কনস্টান্টিনোপল বিজয় ও রোমান সাম্রাজ্যের সমাপ্তি

কনস্টান্টিনোপল এক সময় রোমান, বাইজানটাইন ও ল্যাটিন সাম্রাজ্যের রাজধানী ছিল। ৩৩০ সালে রোমান সম্রাট কনস্টান্টাইন বাইজানটাইন দখলের পর নিজের নামের সঙ্গে মিলিয়ে স্থানটির নাম দেন কনস্টান্টিনোপল। ১২ শতকে এটি ইউরোপের সবচেয়ে বড় ও প্রসিদ্ধ শহর ছিল।

কনস্টান্টিনোপল বিজয় ও রোমান সাম্রাজ্যের সমাপ্তি

কনস্টান্টিনোপল বিজয় ও রোমান সাম্রাজ্যের সমাপ্তি


১৪৫৩ সালে উসমানীয় সুলতান দ্বিতীয় মুহাম্মদ কনস্টান্টিনোপল দখল করেন। ১৫০০ বছরের রোমান সাম্রাজ্যের সমাপ্তি ঘটে। এ বিজয়ের ফলে উসমানীয়দের সামনে ইউরোপে অগ্রসর হওয়ার পথে আর কোন বাধা থাকল না। খৃস্টান জগতে এই পতন ছিল বিরাট ধাক্কার মত। পরে এ জায়গার নাম বদলে রাখা হয় ইস্তানবুল। বর্তমানে এটি তুরস্কের সবচেয়ে বড় শহর।

তুরস্কের ইস্তাম্বুল নানা করনে ঐতিহাসিক শহর। বিশ্বের শহরগুলোর মধ্যে এটি বিরলও বটে। এই শহরটি একই সঙ্গে এশিয়া (মধ্যপ্রাচ্য) এবং ইউরোপের অংশ। এই বিশেষত্বই শহরটি শত শত বছর ধরে সাম্রাজ্যগুলোর আকর্ষণের কেন্দ্র বিন্দুতে পরিণত হয়। পরবর্তী সময়ে এটি অটোমান সাম্রাজেরও অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ কেন্দ্রে পরিণত হয়।

কনস্টান্টিনোপলের নাম কিভোবে ইস্তাম্বুল হল


অনেকে মনে করতে পারেন শহরটি দখলের পর অটোমানরা এর নাম পরিবর্তন করে। আসলে তা নয়। কনস্টান্টিনোপলের আগেও শহরটি বেশ কিছু নামে পরিচিত ছিল। শহরটি প্রতিষ্ঠা করেছিল গ্রীকরা ৬৫৭ খৃস্টাব্দে। তখন এর নাম ছিল বাইজানটিয়াম। এই শহরটিকে আরও অনেক নামে মানুষ চিনত। সম্রাট কনস্টান্টিন ছিলেন প্রথম রোমান সম্রাট যিনি খৃস্টধর্ম গ্রহন করেন।

প্রথম বিশ্বযুদ্ধে পরাজয়ের পর ১৯২২ সালে অটোমান সাম্রাজ্যের পতন হয় এবং ১৯২৩ সালে প্রতিষ্ঠিত হয় তুরস্ক। এর কয়েক বছর পর ১৯৩০ সালে তুর্কি ডাকসেবা শহরের নাম স্থায়ীভাবে ‘ইস্তাম্বুল’ করা হয়। একই বছর যুক্তরাষ্ট্রের স্টেট ডিপার্টমেন্ট এই নামটিই ব্যবহার করে। তবে অনেক আগে থেকেই মানুষ এ শহরটিকে কনস্টান্টিনোপল নামেই চিনত।

সম্রাট কনস্টান্টাইনের সময়ের বহু আগে থেকেই এই শহর অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ছিল। ভূমধ্যসাগর ও কৃষ্ণসাগরের মধ্যে সংযোগ স্থাপনকারী বসফরাস প্রণালির তীরে অবস্থিত হওয়ায় দীর্ঘকাল ধরে এই শহরের মূল গুরুত্ব ছিল বাণিজ্য বন্দর হিসাবে। কন্সটান্টাইন রোমান সাম্রাজ্যের নতুন রাজধানীর জন্য অনেকটা হটাৎ করেই এখানে রাজধানী স্থাপন করেন।

রাজধানী হবার পরই এই শহরের অভূতপূর্ব উন্নতি ঘটে। পূর্ব রোমান সাম্রাজ্য যতদিন গুরুত্বপূর্ণ ছিল ততদিন এই শহরও জৌলুশময় ছিল। ১২০৪ সালে চতুর্থ ক্রসেডের সময় এই শহরের ব্যাপক ক্ষতি হয়। পরবর্তী ২০০ বছর এই শহর অধঃপতনের দিকেই ছিল। তবে খৃষ্টান ধর্মের প্রধান শহর হিসাবে এর গুরুত্ব সবসময়ই ছিল।

এই শহরের প্রতিরক্ষা ব্যবস্থাও ছিল অত্যন্ত দৃঢ়। তাই আরব ও তুর্কিরা বহু শতাব্দী ধরে চেষ্টা করেও এই শহর জয় করতে পারেনি। রাসুল সা. এর ভবিষ্যৎবাণী অনুযায়ী ১৪৫৩ সালে সুলতান দ্বিতীয় মুহাম্মদ এই শহরটি জয় করার ফলে খৃষ্টীয় রোমান বাইজানটাইন সাম্রাজ্যের পতন হয় এবং উসমানীয় সাম্রাজ্য রাজধানী হিসাবে ঘোষণা করে।

অনেক ঐতিহাসিক মুসলমানদের কনস্টান্টিনোপল বিজয় ও বাইজানটাইন সাম্রাজ্যের পতনকে মধ্যযুগের সমাপ্তি হিসাবে দেখেন। উসমানীয়দের এ বিজয়ের ফলে ইউরোপে অগ্রসর হওয়ার পথে উসমানীয় সেনাদের সামনে আর কোন বাধা থাকল না। খৃষ্টানদের জন্য এই শোচনীয় পতন ছিল অকল্পনীয়। সুলতান মুহাম্মদ রাজধানী ইস্তাম্বুলে নিয়ে আসেন।

কনস্টান্টিনোপল কখন থেকে রোমানদের হাতে ছিল


রোমান সম্রাট কন্সটান্টাইন কর্তক ৩৩০ সাল থেকে কনস্টান্টিনোপল রাজধানী হিসাবে ব্যবহৃত হয়ে আসছিল। পরবর্তী ১১ শতাব্দী যাবত শহরটি বেশ কয়েকবার অবরোধের সম্মুখীন হলেও ১২০৪ সালে ক্রসেডের সময় ছাড়া এটি কেউ দখল করতে পারেনি। নাইসিয়ানরা ১২৬১ সালে কনস্টান্টিনোপল অধিকার করে নেয়। ক্রসেডাররা কনস্টান্টিনোপলকে ঘিরে একটি অস্থায়ী ল্যাটিন রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করেন।

উসমানীয় সাম্রাজ্যের সামরিক শক্তি রণকৌশল


১৪৫১ সালে সুলতান মুহাম্মদ ১৯ বছর বয়সে পিতার উত্তরাধিকারী হন। বলকান ও এজিয়ান অঞ্চলে খৃষ্টানদের বিরুদ্ধে তেমন কোন সফলতা দেখাতে না পারায় তার যোগ্যতা নিয়ে অনেকের মনে প্রশ্ন উঠে। কিন্তু দিনে দিনে তার প্রজ্ঞা কৌশল সবার সামনে স্পষ্ট হয়ে উঠে। অভিনব রণকৌশল প্রয়োগ করে তিনি নিজেকে যোগ্য শাসক হিসাবে প্রমাণ করেন।

সুলতান মুহাম্মদ সমুদ্রের দিক থেকে শহর অবরোধের জন্য গ্রিক নাবিকদের নিয়ে গঠিত একটি নৌবহর গড়ে তোলেন। উসমানীয়রা কামান তৈরিতে বেশ দক্ষ ছিল। এই সক্ষমতা উরবান নামক এক হাঙ্গেরিয়ান বা কারো মতে জার্মান ব্যক্তির কারণে সম্ভব হয়। তার নকশা করা একটি কামানের দৈর্ঘ ছিল ২৭ ফুট এবং এটি প্রায় এক মাইল দুরে ছুড়ে মারতে পারত।

উসমানীয় নৌ বহরগুলো কয়েকবার চেষ্টার পরও যখন গোল্ডেন হর্নে (সুবর্ণ শৃঙ্গ বা ইস্তাম্বুল শহরের একটি জলপথ) প্রবেশ করতে পারছেনা তখন অভিনব বুদ্ধি দিয়ে চর্বি মাখানো কাঠের একটি রাস্তা তৈরীর আদেশ দেন। অর্থাৎ স্থল পথে নৌকা চালানোর অবিশ্বাস্য ঘটনা। নৌকাগুলোকে টেনে গোল্ডেন হর্নে নিয়ে যাওয়া হয়। ফলে বাইজানটাইনদের মনোবল ভেঙ্গে যায়। মুসলমানদের হাতে পতন হয় কনস্টান্টিনোপল। শুর হয় ইস্তাম্বুলের নতুন ইতিহাস।

মানব ইতিহাসে এরকম অসংখ্য বীরগাঁথা দেখা যায়। এ ধরনেরই একটি বিজয় হল কনস্টান্টিনোপল বিজয়। এই জয়ের মাধ্যমে সুলতান দ্বিতীয় মুহাম্মদ নিজের নামের সাথে মহাবিজয়ী পদবি ব্যবহার করেছেন। এই বিজয় তাকে সবচেয়ে স্মরণীয় করে রেখেছে। ১৪৫৩ সালে শহরটি জয়ের আগে আরো তিনটি অভিযান চলেছিল।

এক হাদিসে মহানবী সা. বলেন, ‘যে সেনাবাহিনী বিজয়ীর বেশে সকলের আগে কনস্টান্টিনোপলের সিংহদ্বারে উপনীত হবে, তারা আল্লাহর অসীম রহমতের অধিকারী হবে।’ ওই সৌভাগ্য লাভের জন্য মোয়াবিয়ার পুত্র ইয়াজিদ অভিযান শুরু করেছিল। নগর প্রাচীরের কাছে পৌছেও ভাগ্য অনুকূল হয়নি। উসমানীয় সুলতান বায়েজিদও বিজয়ের মুখ দেখতে পারেনি।

কনস্টান্টিনোপল জয়ের আগে থেকেই তুর্কিরা শহরটিকে নিজেদের বলে ভাবতো। রাজধানী করারও তীব্র আকাঙ্খা ছিল তাদের। সব উসমানীয় সুলতানই কনস্টান্টিনোপল জয়ের কথা বলতেন। মহানবী সা. এর ঘোষিত রহমত লাভের আগ্রহও কম ছিল না। এই শহরটি জয়ের প্রধান সমস্যা ছিল তার অবস্থান। ত্রিভুজাকৃতির শহরটি প্রাকৃতিকভাবেই সুরক্ষিত ছিল।

৩৩০ সালে রোমান সম্রাট কনস্টান্টাইন বসফরাস প্রণালীর উপকূলে নতুন রাজধানী স্থাপন করেন। নাম দেন নোভারোমা বা নতুন রোম। তবে কালের পরিক্রমায় তা হয়ে দাঁড়ায় কনস্টান্টিনোপল। ৩৯৫ খৃষ্টাব্দে পূর্ব ও পশ্চিম রোম সাম্রাজ্য নামে দুটি সাম্রাজ্যের সৃষ্টি হয়। পূর্ব রোমান সাম্রাজ্যের নাম হয় বাইজান্টাইন। কনস্টান্টিনোপল হয় তার রাজধানী।

দ্বিতীয় মুহাম্মদের আমলে কনস্টান্টিনোপলের সিংহাসনে ছিলেন কনস্টান্টাইন। প্রাকৃতিকভাবে সুরক্ষিত শহরটিকে অজেয় করার জন্য খৃষ্টীয় বাহিনী তাদের নৌযানগুলোকে এমনভাবে বিন্যস্ত করে যাতে কেবল একদিক থেকে আক্রমণ করা যায়। অন্যদিকে একটি সৈন্য মোতায়েন না করেও শহরটি রক্ষা করা যায়। এই কৌশল তাদেরকে দীর্ঘদিন নিরাপদ করে রেখেছিল।

সুলতানের রাজ্যের সাথে সংযুক্ত দিকটিও কম সুরক্ষিত ছিল না। সেখানে ১৪ মাইল দীর্ঘ তিন স্তর বিশিষ্ট উচুঁ দেয়াল এবং বাইরের মসৃণ দেয়ালের সাথেই ছিল ৭০ ফুট চওড়া ও ৪০ ফুট গভীর পরিখা। আক্রমণের সময় এটিকে পানি দিয়ে ভরে ফেলা হত। অন্যদিকে দেয়ালের ওপরে সশস্ত্র বাহিনী মোতায়েন থাকত। ফলে যে কোন আক্রমণই ৭০ ফুট দুরে থমকে যেত।

কনস্টান্টিনোপল জয় ছিল অপরিহার্য


সুলতান মুহাম্মদ জানতেন কনস্টান্টিনোপল জয়ের এটাই সবচেয়ে ভাল সময়। ‘আপেল পেঁকে আছে, কেবল একটি ঝাঁকুনি দিতে হবে’- সেই ঝাকুনিটা কে না দেয়! কনস্টান্টিনোপল জয় ছিল অপরিহার্য তাই যুদ্ধের আগে তিনি নিজের অবস্থান আরো মজবুত করে নেন। এক দুর্ভেদ্য দুর্গ গড়ে তোলেন। ১৪৫৩ সালের ৬ এপ্রিল অভিযান শুরু হয়।

মুহাম্মদ তার অভিযানে তখনকার সব উন্নতমানের প্রযুক্তি ব্যবহার করেন। তার বাহিনী যথেষ্ট শক্তিশালী থাকার পরও ইউরোপ থেকে বিশেষজ্ঞ আনা হয় বিভিন্ন বিষয় আঞ্জাম দেয়ার জন্য। এছাড়াও তিনি এমন কয়েকটি পদ্ধতি অনুসরণ করেন, যা ছিল সকলের কাছে অকল্পনীয়। যেমন চাকার সাহায্যে টেনে নেয়া যায় এমন এমন যুদ্ধ জাহাজ এবং তিনতলা বিশিষ্ট চলন্ত মিনার।

বিশেষ অভিযানের জন্য তুর্কিরা জাননেসারি বা অপ্রতিরোধ্য জানবাজ সেনাবাহিনী গঠন করেছিল। বিদ্যুৎ গতিতে আক্রমণ হানতে সক্ষম এই বাহিনীর উপস্থিতিতেই প্রতিপক্ষ ভীত হয়ে পড়ত। প্রচণ্ড আক্রমণেও যখন কনস্টান্টিনোপলের প্রতিরক্ষা দেয়াল ধ্বংস করা গেলনা, তখন চাকায় টানা যুদ্ধজাহাজ ব্যবহারের পরিকল্পনা করেন।

৮০ টি এই ধরনের যুদ্ধ জাহাজ কয়েক মাইল দুরের সমুদ্রে নিয়ে যাওয়া হয়। ফলে শহরটি একদিকের বদলে তিন দিক থেকেই আক্রমণের সুযোগ হয়। এত গোপনীয়তার সাথে এই কাজগুলি করা হয়েছিল যে তার উজিরে আযম পর্যন্ত জানতে পারেনি। একদিন উজিরে আযম এর উদ্দেশ্য জানতে চাইলে সুলতান দৃড়কণ্ঠে বলেছিলেন, আমার একটা দাঁড়িও সেকথা জানলে তা উপড়ে আগুনে ফেলে দিতাম।

৭০ ফুট দীর্ঘ পানিরাশিকে পাড়ি দেয়ার জন্য তিনি তিন তলা বিশিষ্ট মিনার ব্যবহার করেন। উপরের দুটি তলা থেকে গোলা বর্ষণের ফাঁকে নিচের তলার সৈন্যরা যাতে পানি ভেদ করে ওপারে যেতে পারে সেজন্য তিনি মিনারটি উদ্ভাবন করেন। নতুন নতুন যুদ্ধকৌশল ব্যবহার করে শত্রুকে অবাক করে দিতেন। যতক্ষণ না নগর রক্ষকরা নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে ফেলে।

৫৩ দিনের অক্লান্ত যুদ্ধের পর ২৯ মে অভিযান সম্পন্ন করেন। জনগণ যখন দেখল তাদের দেয়ালে দেয়ালে অটোমানদের পতাকা দোল খাচ্ছে এবং সৈন্যরা শহরে প্রবেশ করছে, তখন তার আশ্চর্য হয়ে গেল। সুলতান মুহম্মদ বিশাল বহর নিয়ে শহরে প্রবেশ করলেন। সেই সময় থেকেই তিনি ‘আল-ফাতিহ’ (বিজয়ী) হিসাবে পরিচিতি পান।

খৃষ্টান বাহিনীও তাদের দৃড়তা নিয়ে মুসলিম বাহিনীকে প্রতিহত করার চেষ্টা চালায়। সবদিক থেকে আক্রমণের ফলে নগরীর পতন ঘটে। ইউরোপের শ্রেষ্ট নগরী মুসলমানদের হাতে আসে। ইতিহাসে কনস্টান্টিনোপল জয় একটি অবিস্মরণীয় ঘটনা। মুসলমানরা এই প্রথম ইউরোপীয় কোন সাম্রাজ্যের রাজধানী জয় করতে সক্ষম হল।

এই পোস্টটি পরিচিতদের সাথে শেয়ার করুন

পরবর্তী পোস্ট দেখুন
এই পোস্টে এখনো কেউ মন্তব্য করে নি
মন্তব্য করতে এখানে ক্লিক করুন

অর্ডিনারি আইটির নীতিমালা মেনে কমেন্ট করুন। প্রতিটি কমেন্ট রিভিউ করা হয়।

comment url