বৃটিশ সাম্রাজ্য পৃথিবীর সবচেয়ে বড় সাম্রাজ্য ও বিশ্বশক্তি

যখন কোন একটি দেশ বা রাজা একাধিক দেশ বা রাজ্যের শাসনযন্ত্র নিজের হাতে নিয়ে কর্তৃত্ব খাটায় তখন তাকে সাম্রাজ্য বলে ধরা হয়। বৃটিশ সাম্রাজ্যের আয়তন ছিল প্রায় সারা প্রথিবীর এক-পঞ্চমাংশের বেশি। জনসংখ্যা ছিল পৃথিবীর মোট জনসংখ্যার ২৩ শতাংশ। আর রাজত্ব করেছিল প্রায় চারশো বছর।পৃথিবীর ২০০টি দেশের মধ্যে ১৭১টি দেশই ছিল বৃটিশ সাম্রাজ্যের অন্তর্ভুক্ত।

বৃটিশ সাম্রাজ্য পৃথিবীর সবচেয়ে বড় সাম্রাজ্য ও বিশ্বশক্তি

বৃটিশ সাম্রাজ্য পৃথিবীর সবচেয়ে বড় সাম্রাজ্য ও বিশ্বশক্তি


বৃটিশ সাম্রাজ্য হচ্ছে যুক্তরাজ্যের অধীন বা যুক্তরাজ্য কর্তৃক প্রশাসিত এলাকার সমষ্টি। ১৬ শতকের শেষ থেকে এবং ১৮ শতকের প্রথম ‍দিক পর্যন্ত ইংল্যান্ড বিদেশে দখলকৃত এবং বাণিজ্য কেন্দ্রগুলো শক্তিশালী ছিল। বৃটিশ সাম্রাজ্য পৃথিবীর ইতিহাসে সবচেয়ে বড় সাম্রাজ্য ছিল এবং এক শতাব্দী ধরে সর্বাগ্রে বিশ্বশক্তি ছিল। এটি ‘এমন সাম্রাজ্য যার উপর সূর্য কখনও অস্ত যায় না’ হিসাবে বর্ণনা করা হয়েছিল, কারন সূর্য সর্বদা এর অন্তত একটি অঞ্চলে দেখা যেত।

বৃটিশ সাম্রাজ্যের মধ্যে ছিল স্বশাসিত উপনিবেশ, অধিরাজ্য, ম্যান্ডেট এবং এ ধরনের অন্যান্য এলাকা। ভারত, আমেরিকা প্রভৃতি বিভিন্ন দেশ এই বৃটিশ সাম্রাজ্যের অধীনে ছিল। এই বৃটিশ সাম্রাজ্যের সূচনা হয় ষোড়শ শতকের শেষ দিকে। এই সময়ে ১৭০৭ সালে স্কটল্যান্ড ইংল্যান্ডের সাথে যুক্ত হয়, তারপর, তারপর ১৮০১ সালে আয়ারল্যান্ড যুক্ত হয়ে যুক্তরাজ্য গঠিত হলো।

পরে ১৯২২ সালে অবশ্য আয়ারল্যান্ড আলাদা স্বাধীনতা ঘোষণা করে এবং আইরিশ ফ্রি স্টেট নামে পরিচিত হয়। ষোড়শ শতকের শেষ থেকে অষ্টাদশ শতকের প্রথম দিক পর্যন্ত ইংল্যান্ডের অধিকৃত দেশ এবং বাণিজ্য কেন্দ্রগুলি ছিল শক্তিশালী। তার প্রধান কারন বৃটিশে অফুরন্ত অর্থ ভান্ডার। তার কলোনির যথেচ্ছ কাঁচামাল এবং প্রাকৃতিক খনিজ ও বনজ সম্পদের ব্যবহার ও অর্থ সংগ্রহে বৃটিশ কোষাগার পরিপূর্ণ।

ভারতীয় জনতা ও ভূখন্ড, যা ছিল বৃটিশ সাম্রাজ্যের অন্তর্ভুক্ত সেটা বৃটিশ রাজা বা রাণীর এক্তিয়ারভূক্ত। এই অবস্থা ভারতের ক্ষেত্রে হল ১৮৭৬ থেকে ১৯৪৭ সাল পর্যন্ত। আবার প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পর লীগ অব নেশন আ্যাংলো-ইজিপশিয়ান সুদান ভূখন্ড বৃটিশ সাম্রাজ্যের অধীনে ম্যান্ডেট হিসাবে দিয়েছিল। ভারত ও পাকিস্থান অধিরাজ্য ১৯৪৭ সালে স্বাধীনতা লাভ করে।

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর বৃটিশ সাম্রাজ্যের পতন শুরু হয়। হংকং ১৯৯৭ সাল পর্যন্ত বৃটিশ শাসনাধীন ছিল। এখনও কয়েকটি অঞ্চল বৃটিশ সাম্রাজ্যের অধীনে। অস্ট্রেলিয়া, নিউজিল্যান্ড ও কানাডা এখনো কুইন এলিজাবেথকে তাদের দেশ প্রধান হিসাবেই ধরে।

১৫ এবং ১৬ শতকে পর্তুগাল ও স্পেন বৃহৎ সাম্রাজ্য প্রতিষ্ঠা করেছিল। এই সাম্রাজ্যগুলি যে বিপুল সম্পদ তৈরি করেছিল তার জন্য ঈর্ষান্বিত হয়ে ইংল্যান্ড নিজস্ব উপনিবেশ এবং বাণিজ্য নেটওয়ার্ক স্থাপন করতে শুরু করে। ১৭৫৭ সালে পলাশীর যুদ্ধে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির মুঘল বাংলা বিজয়ের পর বৃটেন ভারতীয় উপমহাদেশের একটি প্রধান শক্তিতে পরিণত হয়।

ভারতে অবিরাম বিজয়


ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি হায়দার আলীর অধীনে মহীশুর সালতানাতের সাথে এবং তারপর টিপু সুলতানের সাথে দক্ষিণ ভারতে আ্যংলো-মহীশুর যুদ্ধের একটি সিরিজ লড়েছিল। প্রথম আ্যাংলো-মহীশুর যুদ্ধে পরাজয় এবং দ্বিতীয়টিতে অচলাবস্থার পর তৃতীয় এবং চতুর্থ যুদ্ধে জয়লাভ করা হয়। চতুর্থ যুদ্ধে টিপু সুলতানের মৃত্যুর পর রাজ্যটি কোম্পানির একটি সংরক্ষিত রাজ্যে পরিণত হয়।

ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি মারাঠা কনফেডারেসির সাথে তিনটি আ্যংলো-মারাঠা যুদ্ধ করেছিল। প্রথম আ্যাংলো-মারাঠা যুদ্ধ ১৭৮২ সালে যুদ্ধ-পূর্ব স্থিতাবস্তা পুনরুদ্ধারের মাধ্যমে শেষ হয়। দ্বিতীয় এবং তৃতীয় আ্যাংলো-মারাঠা যুদ্ধের ফলে বৃটিশ বিজয় হয়। ১৮১৮ সালে দ্বিতীয় পেশওয়া বাজিরাও এর আত্মসমর্পনের পর ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি ভারতীয় উপমহাদেশের নিয়ন্ত্রণ অধিগ্রহণ করে।

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় এবং পরে সাম্রাজ্যের পতন


আমেরিকান স্বাধীনতা যুদ্ধের ফলে বৃটেন ১৭৮৩ সালের মধ্যে উত্তর আমেরিকায় তার কিছু প্রাচীন এবং জনবহুল উপনিবেশ হারায়। বৃটিশ উত্তর আমেরিকা এবং বৃটিশ ওয়েস্ট ইন্ডিজে ক্যারিবিয়ান এবং তার কাছাকাছি অঞ্চলগুলির নিয়ন্ত্রণ বজায় রাখার সময়, বৃটিশ ঔপনিবেশিক সম্প্রসারণ এশিয়া, আফ্রিকা ও প্রশান্ত মহাসাগরের দিকে ঘুরছে।

নেপোলিয়নিক যুদ্ধে ফ্রান্সের পরাজয়ের পর বৃটেন ১৯ শতকের প্রধান নৌ ও সাম্রাজিক শক্তি হিসাবে আবির্ভূত হয় এবং তার সাম্রাজ্যের অধিকারকে প্রসারিত করে। বৃটেন তার উপনিবেশগুলির উপর যে আনুষ্ঠানিক নিয়ন্ত্রণ প্রয়োগ করেছিল, তার বেশিরভাগ বিশ্ব বাণিজ্য এবং তার মহাসাগরগুলির উপর তার আধিপত্যের অর্থ হল যে এটি কার্যকরভাবে এশিয়া এবং ল্যাটিন আমেরিকার মতো অনেক অঞ্চলে তার স্বার্থগুলিকে কার্যকরভাবে নিয়ন্ত্রণ করেছিল এবং সহজেই প্রয়োগ করেছিল।

এটি মধ্যপ্রাচ্যেও আধিপত্য বিস্তার করে। বৃটেন এবং জার্মানির মধ্যে সামরিক, অর্থনৈতিক এবং ঔপনিবেশিক উত্তেজনা ছিল প্রথম বিশ্বযুদ্ধের প্রধান কারন, যে সময়ে বৃটেন তার সাম্রাজ্যের উপর অনেক বেশি নির্ভর করে।

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে, পূর্ব এশিয়া এবং দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ায় বৃটেনের উপনিবেশগুলি জাপান সাম্রাজ্য দ্বারা দখল করা হয়েছিল। বৃটেন এবং তার মিত্রদের চূড়ান্ত বিজয় সত্বেও বৃটিশ প্রতিপত্তি এবং বৃটিশ অর্থনীতির ক্ষতি সাম্রাজ্যের পতনকে ত্বরান্বিত করতে সাহায্য করেছিল। ভারত একটি বৃহত্তর উপনিবেশকরণ আন্দোলনের অংশ হিসাবে ১৯৪৭ সালে স্বাধীনতা অর্জন করে যেখানে বৃটেন সাম্রাজ্যের বেশিরভাগ অঞ্চলকে স্বাধীনতা দেয়।

১৯৫৬ সালের সুয়েজ সংকট বিশ্বশক্তি হিসাবে বৃটেনের পতন নিশ্চিত করে। ১৯৯৭ সালে হংকং চীনের কাছে হস্তান্তর বৃটিশ সাম্রাজ্যের অনেক সমাপ্তির প্রতীক। যদিও সাম্রাজ্যে আরো ১৪ টি বিদেশী অঞ্চল বৃটিশ সার্বভৌমত্বের অধীনে রয়েছে। স্বাধীনতার পর অনেক প্রাক্তন উপনিবেশ রাষ্ট্রগুলি একটি মুক্ত সংস্থা কমনওয়েলথ অফ নেশনস এ যোগ দেয়। ইউনাইটেড কিংডম সহ এর মধ্যে ১৫ টি রাজার মত একই ব্যক্তিকে ধরে রেখেছে।

বৃটিশ সাম্রাজ্যের পাঁচটি বর্বরতম নৃশংসতা


১৯২২ সালে বৃটিশ সাম্রাজ্য যখন চুড়ান্ত পর্যায়ে ছিল তখন বিশ্ব জনসংখ্যার এক পঞ্চমাংশের উপর কর্তৃত্ব করত এবং এক চতুর্থাংশ ভূমি তাদের দখলে ছিল। সাম্রাজ্যের সমর্থকরা বলে আসছেন, বিশ্বব্যাপী উপনিবেশ গুলোতে নানা ধরনের অর্থনৈতিক উন্নতি সাধন করেছে। অন্যদিকে সমালোচকদের মতে বৃটিশরা গণহত্যা, সম্পদ পাচার, দুর্ভিক্ষ এবং নির্যাতন-নিপীড়নের মতো ঘৃন্য সব ঘটনা ঘটিয়েছে।

১. আফ্রিকায় বোয়ের বন্দীশালা
দক্ষিণ আফ্রিকা ও সেয়াজিল্যান্ডে সংঘটিত দ্বিতীয় বোয়ের যুদ্ধ (১৮৯৯-১৯০২) চলাকালে বৃটিশরা বোয়ের জনসংখ্যার প্রায় এক ষষ্ঠাংশক অর্থাৎ প্রায় ১ লাখ ৭ হাজার মানুষকে একটি বন্দীশালায় বন্দী করে রাখে। বন্দীদের মধ্যে বেশিরভাগই ছিল নারী ও শিশু। খাদ্যের অভাব ও রোগ ব্যধীতে প্রায় ২৮ হাজার বন্দীর মৃত্যু হয়। অসংখ্য কালো আফ্রিকানদেরও মৃত্যু হয়।

২. অমৃতসর গণহত্যা
১৯১৯ সালের ১৩ এপ্রিল ভারতের অমৃতসরে শান্তিপূর্ণ একটি বিক্ষোভে গুর্খা সেনারা গুলি চালিয়ে প্রায় এক হাজার মানুষকে হত্যা করে। মাত্র ১০ মিনিটের এই বর্বর হামলায় আহত হন আরও অন্তত ১১০০ মানুষ।

৩. ভারত ও পাকিস্থান রাষ্ট্র সৃষ্টি
১৯৪৭ সালে মাত্র এক বেলা খাবার খাওয়ার মত খুব অল্প সময়ে ভারত ও পাকিস্থান রাষ্ট্রের সীমানা ভাগ করেছিলেন। এরপর হিন্দু ও মুসলিমদের সাম্প্রদায়িক দাঙ্গায় প্রায় ১ কোটিরও বেশি মানুষ ঘরবাড়ি ছাড়তে বাধ্য হয়। এই দাঙ্গায় অন্তত ১০ লাখ মানুষের প্রাণ হারায়।

৪. মাউ মাউ বিদ্রোহ
১৯৫১-১৯৬০ সালে কেনিয়ার মাউ মাউ বিদ্রোহ দমনের সময় বৃটিশরা কেনিয়ার অন্তত ২০ হাজার থেকে ১ লাখ মানুষকে হত্যা করে। এ সময় ধর্ষণ ও বন্দীশালায় নির্যাতন চালিয়েও অসংখ্য মানুষকে হাত্যা করা হয়। পরবর্তীতে কেনিয়া ক্ষতিপূরণ হিসাবে ২০০ মিলিয়ন পাউন্ড দাবি করেছিল।

৫. ভারতবর্ষে দুর্ভিক্ষ
বৃটিশ সাম্রাজ্যের সময় ভারতে প্রায় ১ কোটি ২০ লাখ থেকে ২ কোটি ৯০ লাখ মানুষ দুর্ভিক্ষে মারা যায়। অথচ একই সময়ে ভারত থেকে বছরে লাখ লাখ টন গম পাচার হত বৃটেনে। ১৯৪৩ সালে বাংলায় যে ভয়াবহ দুর্ভিক্ষ হয়েছিল তাতেই শুধু মারা যায় ৪০ লাখ মানুষ। একই সময়ে বৃটিশ প্রধানমন্ত্রী উইনস্টন চার্চিল বাংলায় উৎপাদিত খাদ্যশস্য বৃটিশ সেনা ও গ্রিকদের জন্য পাঠানোর আদেশ দেন।

উইনস্টন চার্চিল বাংলার ওই দুর্ভিক্ষ সম্পর্কে বলেছিলেন, আমি ভারতীয়দের ঘৃণা করি। কারন তারা মানুষ নয়, পশুর মতো। আর তাদের ধর্মও পাশবিক। এই দুর্ভিক্ষের জন্য তারাই দায়ী। কারন খড়গোসের মত অসংখ্য সন্তান জন্ম দিয়ে দ্রুত জনসংখ্যা বাড়ানোর ফলেই খাদ্যের অভাবে এই দুর্ভিক্ষ দেখা দিয়েছে।

এই উপমহাদেশে বৃটিশ সাম্রাজ্য প্রায় ১৯০ বছর শাসন করেছে। এর ফলে এখানকার মানুষদের মধ্যে সামাজিক, রাজনৈতিক, ধর্মীয় ও অর্থনৈতিক এবং অবকাঠামোগত উন্নয়নে ব্যাপক পরিবর্তন সাধিত হয়। এর ফলে মানুষের চিন্তায় কর্মে বিভিন্ন ধরনের প্রভাব পরিলক্ষিত হয়।

এই পোস্টটি পরিচিতদের সাথে শেয়ার করুন

পূর্বের পোস্ট দেখুন পরবর্তী পোস্ট দেখুন
এই পোস্টে এখনো কেউ মন্তব্য করে নি
মন্তব্য করতে এখানে ক্লিক করুন

অর্ডিনারি আইটির নীতিমালা মেনে কমেন্ট করুন। প্রতিটি কমেন্ট রিভিউ করা হয়।

comment url