটি সর্বজনীন আনুগত্যের প্রতিনিধিত্ব করতে এসেছিল। আমেরিকান এবং ফরাসি বিপ্লবের পর স্বাধীনতা, সাম্য ও ভ্রাতৃত্ব এর প্রতিশ্রুতিতে নতুন বিশ্বাস ও আচারকে অনুপ্রাণিত করেছিল। যেমন পতাকা ,জাতীয় সঙ্গীত জাতীয়তাবাদের অভিব্যক্তি।

২০ শতকের আন্দোলন


১৯১৪ সালে প্রথম বিশ্বযুদ্ধ শুরু হওয়ার সাথে সাথে এবং ১৯৯১ সালে মধ্য-পূর্ব ইউরোপে কমিউনিজমের বিলুপ্তির সাথে শেষ হয়, বিশ শতকে জাতীয়তাবাদের নতুন রূপের উত্থান দেখা যায় যা মূলত প্রথম বিশ্বযুদ্ধ এবং দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের দ্বারা আকৃতি পায়। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর হিটলার জার্মানিতে ধর্মান্ধ জাতীয়তাবাদের একটি নতুন ব্র্যান্ড তৈরি করেন।

প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পর থেকে কোনো সময়ই জাতীয়তাবাদের শক্তি আজকের মতো স্পষ্ট ছিল না। বিশেষ করে ২০১৬ সাল থেকে সারা বিশ্বে জাতীয়তাবাদী মনোভাব উল্লেখযোগ্যভাবে বৃদ্ধি পেয়েছে। চীনকে বিশ্ব অর্থনৈতিক নেতা হিসাবে গড়ে তোলার জন্য চীনাদের প্রচেষ্টার ভিত্তি হচ্ছে জাতীয়তাবাদ। একইভাবে ফ্রান্স, ইতালি, পোল্যান্ড এবং তুরস্কের ডানপন্থী রাজনীতির মধে জাতীয়তাবাদ একটি সাধারণ বিষয়।

অর্থনৈতিক জাতীয়তাবাদ


অর্থনৈতিক জাতীয়তাবাদকে বিশ্ব বাজারের পেক্ষাপটে জাতীয় অর্থনীতিকে তৈরি, বৃদ্ধি এবং সর্বোপরি রক্ষা করার জন্য নীতি এবং অনুশীলনের একটি সেট হিসাবে সংজ্ঞায়িত করা হয়েছে। বিভিন্ন উপায়ে অর্থনৈতিক জাতীয়তাবাদ হল বাণিজ্যবাদের একটি বৈকল্পিক-শূন্য-সমষ্টি তত্ত্ব যা বাণিজ্য সম্পদ তৈরি করে যা সরকারের সুরক্ষাবাদের মাধ্যমে উৎসাহিত করা উচিত।

সমস্যা এবং উদ্বেগ


বর্তমান উন্নত দেশগুলি সাধারণত একাধিক জাতিগত, সাংস্কৃতিক এবং ধর্মীয় গোষ্ঠী নিয়ে গঠিত। জাতীয়তাবাদ গর্বকে অহংকার এবং সম্ভাব্য সামরিক আগ্রাসনের দিকে প্রসারিত করে। চরম জাতীয়তাবাদীরা বিশ্বাস করে যে তাদের দেশের শ্রেষ্ঠত্ব তাদের অন্যান্য জাতির উপর কর্তৃত্ব করার অধিকার দেয়।

বিশ শতকের প্রথম দিকে ইউরোপে যেমনটি হয়েছিল, জাতীয়তাবাদকে ব্যবহার করা হয়েছিল সাম্রাজ্যবাদ এবং উনিবেশকে ন্যায্যতা দেয়ার জন্য। জাতীয়তাবাদের ঢালে পশ্চিমা দেশগুলো আফ্রিকা ও এশিয়ার দেশগুলোকে ছাড়িয়ে গেছে এবং নিয়ন্ত্রণ করেছে। যার ফলে পঙ্গু অর্থনীতি ও সামাজিক পরিণতি আজও থেকে গেছে।

জাতীয়তাবাদী উচ্ছাস বেশ কয়েকবার জাতিগুলিকে দীর্ঘ সময়ের বিচ্ছিন্নতার দিকে নিয়ে গেছে। এটি একটি গোষ্ঠীকে একটি দেশের একমাত্র ন্যায্য নাগরিক হিসাবে প্রতিষ্ঠিত করা হয় ফলে জাতীয়তাবাদ অত্যন্ত বিপদজ্জনক হয়ে ওঠে। জাতীয়তাবাদ অন্য জাতির বিষয়ে কোনো ভূমিকা না রাখার দমবন্ধ একটা মতবাদ।

জাতীয়তাবাদ অনিবার্যভাবে জনগণের মধ্যে একটি প্রতিযোগিতামূলক আমাদের বনাম তাদের এমন একটি মনোভাব তৈরি করে। জাতীয়তাবাদ ঘরোয়া বিভাজন ও অস্থিরতা ও তৈরি করতে পারে। এটি যে কারোর বিরুদ্ধে বৈষম্যকে উৎসাহিত করে। একজন জাতীয়তাবাদী কেবলমাত্র প্রতিযোগিতামূলক প্রতিপত্তির পরিপ্রেক্ষিতে চিন্তা করেন।

জাতীয়তাবাদ ও আন্তর্জাতিকতাবাদ একে অপরের পরিপুরক। আজকাল মানুষের জীবন শুধু জাতীয় স্বার্থের মধ্যে সীমাবদ্ধ নয়। ব্যবসা-বাণিজ্য, সন্ধি-চুক্তি ইত্যাদি কর্মকান্ড রাষ্ট্রকে আন্তর্জাতিক করে তুলেছে। জাতীয়তাবাদ ও আন্তর্জাতিকতাবাদের মধ্যে স্বার্থক সমন্বয়ের উপর মানব সমাজের সুন্দর ভবিষ্যৎ নির্ভরশীল।

বাঙ্গালী জাতীয়তাবাদ


জাতীয়তাবাদী বলতে নিজের মধ্যে কোন জাতিসত্বা কাজ করে সেটিকে বোঝায়। একজন ব্যাক্তি একই সাথে অনেক জাতিসত্বার অন্তর্ভূক্ত হতে পারে। যেমন একই সাথে বাঙ্গালী, মুসলিম, এশিয়ান ইত্যাদি। এখন কোনো সিদ্ধান্ত নিতে হলে আগে চিন্তা করি আমি মুসলিম, তারপর বাঙ্গালী। তারমানে আমার মধ্যে মুসলিম জাতীয়তাবাদ কাজ করে। এভাবে বাঙ্গালী জাতীয়তাবাদীও বলা যায়।

বাঙ্গালী জাতীয়তাবাদ এক রাজনৈতিক অভিব্যক্তি যার মাধ্যমে প্রাচীনকাল থেকে দক্ষিণ এশিয়াতে বসবাসরত বাংলা ভাষাগত অঞ্চলের মানুষদের বুঝানো হয়। ৪০ এর দশকে লাহোর প্রস্তাব এবং ৫২’র ভাষা আন্দোলনের মাধ্যমে বাঙ্গালী জাতীয়তাবাদ দৃঢ় ও সমৃদ্ধ হয়। বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধের প্রধান অনুপ্রেরণা ছিল বাঙ্গালী জাতীয়তাবাদ।

এই পোস্টটি পরিচিতদের সাথে শেয়ার করুন

পূর্বের পোস্ট দেখুন পরবর্তী পোস্ট দেখুন
এই পোস্টে এখনো কেউ মন্তব্য করে নি
মন্তব্য করতে এখানে ক্লিক করুন

অর্ডিনারি আইটির নীতিমালা মেনে কমেন্ট করুন। প্রতিটি কমেন্ট রিভিউ করা হয়।

comment url