মুঘল সাম্রাজ্য এই উপমহাদেশের সবচেয়ে বড় মুসলিম শাসনকাল।

মুঘল সাম্রাজ্য ছিল উপমহাদেশের বিশাল অঞ্চল জুড়ে পরিব্যাপ্ত প্রাক আধুনিক যুগের একটি মুসলিম শাসিত এলাকা। দীর্ঘকাল মুঘলদের শাসনের ফলে সংস্কৃতি, পোষাক, ভাষা, খাবার, স্থাপত্যে ইতিবাচক পরিবর্তনের সূচনা হয়। মুঘল সাম্রাজ্য ছিল প্রধানত পারস্য ও মধ্য এশিয়ার ভাষা , শিল্প ও সংস্কৃতি দ্বারা প্রভাবিত ভারত উপমহাদেশের একটি সাম্রাজ্য। এর ফারসি নাম ‘গুলকারনিয়ান’ আর উর্দু নাম ‘মোঘলিয়া সালতানাত' ।

মুঘল সাম্রাজ্য এই উপমহাদেশের সবচেয়ে বড় মুসলিম শাসনকাল

মুঘল সাম্রাজ্য এই উপমহাদেশের সবচেয়ে বড় মুসলিম শাসনকাল।


ভারতবর্ষের জনপদ বহুকাল ধরে দেখেছে অনেক শাসকের শাসন। মৌর্জ ও বৃটিশ সাম্রাজ্যের পর মুঘল সাম্রাজ্য এই উপমহাদেশের সবচেয়ে বড় মুসলিম শাসনকাল। মুঘল সাম্রাজ্যের সীমানা বর্তমান বাংলাদেশ-ভারত-পাকিস্থান-আফগানিস্থান পর্যন্ত বিস্তৃত। নানান চড়াই উতরাই পেরিয়ে সেসব শাসকের শাসনামলে মানুষের জীবনে এসেছে ঘাত প্রতিঘাত আর সোনালী সময়। খৃস্টের জন্মের পর সবচাইতে বেশি সময় ধরে ভারতবর্ষ শাসন করে গেছে যে তিন সাম্রাজ্য সেগুলোর মধ্যে মুঘল সাম্রাজ্যের প্রভাব প্রতিপত্তির কথা আজো মানুষ বিস্ময়ের সাথে স্মরণ করে।

পানিপথের প্রথম যুদ্ধে ইব্রাহিম লোদির প্রায় লক্ষাধিক সৈন্যের বিরুদ্ধে মাত্র হাজার বারো সৈন্য নিয়েই অভিনব রণকৌশল ও দক্ষতায় বাবরের জয়ের মাধ্যমে মুঘল সাম্রাজ্যের সূচনা হয়। এরই মাধ্যমে দিল্লী ও আগ্রা বাবরের অধীনে চলে আসে। উজবেকিস্থানের ফরগনা রাজ্যে জন্ম নেয়া জহিরুদ্দীন মুহম্মদ বাবরের পিতা ছিলেন সেই রাজ্যেরই অধিপতি।

কম বয়সে পিতাকে হারিয়ে মাত্র ১২ বছর বয়সেই ফরগনা রাজ্যের সিংহাসনে বসেন। মুঘল বাদশা বা সম্রাটরা ছিলেন মধ্য এশিয়ার তুর্কো-মঙ্গোল বংশোদ্ভূত। বাবার দিক থেকে তিনি তৈমুর লং ও মায়ের দিক থেকে চেঙ্গিস খানের বংশধর। ১৫২৬ সালে আকবর সিংহাসনে বসার মাধ্যমে মুঘল সাম্রাজ্যের যুগ শুরু হয়।

আকবর ও তার ছেলে জাহাঙ্গীর অনেক হিন্দু রাজাদের সাথে মিত্রতা করেন এবং উত্তর ও পশ্চিম ভারতে কিছু বিদ্রোহী রাজাদের বশীভূত করে সাম্রাজ্যের অর্থনৈতিক প্রগতি বহুদুর অগ্রসর করেন। বিভিন্ন ধর্মীয় সম্প্রদায়ের মধ্যে পার্থক্য দুর করার জন্য মুসলিম হয়েও জীবনের শেষের দিকে নতুন ধর্ম দীন-ই-ইলাহি নামক নতুন ধর্ম তৈরি করেন। তবে এই ধর্ম প্রসিদ্ধ হয়নি।

বাবর মধ্য এশিয়া থেকে বিতাড়িত হয়ে ভারতে ভাগ্য নির্মাণে নিয়োজিত হন। তিনি নিজেকে কাবুলের শাসক হিসাবে প্রতিষ্ঠা করেন। আফগানিস্থান থেকে খাইবার পাস হয়ে ভারতে প্রবেশ করেন। পানিপথের যুদ্ধে বিজয়ের পর বাবরের সেনাবাহিনী উত্তর ভারতের অধিকাংশ এলাকা জয় করে নেয়।

বাবুরের মৃত্যুর পর তার জেষ্ট পুত্র নাসিরুদ্দীন মুহম্মদ হুমায়ন পিতৃ সিংহাসনে বসেন। সেনাপতি শেরশাহ কর্তৃৃক ক্ষমতাচ্যুত হয়ে ভারত থেকে পারস্যে পালিয়ে যান। সেখানে কুটনৈতিক সম্পর্ক গড়ে তুলেন। পারস্যের সাফাভিদের সহায়তায় ক্ষমতা পুণঃপ্রতিষ্ঠা করেন। হুমায়নের সময় অস্থিতিশীলতা ছড়িয়ে পড়ে। কিছুকাল পর এক দুর্ঘটনায় হুমায়নের মৃত্যু হয়।

হুমায়নের পুত্র আকবর অল্প বয়সেই সিংহাসনে বসেন। আকবরের অভিভাবক বৈরাম খান মুঘল সাম্রাজ্যের ভিত্তি মজবুত করতে আকবরকে সহায়তা করেছেন। যুদ্ধ ও কুটনীতির মাধ্যমে আকবর সাম্রাজ্যকে সবদিকে ছড়িয়ে দিতে সক্ষম হন। তার প্রতি অনুগত নতুন এক অভিজাত শ্রেণী গড়ে তুলেন। তিনি উন্নত সরকার ব্যবস্থা ও সংস্কৃতি উন্নয়নে অবদান রাখেন। ইউরোপীয়দের সাথে বাণিজ্য বৃদ্ধি করেন।

আকবরের মৃত্যুর পর পুত্র জাহাঙ্গীর সিংহাসনে বসেন। তার রাজত্বকাল বাংলার ইতিহাসে এক উল্লেখযোগ্য অধ্যায়। বাংলার কয়েকজন প্রতাপশালী জমিদার ঈসা খাঁর নেতৃত্বে আকবরের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তুলেন। এরা একত্রে বারভূঁইয়া নামে পরিচিত। জাহাঙ্গীর বারভূঁইয়াদের বিরুদ্ধে অভিযান চালিয়ে মুঘল অভিযান সুপ্রতিষ্ঠিত করেন।

জাহাঙ্গীরের রাজত্বকালে দীর্ঘ কাল তাঁর সম্রাজ্ঞী নূরজাহান সাম্রাজ্যের সর্বেসর্বা ছিলেন। সম্রাট জাহাঙ্গীর জাকজমক ও সমৃদ্ধির সাথে শাসন করেছেন। মাদকাসক্ত জাহাঙ্গীরের রাষ্ট্রীয় কাজে অনীহা দেখে দরবারের প্রভাবশালীরা তার সন্তান খুররম ও শাহরিয়ারের পক্ষ নিয়ে দুই দলে বিভক্ত হয়ে বিদ্রোহ করে। অবশেষে খুররম মুঘল সিংহাসনে বসেন।

শাহজাহান ১৬২৮ খৃস্টাব্দে বাদশা গাজি উপাধি নিয়ে সিংহাসনে বসেন। শাহজাহানের যুগে মুঘল স্থাপত্য এর স্বর্ণযুগে প্রবেশ করে। তিনি চার হাজার পূর্তগীজকে বন্দী করেন। এরা ব্যবসার নামে বাংলার জনগনকে ধর্মান্তর এবং ক্রীতদাস রূপে বিদেশে উচ্চ মূল্যে বিক্রয় করত। তিনি অনেক স্মৃতিসৌধ, মসজিদ ও দুর্গ নির্মাণ করেন যার মধ্যে রয়েছে আগ্রার তাজমহল, মোতি মসজিদ, লালকেল্লা, দিল্লি জামে মসজিদ।

সম্রাট অসুস্থ হওয়ার পর তার বড় ছেলে দারা শিকোহ উত্তরাধিকারী হন। সিংহাসন নিয়ে শাহজাহানের চার পুত্রের মধ্যে প্রতিদ্বান্দতায় শেষ পর্যন্ত আওরঙ্গজেব জয়ী হন। রাজনৈতিক কর্মকান্ডে প্রভাব বিস্তার করায় শাহজাহানকে গৃহবন্দী করেন। সম্রাট শাহজাহানের মৃত্যু হলে তাজমহলে তার সম্রাজ্ঞীর পাশে সমাহিত করা হয়।

১৬৫৮ সালে আলমগীর নাম ধারন করে আওরঙ্গজেব দিল্লীর সিংহাসনে বসেন। তিনি পিতার অধীনে বিভিন্ন প্রদেশে সুবাদার হিসাবে প্রায় ২০ বছর এবং সম্রাট হয়ে ৫০ বছর শাসন কার্য পরিচালনা করেন। আওরঙ্গজেবের শাসনামলে মুঘল সাম্রাজ্যের সীমানা সর্বোচ্চ পর্যায়ে পৌছায়। তিনি প্রায় সমগ্র দক্ষিণ এশিয়াকে মুঘল সাম্রাজ্যের সরাসরি অধীনে নিয়ে আসেন।

আওরঙ্গজেবের সময় দক্ষিণ ভারত জয়ের মাধ্যমে ৩.২ মিলিয়ন বর্গ কিলো মিটারের বেশি অঞ্চল মুঘল সাম্রাজ্যের অন্তর্ভুক্ত হয়। এ সময় জনসংখ্যা ছিল ১৫০ মিলিয়নের বেশি যা সে সময়ের পৃথিবীর জনসংখ্যার প্রায় এক চতুর্থাংশ এবং জিডিপি ছিল ৯০ বিলিয়ন ডলারের বেশি। ১৭০৭ সালে তার মৃত্যুর পর সাম্রাজ্যের অনেক অংশ বিদ্রোহ করতে শুরু করে।

আওরঙ্গজেবের ছেলে প্রথম বাহাদুর শাহ প্রশাসন সংস্কার করতে সচেষ্ট হন। তবে ১৭১২ তার মৃত্যুর পর মুঘল সাম্রাজ্য বিশৃঙ্খল অবস্থায় পড়ে। একটি সময় মুহাম্মদ শাহের শাসনামলে সাম্রাজ্য ভেঙ্গে পড়তে শুরু করে। মধ্য ভারতের অধিকাংশ মারাঠাদের হাতে চলে যায়। পরবর্তী মুঘল সম্রাটগণ ১৭০৭ থেকে ১৮৫৭ সাল পর্যন্ত রাজত্ব করেন।

মারাঠাদের আক্রমণের ফলে সাম্রাজ্যের অবনতি শুরু হয়। ১৮ শতকের মধ্যভাগ নাগাদ মারাঠারা মুঘল সেনাবাহিনীর বিপক্ষে সফলতা লাভ করে এবং দাক্ষিণাত্য থেকে বাংলা পর্যন্ত বেশ কিছু মুঘল প্রদেশে বিজয়ী হয়। সাম্রাজ্যের প্রশাসনিক ও অর্থনৈতিক দুর্বলতার কারণে অভ্যন্তরীণ অসন্তোষ সৃষ্টি হলে বিভিন্ন প্রদেশ কার্যত স্বাধীন হয়ে পড়ে।

১৭৩৯ সালে কারণালের যুদ্ধে নাদির শাহের বাহিনীর কাছে মুঘলরা পরাজিত হয়। এ সময় দিল্লী লুন্ঠিত হয়। ক্রমান্বয়ে মুঘল সাম্রাজ্য সীমিত হয়ে পড়ে এবং শেষ মুঘল সম্রাট দ্বিতীয় বাহাদুর শাহের কর্তৃত্ব শুধু শাহজাহানাবাদ শহরে সীমাবদ্ধ হয়ে পড়ে। ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি রাজদ্রোহীতার অভিযোগ এনে কারাবন্দী করেন। শেষে তিনি রেঙ্গুনে নির্বাসিত হন এবং সেখানেই মারা যান।

সম্রাট দ্বিতীয় শাহ আলম মুঘল কর্তৃত্ব পুনপ্রতিষ্ঠা করার জন্য প্রচেষ্ঠা চালান। কিন্তু তাকে বাইরের শক্তির উপর নির্ভর করতে হয়। এদের মধ্যে ছিলেন আফগানিস্থানের আমির আহমেদ শাহ আবদালি। ১৭৬১ সালে আবদালির নেতৃত্বাধীন আফগান ও মারাঠা সাম্রাজ্যের মধ্যে পানিপথের তৃতীয় যুদ্ধ সংঘটিত হয়। মারাঠারা পরাজিত হলেও ১৭৭১ সালে মারাঠারা দিল্লী পুনর্দখল করে নেয়।

১৭৮৪ সালে তারা আনুষ্ঠানিকভাবে দিল্লীতে সম্রাটের রক্ষক হয়ে ওঠে। তৃতীয় ইঙ্গ-মারাঠা যুদ্ধের আগ পর্যন্ত এই অবস্থা বজায় ছিল। এরপর বৃটিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি মুঘল রাজবংশের রক্ষক হয়। সিপাহী বিদ্রোহের ব্যর্থতার পর শেষ মুঘল সম্রাটকে ক্ষমতাচ্যুত করে নির্বাসনে পাঠানো হয়। এরপর ইংল্যান্ডের রাণী ভিক্টোরিয়াকে ভারত সম্রাজ্ঞী ঘোষণা করা হয়।

মুঘল সাম্রাজ্যের পতন 


ইতিহাসবিদরা মুগল সাম্রাজ্যের পতনের বেশ কিছু কারন উল্লেখ করেন। যেমন-
  • আমির ও কর্মচারীদের বেতন দিতে প্রয়োজনীয় রাজস্ব ছিল না।
  • আঞ্চলিক শাসকদের উপর নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে ফেলেছিলেন।
  • মারাঠাদের বিরুদ্ধে দীর্ঘদিন যুদ্ধ করতে করতে সেনাবাহিনী মনোবল হারিয়ে ফেলে।
  • স্থানীয় শাসকরা ক্ষমতা নিতে শুরু করে।
  • উচ্চশ্রেণীর মধ্যে অসাধুতা, বিলাসিতা ও সংকীর্ণ দৃষ্ঠিভঙ্গী।
  • ধনীদের হাতে কৃষকদের নিপীড়নের কারনে শাসকদের প্রতি জনসমর্থন কমে আসে।
  • হিন্দু ধনী সম্প্রদায় মুঘল সাম্রাজ্যের বদলে মারাঠা ও বৃটিশদের অর্থ সহায়তা প্রদান করে।
  • ধর্মীয় মতানুসারে হিন্দরা মুসলিম শাসনের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করে।
  • সাম্রাজ্যের অত্যাধিক সমৃদ্ধি প্রদেশগুলোকে স্বাধীনতা অর্জনে উৎসাহ যোগায় এবং রাজদরবারকে দুর্বল করে তোলে।

মুঘলদের শিল্প ও সংস্কৃতি 


ভারত উপমহাদেশে মুঘলরা অনন্য স্থাপত্য শৈলী দান করেছে। মুঘল স্থাপত্যের উৎকৃষ্ট উদাহরণ হচ্ছে তাজমহল। এ ছাড়া রয়েছে হুমায়নের মাজার, ফতেহপুর সিক্রি, লালকেল্লা, আগ্রা দুর্গ ও লাহোর দুর্গ । মুঘল স্থাপত্যের অনেক নিদর্শন ভারত, পাকিস্থান, বাংলাদেশ ও আফগানিস্থানের বিভিন্ন অঞ্চলে ছড়িয়ে আছে।

পারস্যের শিল্প ও সংস্কৃতি এই উপমহাদেশের সংস্কৃতির সাথে যুক্ত হয়। আরব ও তুর্কীয় অধ্যুসিত অঞ্চল সমূহে নতুন বাণিজ্য রুট চালু হয়। মুঘল রান্না ভারত উপমহাদেশের একটি বিশেষত্ব। ভারতীয় স্থাপত্য যেমন রাজপুত ও শিখ শাসকদের প্রাসাদে মুঘল স্থাপত্যের প্রভাব লক্ষ করা যায়। এ ছাড়াও বাগান তৈরিতে মুঘলদের গুরত্বপূর্ণ অবদান আছে।

ভাষা 
মুঘলদের রাজস্ব ভারতীয় উপমহাদেশে ফার্সি ভাষার পুনরুজ্জীবন এবং উচ্চতা কার্যকর করেছিল। সাহিত্যিক পৃষ্ঠপোষকতার সাথে ফার্সিকে একটি সরকারী ও দরবারী ভাষা হিসাবে প্রতিষ্ঠা করা হয়েছিল। এর ফলে অনেকের কাছে ফার্সি ভাষা প্রায় প্রথম ভাষার মর্যাদা পায়। তাদের বৈচিত্রময় সাম্রাজ্যকে একত্রিত করার জন্য রাজনৈতিক সংস্কৃতির বাহন হিসাবে ফার্সি ভাষা ব্যবহার করেছিল।

ফারসি প্রধান এবং সরকারী ভাষা হলেও পরবর্তী সময়ে উর্দু অভিজাত শ্রেণীর ভাষা হয়ে উঠে। হিন্দি ও উর্দুর মিল থাকলেও শব্দভান্ডারের দিক থেকে দুইটি ভাষা পৃথক। হিন্দি শব্দ সংস্কৃত প্রভাবিত আর উর্দু আরবি, ফারসি ও তুর্কীয় ভাষা প্রভাবিত। বর্তমানে উর্দু পাকিস্তানের জাতীয় ভাষা এবং ভারতের একটি গুরুত্বপূর্ণ সহসরকারী ভাষা।

মুঘল সমাজ
মুঘল শাসনামলে অর্থনীতি সমৃদ্ধ হওয়ায় সড়ক নির্মাণ, একক মুদ্রা চালু, কৃষি ও উৎপাদিত পণ্য বিশ্বব্যাপী বিক্রি, জাহাজ নির্মাণ, কাপড় প্রস্তুত ইত্যাদি গুরুত্বপূর্ণ শিল্প গড়ে উঠে। মক্কায় হাজিদের নিয়ে যাওয়ার জন্য ক্ষুদ্র নৌবহর ছিল। এর মাধ্যমে আরবদের ঘোড়া আমদানি করা হত। নৌবহরের মাধ্যমে সেনা বহন ও বিদ্রোহীদের সাথে লড়ায়ের জন্য নদীতে নৌবহর ছিল।

এ সময় সিদি সম্প্রদায়ের নাবিকেরা চীন ও পূর্ব আফ্রিকান উপকূলগামী জাহাজে ব্যক্তিগত বাণিজ্যের জন্য বণিকদের নিয়ে জাহাজ চালনা করত। মুঘল আমলে শহরের বেশ উন্নতি হয়। তবে শহরগুলি ছিল সামরিক ও রাজনৈতিক কেন্দ্র, বাণিজ্যিক কেন্দ্র নয়। অধিকাংশ শিল্প ছিল শহরের বাইরে গ্রাম অঞ্চলে। তারা পত্যেক প্রদেশে মক্তব নির্মাণ করে সেখানে কুরআন ও ইসলামি আইন শিক্ষা দেয়া হত। বৃটিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির হাতে বাংলার নিয়ন্ত্রণ চলে যাওয়ার আগ পর্যন্ত সাম্রাজ্যের সমৃদ্ধি বজায় ছিল।

বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি 


জ্যোতির্বিজ্ঞান : মুঘল জ্যোতির্বিজ্ঞানীরা পর্যবেক্ষণমূলক জ্যোতির্বিজ্ঞানের চর্চা চালিয়ে যান। এ বিষয়ে তারা অনেক গবেষণা বিবরণ রচনা করেন। সম্রাট হুমায়ুন দিল্লিতে ব্যক্তিগত মানমন্দির নির্মাণ করেচিলেন। মুঘলদের ব্যবহৃত জ্যোতির্বিজ্ঞানের যন্ত্রপাতিগুলো ইসলামি ঐতিহ্য থেকে আগত। এ সময়ের একটি উল্লেখযোগ্য কীর্তি হল একক ভূগোলক নির্মাণ।

আলকেমি : শেখ দীন মুহাম্মদ মুঘল আলকেমি নিয়ে জ্ঞান অর্জন করেছিলেন। শ্যাম্পু তৈরির প্রকৃয়া তার জানা ছিল। মুঘল সাম্রাজ্যের জৌলুসের কথা তিনি লিপিবদ্ধ করেছেন। শেখ দীন মুহম্মদ রাজা চতুর্থ জর্জ এবং চতুর্থ উইলিয়াম উভয়ের শ্যাম্পু সার্জন হিসাবে দায়িত্ব পালন করেছেন।

প্রযুক্তি : পারসিয়ান পন্ডিত ও যন্ত্রপ্রকৌশলী ফতুল্লাহ শিরাজী সম্রাট আকবরের জন্য কয়েক ব্যারেল বিশিষ্ট বন্দুক তৈরি করেছিলেন। আকবর সর্বপ্রথম ধাতব সিলিন্ডারের রকেট ব্যবহার করেন। যুদ্ধে মুঘল সেনারা এগুলি ব্যবহার করত।পরবর্তীতে মুঘল রকেটের উন্নত সংস্করণ মহীশুর রকেটের উদ্ভব হয়। দ্বিতীয় ইঙ্গ-মহীশুর যুদ্ধের সময় এই রকেট সালতানাতের জন্য অনেক সুবিধা নিয়ে এসেছিল।

স্থাপত্য : মুঘলরা ভারতীয় উপমহাদেশে তাদের অনন্য ইন্দো-ফার্সি স্থাপত্যের বিকাশে অনেক অবদান রেখেছে। অনেক স্মৃতিসৌধ নির্মিত হয়েছিল মুসলিম সম্রাটদের দ্বারা। যেমন তাজমহল ভরতে মুসলিম শিল্পের রত্ন এবং বিশ্ব ঐতিহ্যের সর্বজনীন সমাদ্রত মাস্টার পিস। প্রতি বছরে ৭০-৮০ লাখ দর্শক এখানে ভ্রমণে আসে।

মুঘল সাম্রাজ্যের প্রশাসন ও রাষ্ট্র 


মুঘল সাম্রাজ্যের কেন্দ্রীয় ও আমলাতান্ত্রিক সরকারের অধিকাংশই তৃতীয় মুঘল সম্রাট আকবরের শাসনামলে প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল। কেন্দ্রীয় সরকারের প্রধান ছিলেন সম্রাট। তার নিচে ছিল চারটি মন্ত্রণালয়। দিওয়ান সাম্রাজ্যের রাজস্ব নিয়ন্ত্রণ করত। সামরিক মন্ত্রণালয় সামরিক সংস্থা, বার্তাবাহক পরিষেবা এবং মনসবদারি ব্যবস্থার দায়িত্বে ছিলেন।

আইন ও ধর্মীয় মন্ত্রণালয় বিচারক নিয়োগ করতেন এবং দাতব্য ও উপবৃত্তি পরিচালনা করতেন। আরেকটি মন্ত্রণালয় সাম্রাজ্যের গৃহস্থালি ও গণপূর্তের জন্য নিবেদিত ছিল। সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ মন্ত্রী দেওয়ান উজির হিসাবে কাজ করতেন। সাম্রাজ্য প্রদেশে বিভক্ত ছিল, যার প্রত্যেকটিতে সুবাদার নামে একজন প্রাদেশিক গভর্নর নেতৃত্বে ছিলেন।

রাজধানী : মুঘলদের একাধিক সাম্রাজ্যিক রাজধানী ছিল, এগুলি ছিল আগ্রা, দিল্লী, লাহোর এবং ফতেহপুর সিক্রি। মুঘল ইতিহাসে একাধিকবার একই সময়ে দুটি রাজধানী থাকার ঘটনা ঘটেছে। আওরঙ্গজেবের দাক্ষিণাত্যের ঔরঙ্গাবাদে স্থান্তরিত হওয়ার ক্ষেত্রেও কিছু শহর স্বল্পমেয়াদী প্রাদেশিক রাজধানী হিসাবে কাজ করেছে। কাবুল ছিল মুঘলদের গ্রীষ্মকালীন রাজধানী।

আইন : একটি মুসলিম রাষ্ট্র হওয়ার কারনে সাম্রাজ্য ফিকাহ বা ইসলামিক আইনশাস্ত্র নিযুক্ত করেছিল। ইসলামী আইনের মৌলিক প্রতিষ্ঠান যেমন কাজি, মুফতি এবং মুহতাসিব প্রতিষ্ঠিত ছিল। প্রশাসনিক নিয়ম, স্থানীয় রীতিনীতি এবং রাজনৈতিক সুবিধা ইত্যাদি কারনের উপরও ন্যায় বিচার নির্ভর করত। কিছু ক্ষেত্রে সম্রাট সরাসরি বিচার করতেন।

সাম্রাজ্যের প্রজারাও তাদের অভিযোগ উচ্চতর কর্মকর্তাদের আদালতে পেশ করতে পারত। জাহাঙ্গীর আগ্রা দুর্গে একটি ‘ন্যায়বিচারের শৃঙ্খল’ স্থাপন করেছিলেন যেন সংক্ষুব্ধ বিষয় সম্রাটের দৃষ্টি আকর্ষণ হয়। পণ্ডিত মোয়েজ খালফাউই উল্লেখ করেছেন যে মুঘল সাম্রাজ্যের আইনি প্রতিষ্ঠানগুলি পদ্ধতিগতভাবে স্থানীয় বিচারকদের দুর্নিতির শিকার হয়েছিল। মুঘল সাম্রাজ্যে বিভিন্ন ধরনের আদালত ছিল।

মুঘল সাম্রাজ্যের অর্থনীতি 


মুঘল অর্থনীতি ছিল বৃহৎ ও সমৃদ্ধিশালী। ১৭৫০ সাল পর্যন্ত ভারত বিশ্বের উৎপাদনের ২৪.৫% উৎপাদন করত। ভারতের অর্থনীতিকে ১৮ শতকের পূর্বে পশ্চিম ইউরোপের মতো প্রোটো-শিল্পায়নের একটি রুপ হিসাবে বর্ণনা করা হয়েছে। ব্যবসা পরিচালনা সহজ করার জন্য মুঘলরা একটি বিস্তৃত সড়ক ব্যবস্থা ও অভিন্ন মুদ্রার প্রচলন করেছিল।

সাম্রাজ্যের যৌথ সম্পদের মূল ভিত্তি ছিল কৃষি কর। সম্রাট আকবর কর্তৃক প্রবর্তিত এই কর একজন চাষীর উৎপাদনের অর্ধেকেরও বেশি ছিল। ভারতে স্বর্ণ ও রৌপ্য মজুত থাকা সত্ত্বেও মুঘলরা তাদের নিজস্ব স্বর্ণের ন্যূনতম স্বর্ণ উৎপাদন করত কিন্তু বেশিরভাগই আমদানি করা বুলিয়ন থেকে মুদ্রা তৈরি করত, যার ফলে ভারতীয় কৃষি ও শিল্প পণ্যের বৈশ্বিক চাহিদা স্থিতিশীল ছিল।

মুঘল সাম্রাজ্যের অধীনে ভারতীয় কৃষি উৎপাদন বৃদ্ধি পায়। ধান, গম এবং বার্লির মত খাদ্য শস্য এবং তুলা, নীল এবং আফিমের মত খাদ্যবহির্ভুত অর্থকরী ফসল সহ বিভিন্ন ধরনের শস্য জন্মানো হত। ১৭ শতকের মাঝামাঝি ভারতীয় চাষীরা আমেরিকা থেকে দুটি নতুন ফসল ভুট্টা এবং তামাক ব্যাপকভাবে জন্মাতে শুরু করে।

আকবর কর্তৃক প্রবর্তিত একটি প্রধান মুঘল সংস্কার ছিল জাবত নামে একটি নতুন ভূমি রাজস্ব ব্যবস্থা। এ ব্যবস্থার অধীনে লাঙ্গল চাষের অধীনে জমির ক্ষেত্রফল নির্ণয়ের জন্য ব্যাপক ক্যাডাস্ট্রাল জরিপও পরিচালনা করেছিল। মুঘল রাজ্য যারা নতুন জমি চাষের আওতায় এনেছিল তাদের করমুক্ত সময় প্রদানের মাধ্যমে বৃহত্তর জমি চাষকে উৎসাহিত করেছিল।

বাঙ্গালি কৃষকরা তুঁত চাষ এবং রেশম চাষের কৌশলগুলি শিখেছিল। প্রতিষ্ঠা করেছিল বাংলা সুবাহ বিশ্বের একটি প্রধান রেশম উৎপাদনকারী অঞ্চল। ১৭ শতকের মধ্যে রোলার এবং সেইসাথে ওয়ার্ম গিয়ারিং নীতি ব্যবহার করে মুঘল ভারতে গিয়ারড সুগার রোলিং মিলগুলি প্রথম আবির্ভুত হয়েছিল। এ আমলে মাথাপিছু কৃষি উৎপাদন এবং ব্যবহারের মান ইউরোপের তুলনায় বেশি।

মুঘল আমলে উৎপাদিত পণ্য ও অর্থকরী ফসল সারা বিশ্বে বিক্রি করা হত। মূল শিল্পের মধ্যে টেক্সটাইল, জাহাজ নির্মাণ এবং ইস্পাত অন্তর্ভূক্ত ছিল। প্রকৃয়াজাত পণ্যের মধ্যে সুতি বস্ত্র, সুতা, সিল্ক, পাটজাত পণ্য, ধাতুপাত্র এবং চিনি, তেল এবং মাখনের মতো খাবার অন্যতম। সেই সাথে মশলা, মরিচ, নীল,এবং সল্টপেটার (যুদ্ধে ব্যবহারের জন্য) ইউরোপে বেশ চাহিদা ছিল।

ইউরোপীয় ফ্যাশন মুঘল ভারতীয় টেক্সটাইল এবং সিল্কের উপর ক্রমবর্ধমানভাবে নির্ভরশীল হয়ে পড়ে। ইউরোপ থেকে কিছু বিলাসবহুল দ্রব্য আমদানী করা হত। বাণিজ্য ভারসাম্যহীনতার কারনে ইউরোপীয়রা দক্ষিণ এশীয় আমদানীর জন্য মুঘল ভারতে প্রচুর পরিমানে সোনা রূপা রপ্তানি করে। ভারতীয় পণ্য ইন্দোনেশিয়া ও জাপানে প্রচুর পরিমাণে রপ্তানি করা হত।

উত্থান বিকাশ আর পতন সকল সভ্যতারই একটি চিরাচরিত প্রক্রিয়া। ভীষণ প্রভাব বিস্তার করা সাম্রাজ্য কালের গর্ভে হারিয়ে যায়। এ প্রকৃয়া মোঘলদের ক্ষেত্রেও ব্যতিক্রম ঘটেনি। আর এরই মাধ্যমে ভারতবর্ষে প্রায় সাড়ে তিনশো বছর মুঘল শাসনামলের সমাপ্তি ঘটে।

এই পোস্টটি পরিচিতদের সাথে শেয়ার করুন

পূর্বের পোস্ট দেখুন পরবর্তী পোস্ট দেখুন
এই পোস্টে এখনো কেউ মন্তব্য করে নি
মন্তব্য করতে এখানে ক্লিক করুন

অর্ডিনারি আইটির নীতিমালা মেনে কমেন্ট করুন। প্রতিটি কমেন্ট রিভিউ করা হয়।

comment url