একত্ববাদ ইসলামী আকিদা ও বিশ্বাসের প্রাণসত্তা

একত্ববাদ বা তাওহিদ বলতে ইসলাম ধর্মে এক আল্লাহর ধারণাকে বোঝায়। তাওহিদ হলো সৃষ্টি ও পরিচালনায় অল্লাহকে এক ও অদ্বিতীয় হিসাবে বিশ্বাস করা। অন্য সবকিছুর উপাসনা বাদ দিয়ে সকল ইবাদত সর্বশক্তির আধার অবশ্যম্ভাবী সত্তা, যিনি অনাদি অনন্ত সব সৃষ্টির খালিক ও মালিক কেবলমাত্র আল্লাহর জন্য।

একত্ববাদ ইসলামী আকিদা ও বিশ্বাসের প্রাণসত্তা

একত্ববাদ ইসলামী আকিদা ও বিশ্বাসের প্রাণসত্তা


আল্লাহ তাআলার গুণাবলি বিবেচনায় তাঁর বহু নাম রয়েছে। এসব গুণবাচক নামগুলিকে আসমাউল হুসনা বলা হয়। যে নামেই ডাকা হোক তিনি সাড়া দিবেন। আল্লাহকে বিশ্বাস করা মানেই তাঁর সত্তা ও গুণাবলিতে বিশ্বাস করা এবং সকল আদেশ ও নিষেধ মেনে নেয়া। ইসলামি বিশ্বাসের মৌলিক তিনটি বিষয় হলো তাওহিদ, রিসালত ও আখিরাত।

সব নবী রাসুল আ. গণের মধ্যে কালিমা বা তাদের প্রচারের মূলমন্ত্র ছিল একত্ববাদেরই মর্মবাণী- আল্লাহ ছাড়া কোন মামুদ নাই, মুহাম্মদ সা. আল্লাহর মনোনীত নবী ও রাসূল। কালিমার দ্বিতীয় অংশ রিসালাতে শেষ নবি হজরত মুহাম্মদ সা. এর আগমনের পূর্ব পর্যন্ত যুগে যুগে পরিবর্তন হয়েছে, কিন্তু কালিমার প্রথম অংশ তাওহিদ তথা আল্লাহর সত্তা ও গুণাবলিতে কোনরূপ পরিবর্তন নাই।

একত্ববাদ ইসলামী আকিদা ও বিশ্বাসের প্রাণসত্তা। সকল নবী-রাসুল একত্ববাদের প্রচার করেছেন। এ ক্ষেত্রে শুধু মৌখিক স্বীকৃতিই যথেষ্ট নয় বরং আল্লাহর প্রতি বান্দার আস্থা, ভালোবাসা ও বিশ্বাসের বিষয়টিও জড়িত এবং সেই সাথে আল্লাহর সন্তষ্টি কামনা করে। তিনি সবক্ষেত্রে পূর্ণতার অধিকারী। বিশ্ব পরিচালনায় তার কোন সমকক্ষ নাই।

আল্লাহর একত্ববাদে বিশ্বাস করা মুসলমান হওয়ার জন্য অপরিহার্য। ইসলাম সবসময় মানুষকে একত্ববাদের দিকেই আহ্বান করে আসছে। এ জগত একমাত্র এই শক্তিতেই টিকে আছে। মানব ইতিহাস আরম্ভ হয়েছিল এই বিশ্বাসের আলোকে। তখন শিরক বলতে কিছুই ছিল না। আর এ ধারাই সব নবী-রাসুল তাদের প্রচারের মাধ্যমে অব্যাহত রেখেছেন।

আর সমগ্র মানব জাতি একত্ববাদের উপর বিশ্বাস স্থাপন করেছিল। তিনি নভোমণ্ডল ও ভূমন্ডলের সব কিছুর স্রষ্টা। যা কিছু সৃষ্টি হয়েছে এবং ভবিষ্যতে হবে সমস্ত সৃষ্টির একচ্ছত্র অধিকারী আল্লাহ। তিনি বিশ্বজগতের একক স্রষ্টা ও পালনকর্তা। যদিও পরবর্তীকালে মানুষ শয়তানের কুমন্ত্রণায় পড়ে একাধিক প্রভূতে বিশ্বাসী হয়ে পড়ে।

আল্লাহ বলেন- ‘ হে মানুষ! একটি উপমা বর্ণনা করা হলো। মনোযোগ দিয়ে তা শোনো তোমরা আল্লাহর পরিবর্তে যাদের আহ্বান করো তারা তো কখনো একটি মাছিও সৃষ্টি করতে পারবেনা। যদিও তারা সবাই এ উদ্দেশে একত্রিত হয়। আর মাছি যদি তাদের কাছ থেকে কোনো কিছু ছিনিয়ে নেয় তবুও উদ্ধার করতে পারবেনা। প্রার্থনাকারী ও যার কাছে প্রার্থনা করা হয় উভয়ই দুর্বল। তারা আল্লাহর যথাযথ মর্যাদা বোঝেনি। নিশ্চয়ই আল্লাহ ক্ষমতাবান ও পরাক্রমশালী। (সুরা হজ- ৭৩-৭৪)

প্রাকৃতিক বা স্বভাবগতভাবে এ পৃথিবীর প্রতিটি মানুষই আল্লাহকে স্বীকার করে। কেউ সৃষ্টিকর্তা হিসাবে, কেউ রিজিকদাতা হিসাবে, কেউ প্রকৃতি হিসাবে, কেউ বা মহাবিশ্বের নিয়ন্ত্রক হিসাবে বিশ্বাস করে। আর এ বিশ্বাস জীবনের কোন এক সময়ে অন্তরে বদ্ধমূল হয়। এ পৃথিবীতে বেশিরভাগ মানুষই বিশ্বাসী। তারা তাদের ধর্ম কর্মের মধ্য দিয়ে আল্লাহকে বিশ্বাস করে।

মানুষের অন্তরে যে অধ্যাত্মিক জ্যোতি আছে সেটাই তাকে এক পরাক্রমশালী শক্তির সন্ধান দেয়। মানুষের আত্মা আল্লাহর কাছ থেকে আগত বিধায় এ আত্মা আল্লাহর দিকেই ধাবিত হয়। মানুষের এ প্রবণতাই আল্লাহর একত্বের একটি প্রমাণ বিশেষ। আল্লাহ বলেন- তুমি যদি তাদের জিজ্ঞাসা করো, কে নভোমণ্ডল ও ভূমণ্ডল সৃষ্টি করেছে? তারা অবশ্যই বলবে এগুলো তো মহাপরাক্রমশালী আল্লাহই সৃষ্টি করেছেন। (সুরা জুখরুফ-৯)

একত্ববাদ ও পৌত্তলিকতা বা শিরক


একত্ববাদ বা তাওহিদের বিপরীত হলো শিরক। শিরক অর্থ শরিক বা অংশীদার স্থির করা। ইসলামে শিরক হলো আল্লাহ ব্যতীত অন্য কারো উপাসনা করা। সাধারণত বিভিন্ন মূর্তি, পাথর, গাছ, নক্ষত্র, ফেরেশতা, জ্বিন, বস্তু ও জীবের ইবাদত বা উপাসনা করা। এসব উপাস্যকে ভয়-ভীতি, আশা-আকাঙ্খা ও বিপদে তাদের সাহায্য প্রর্থনা করাই শিরকের অন্তর্ভুক্ত।

শিরক একটি অমার্জনীয় অপরাধ। যেন নিজের অজান্তে ইবলিসের জালে আটকে না যায়। মানুষের ইবাদতের একমাত্র অধিকারী আল্লাহ। যিনি সমগ্র জাহানের স্রষ্টা তিনিই তো স্তুতি পাওয়ার যোগ্য। কথায় কিংবা কাজে মৌখিক বা মৌন কোনভাবেই অন্যের ইবাদত নয়। কুরআনের ঘোষণা- তোমরা শুধুমাত্র আল্লাহর ইবাদত করো এবং তার সাথে কোনো কিছুকে শরিক করো না। (নিসা-৩৬)

পৌত্তলিকতা শব্দের অর্থ পুতুল পূজা। যদিও সনাতনীরা নিজেদের পৌত্তলিক ও দেবতাদের প্রতিমূর্তিকে পুতুল বলে মনে করে না। প্রতিক উপাসনা যদিও অন্যান্য সকল প্রচলিত ধর্মের সাধারণ বৈশিষ্ট্য। পৌত্তলিকতাবাদ বা ইংরেজি Paganism একটি শব্দ, যার অর্থ খৃস্টীয় দৃষ্টিভঙ্গিতে দেখলে দাঁড়ায় ইব্রাহিমীয় ধর্মমত বহির্ভূত সংস্কৃতির কিছু আত্মিক ও সামাজিক আচার বিশ্বাস।

ইসমাইল (আ.) এর বংশধররা দীর্ঘদিন পর্যন্ত একত্ববাদ ও ইব্রাহিম (আ.) এর ধর্মাদর্শের ওপর অটল ছিল। কিন্তু পরবর্তীতে তারা পৌত্তলিকতার প্রতি ঝুঁকে যায়। ইসলাম আগমনকালে সমগ্র আরব ছিল পৌত্তলিকতায় অচ্ছন্ন। তবে স্বল্পসংখ্যক মানুষ একত্ববাদের ওপর অটল ছিল এবং তাদের দৈনন্দিন জীবনে তখনো ইব্রাহিমী ধর্মের রীতি অক্ষুন্ন ছিল।

আরবে পৌত্তলিকতা ছড়ায় যে ভাবে


আরব উপদ্বীপে পৌত্তলিকতা ছড়ায় দুই ভাবে। এক. কালক্রমে ইব্রাহিমী ধর্ম থেকে আরবদের সরে যাওয়া, দুই. বহিরাগতদের প্রভাব। আরব জাতির জন্য কাবা ছিল সম্মান ও সম্ভ্রমের প্রতীক। এই ঘরকে কেন্দ্র করে আরব সভ্যতার জন্ম হয়েছিল এবং ইসমাইল (আ.) এর বংশধররা আরব ভূখণ্ডে অনন্য মর্যাদা লাভ করেছিল। কাবার সম্মান প্রদর্শনে তাওয়াফের প্রচলন হলো।

মক্কা থেকে পাথর সংগ্রহ করে ইব্রাহমি ও ইসমাইল (আ.) এর মূর্তি তৈরি করে পূজা করতে শুরু করে। এভাবেই আরব সমাজে পৌত্তলিকতার প্রবণতা তৈরি হয়েছিল। আরব ঐতিহাসিকরা পৌত্তলিকতার প্রবর্তক হিসাবে আমর বিন লুহাই খুজায়ির নাম উল্লেখ করেন। তিনি তার ধর্মীয় ও ব্যক্তিগত বিচক্ষণতার দ্বারা কাবার পরিচালনা পর্ষদে অন্তর্ভূক্ত হয়। সে শাম থেকে মূর্তি এনে কাবা চত্বরে স্থাপন করে।

সেই প্রথম ব্যক্তি যে দেবতার নামে পশু উৎসর্গ করার প্রথা প্রচলন করে। সেই প্রথম ইব্রাহীম (আ.) এর দ্বিন বিকৃত করেছে। মহানবী সা. এর আগমনকালে আরবের প্রধান ধর্মাচার ছিল পৌত্তলিকতা। মক্কা বিজয়ের পর কাবা ঘর ও তার চত্বর থেকে ৩৬০ টি মূর্তি অপসারণ করা হয়। কাবা ঘরের ভিতরে ইব্রাহীম (আ.) এর একটি মূর্তি ও কবুতরের মূর্তিও সরানো হয়।

সুকৌশলে সব আদর্শে ভর করে


পৌত্তলিকতা শুধু ধর্মীয় বিষয় নয় এটা সুকৌশলে সব আদর্শে ভর করে। এর সুবিধা হল ভগবানকে একটা নিরেট জড় বস্তুতে বন্দী করে মনের খায়েশ গুলোকে ধর্ম বাণী বলে প্রচার করা। পৌত্তলিকতায় যাযকই হন ইশ্বর। যুগে যুগে নিপিড়ন মুলক শাসনের সব চেয়ে বড় হাতিয়ার হয়ে আসছে এই পৌত্তলিকতা। নিজের শাসন প্রতিষ্ঠায় এট একটা বড় হাতিয়ার।

কোন বিশেষ আদর্শের উপর ভর করে মানুষ সংগ্রামে ঝাপিয়ে পড়ে । সেই সংগ্রামে থাকে ইমোশন। চতুর শাসকদল সময়ের সাথে সাথে গায়েব করে দেয় সেই ইতিহাস। সামনে নিয়ে আসে যোদ্ধাদের মূর্তি আর ছবি। মৃত যোদ্ধার বোবা মূর্তির পাশে দাঁড়িয়ে তারা নিজের মর্জিকেই চেতনা বলে চালাতে থাকে। তার বিরুদ্ধে যাওয়া মানেই চেতনার বিরুদ্ধে যাওয়া।

পৃথিবীতে যত মূর্তির ইবাদত করা হয় তার অধিকাংশই অশ্লিল নারী আকৃতি। সাফা পর্বতে ইসাফ এবং মারওয়া পর্বতে নায়েলা নামের দুটি মূর্তি ছিল। যাদের মানুষ দেবতা হিসাবে পূজা করত। কাবার ভিতরে ব্যভিচারের শাস্তি হিসাবে আল্লাহ পাথরের আকৃতিতে তাদের বিকৃত করে দিয়েছেন। কালক্রমে মানুষ তাদেরই ইবাদত শুরু করে।

পৌত্তলিকতার শুরু হয় ধর্ম গুরুর মূর্তি তৈরী করে উপাসনার মাধ্যমে। অথচ কোন ধর্ম প্রচারকই নিজের মূর্তি বানিয়ে উপাসনা করেন নি বা করতে বলেছেন এমনও শোনা যায়না। অন্য সব ধর্মেরই উৎসবের দিন ধর্মগুরুর জন্মদিন না হয় মৃত্যুদিন উপলক্ষে হয়। শুধু ব্যতিক্রম ইসলাম। মহানবী সা. তাঁর জন্ম বা মৃত্যু নিয়ে কোন উদযাপন করতে বলেন নি।

ইসলাম আগমনের পূর্বে মক্কার শাসনের ভিত্তি ছিলো ধর্ম। আবু লাহাব আর আবু জেহেল ঈশ্বরের মনোনিত পুরুষ এবং কাবার রক্ষক বলে প্রচার করত। গোত্র প্রধানদের বৈষম্য আর জুলুম মানিয়ে নেয়ার জন্য হুবাল, আল লাত, আল উজ্জার মত পাথুরে দেবতাদের আজাবের ভয় দেখানো হয়। ইসলাম কায়েমের পর রাসুল সা. এই সব ভয় মূর্তি ভেঙ্গে মাটি চাপা দিয়ে দেন।

যিনি সৃষ্টি করেন তিনিই কেবল স্রষ্টা হতে পারেন। মানুষের সৃষ্ট মূর্তি কিভাবে স্রষ্টা হয় সে সম্পর্কে ভাবা উচিত। ছোট বা বড় কোন মূর্তিই কোনো কিছু তৈরি করতে পারে না। যে সব মূর্তির উপাসনা মানুষ করে তারা তো নিজের নাকের উপর মাছিও তাড়াতে পারে না। যারা এতটাই দুর্বল তারা মানুষের কোন উপকার বা ক্ষতি কোনটাই করতে পারে না।

এই পোস্টটি পরিচিতদের সাথে শেয়ার করুন

পূর্বের পোস্ট দেখুন পরবর্তী পোস্ট দেখুন
এই পোস্টে এখনো কেউ মন্তব্য করে নি
মন্তব্য করতে এখানে ক্লিক করুন

অর্ডিনারি আইটির নীতিমালা মেনে কমেন্ট করুন। প্রতিটি কমেন্ট রিভিউ করা হয়।

comment url