মেসোপটেমীয় সভ্যতা প্রাচীন বিশ্বের এক অপার বিস্ময়।

মেসোপটেমীয় সভ্যতা প্রাচীন বিশ্বের এক অপার বিস্ময়। এ যেন সভ্যতার মোড়কে ঘনীভুত এক ইতিহাস। জীবনের জানা-অজানা কথা, মানব ইতিহাসের উত্থান-পতনের এক মহাকাব্য। এ সভ্যতার কথা ইতিহাসের পাতায় স্বর্ণক্ষরে লেখা হয়েছে। আজও মানুষের মনে জানার আগ্রহে এতটুকুও ভাঁটা পড়েনি।

মেসোপটেমীয় সভ্যতা প্রাচীন বিশ্বের এক অপার বিস্ময়।

নামকরণ ও পর্যায়


মেসোপটেমিয়া শব্দটি এসেছে মূলত গ্রিকদের কাছ থেকে। যার অর্থ ‘দুই নদীর মধ্যবর্তী ভূমি’। ইউফ্রেটিস ও টাইগ্রিস নদীর মধ্যবর্তী উর্বর উপত্যকায় গড়ে উঠেছিল ইতিহাসের প্রথম সভ্যতা মেসোপটেমিয়া। প্রাচীনকালে একে বলা হত ‘দ্বি-নদমধ্যা দেশ’। এই উর্বর এলাকায় প্রায় ৬০০০ খৃস্টপূর্ব থেকেই বিভিন্ন এলাকার মানুষ এসে সববেত হতে থাকে।

মেসোপটেমীয় সভ্যতার পর্যায় ছিল মোট চারটি। সুমেরীয়, ব্যবিলনীয়, অ্যাসিরীয় এবং ক্যালডীয়। সুমের গোষ্ঠীর লোকেরাই মেসোপটেমীয় সভ্যতায় আধুনিক নগরের রুপ দান করেছিল। সুমেরীয়দের পর মেসোপটেমীয় সভ্যতায় আক্কাদিয়ানরা এসে ব্যাপক উন্নতি করেছিল। ধর্মীয় প্রার্থনালয় হিসাবে নির্মিত জিগুরাত হচ্ছে তাদের সভ্যতার এক অনন্য নিদর্শন। এ ছাড়া প্রাচীন পৃথিবীর সপ্তমাশ্চর্য ব্যবিলনের ঝুলন্ত উদ্যানও এই সময়ের নিদর্শন।

মেসোপটেমীয় সভ্যতা প্রথিবীর প্রাচীনতম সভ্যতার মধ্যে অন্যতম। খৃস্টপূর্ব ৩১০০ হতে ৫৩৯ খৃস্টপূর্বাব্দে মেসোপটেমিয়ায় অতি উন্নত এক সভ্যতার উন্মেষ ঘটেছিল। মিশরীয় সভ্যতা থেকে অনেকটাই ভিন্ন ধরনের ছিল এ সভ্যতা। বহিঃশত্রুদের থেকে খুব একটা সুরক্ষিত ছিল না বলে বারবার এটি আক্রমণে বিপর্যস্ত হয়।

এর ফলে এই সভ্যতায় কয়েকটি সাম্রাজ্যের উন্মেষ ঘটে। উত্তরাংশের নাম এশেরীয় এবং দক্ষিণাংশের নাম ছিল ব্যাবিলনিয়। ব্যাবিলনিয়ার উত্তরে অক্কাদ ও দক্ষিণে সুমের নামে দুটি অংশে বিভক্ত ছিল। প্রকৃতপক্ষে এই দুটি জনগোষ্ঠীর সৃজনশীলতার ফসলই হল মেসোপটেমিয়া সভ্যতা।

খৃস্টপূর্ব ১৫০ সালের দিকে মেসোপটেমিয়া পার্সিয়ানদের কাছ থেকে রোমানরা নিয়ন্ত্রণে নেয়ার পর ২৫০ বছরের বেশি শাসন করতে পারে নি। দ্বিতীয় শতকের শুরুর দিকে পার্সিয়ানরা এই অঞ্চলের নিয়ন্ত্রণ নিয়ে নেয় এবং সপ্তম শতাব্দী পর্যন্ত এই অঞ্চল তাদের শাসনেই থাকে। এরপর মুসলিম শাসনামল শুরু হয়। মুসলিম খেলাফত শাসনে এই অঞ্চল পরবর্তীতে ইরাক নামে পরিচিতি লাভ করে।

প্রথম অধিবাসী


টাইরাস ও জাগরেস পর্বতের পাদদেশে লোকজন প্রথমে বসবাস শুরু করলেও খৃস্টপূর্ব প্রায় ৯০০০ অব্দের দিকে তারা মেসোপটেমিয়ার দক্ষিণ দিকে স্থান্তরিত হয়ে জনবসতি গড়ে তুলে। নদীর অববাহিকায় থাকার কারনে মাটি ছিল খুবই উর্বর। সে কারনে তারা কৃষিকাজ বেছে নেয়। খৃস্টপূর্ব ৭-৬ সহস্রাব্দের দিকে মেসোপটেমীয়রা গরু, ছাগল ও ভেড়া পালনের সাথে কৃষিকাজেও জড়িত ছিল।

গাছগাছালি ও নদীর উর্বর মাটি দিয়ে নিজ হাতে বানানো কুঁড়েঘরে বাস করত। বার বার বন্যায় নিঃস্ব হতে হয়েছে এবং সিংহ ও বুনো শুয়োরের আক্রমণেও ফসলের ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি হতো। এসব প্রতিকুল পরিবেশে সংগ্রাম করে তারা টিকে থেকেছে।

মেসোপটেমিয়া সভ্যতার প্রধান চারটি পর্যায় 


ইরাক, ইরান, সিরিয়া, তুরস্ক ও কুয়েতের কিছু অংশজুড়ে অবস্থিত মেসোপটেমিয়া সভ্যতা ৫০০০ খৃস্টপূর্বাব্দে প্রতিষ্ঠিত, বিশ্বের প্রাচীনতম সভ্যতাগুলোর মধ্যে অন্যতম। প্রথম পর্যায় : সুমেরীয়রা (খৃস্টপূর্ব ৪৫০০ - ২০০০) ছিল এই অঞ্চলের বাসিন্দা। তারা চিত্রলিপি, সাহিত্য, আইন, স্থাপত্য, জোতির্বিদ্যা ও গণিতে উল্লেখযোগ্য অগ্রগতি লাভ করেছিল।

দ্বিতীয় পর্যায় : ব্যাবিলনীয় (খৃস্টপূর্ব ২০০০ - ৫৩৯) হ্যামুরাবির বিখ্যাত আইনসংহিতা এই যুগের উল্লেখযোগ্য দিক। ব্যাবিলন সভ্যতা ঝুলন্ত উদ্যান, জোতির্বিদ্যা, গণিত ও সাহিত্যের জন্য বিখ্যাত ছিল। তৃতীয় পর্যায় : এসিরিয়রা (খৃস্টপূর্ব ৯১১ - ৬১২) শক্তিশালী সামরিক শক্তি ছিল। তারা ধাতুবিদ্যা, স্থাপত্য ও ভাস্কর্য শিল্পে উন্নতি লাভ করেছিল।

চতুর্থ পর্যায় : ক্যালডিয়দের উল্লেখযোগ্য (খৃস্টপূর্ব ৬২৬ - ৫৩৯) অবদান ছিল জ্যোতির্বিদ্যা ও গণিতে। এই সভ্যতায় বিশ্বের প্রথম লাইব্রেরি, স্কুল ও হাসপাতাল স্থাপিত হয়েছিল।

ভৌগলিক পটভূমি


ইতিহাস বিখ্যাত এই অঞ্চলটি উত্তর আরমেনিয়ার পার্বত্য অঞ্চল, দক্ষিণ ও পশ্চিমে আরব মরুভূমি ও পূর্বে জাগরাস পার্বত্য অঞ্চল দ্বারা পরিবেষ্ঠিত। এই অঞ্চলটিকে ‘উর্বরা অর্ধচন্দ্রাকৃতিক’ হিসাবে আখ্যা দেয়া হয়। অবস্থানগত এই বৈশিষ্ঠ্য ও আরবদের আদিম যাযাবর সংস্কৃতির মিথস্ক্রিয়ার মধ্য দিয়ে মেসোপটেমিয়া একটি মিশ্র সভ্যতার ধারা নিয়ে গড়ে উঠেছিল।

এই সভ্যতা ৫০০০ খৃস্টপূর্বে সূচনা হয়ে পরিপূর্ণতা লাভ করে প্রায় খৃস্টপূর্ব ৩০০০ অব্দে। ৩৩৩ খৃস্টাব্দে এসে বিভিন্ন জনগোষ্ঠীর আন্তঃকলহের মধ্য দিয়ে পরস্পরের ধ্বংস ডেকে আনে এবং ক্রমান্নয়ে পতনের দিকে এগিয়ে চলে।

ধর্মীয় বিশ্বাস 


ধর্ম পালনের দিক দিয়ে মেসোপটেমিয়া সভ্যতার মানুষেরা অনেক অগ্রগামী ছিল। প্রতিটি জিগুরাট ও মন্দিরে সকল শ্রেণীর মানুষের বসার ব্যবস্থা ছিল। এসব লোকজন নগর দেবতাদের প্রনামভক্তি ও বিভিন্ন জিনিস উৎসর্গ করত। এর ফলে এই সভ্যতার সার্বজনীন ধর্মব্যবস্থার পরিচয় পাওয়া যায়। তারা বিশ্বাস করত যে পৃথিবী একটি বিশাল ফাঁকবিশিষ্ট স্থানে অবস্থিত একটি গোলাকার চাকতি।

আকাশে স্বর্গ ও মাটির নিচে নরক রয়েছে বলেও বিশ্বাস করত। পানি সম্পর্কে তাদের ধারনা ছিল যে পৃথিবী পানি দিয়েই তৈরী এবং এর চারপাশে পানিই আছে। প্রাচীন মেসোপটেমিয়ানরা বহুইশ্বরবাদে বিশ্বাস করলেও পরে তাদের ধর্মীয় বিশ্বাসে পরিবর্তন শুরু হয়। তাদের মধ্যে বিভিন্ন দেবদেবীর মূর্তিপূজার প্রমাণ পাওয়া যায়।

মেসোপটেমীয় সভ্যতা প্রাচীন বিশ্বের এক অপার বিস্ময়


বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি : মেসোপটেমিয়ার মানুষরা অতি উন্নত চিন্তার কৃষিবিদ ছিল। কৃষকরা উদবৃত্ত ফসল মন্দিরে জমা দিলে পুরোহিতরা পাহাড়ের গায়ে দাগ কেটে মনে রাখার চেষ্টা করত। এভাবে ক্রমেই হিসাব রাখার প্রাধান্য পেতে শুরু করে। এক পর্যায়ে তারা গণিত শাস্ত্রের উদ্ভাবন ও উন্নতিসাধন করতে সক্ষম হয়। তাদের সংখ্যাগুলি ষাট কেন্দ্রিক ছিল।

সেখান থেকেই এক ঘন্টায় ষাট মিনিট ও এক সেকেন্ডের হিসাব আসে। এছাড়া তারাই প্রথম বছরকে ১২ মাসে এবং এক মাসকে ৩০ দিনে ভাগ করে হিসাব শুরু করে। প্রথমদিকে পৃথিবীকে চ্যাপ্টা চাকতির মত মনে করলেও পরে তাদের মধ্যে গোল পৃথিবীর ধারনা জন্মায়। পৃথিবীকে তারাই প্রথম ৩৬০ ডিগ্রিতে ভাগ করে এবং ১২ টি রাশিচক্র ও জলঘড়ি আবিস্কার করে।

ধাতুর ব্যবহারে মেসোপটেমিয়ানরা বেশ উন্নতি সাধন করে। খৃস্টপূর্ব ২৫০০ অব্দে তামা ও ব্রোঞ্জের ব্যবহার শুরু করে। কাচের ব্যবহার খৃস্টপূর্ব ১৬০০ অব্দের পর থেকে শুরু করে বলে ধারনা করা হয়। পুরোহিতরা উঁচু মিনার থেকে জ্যোতির্মণ্ডল পর্যবেক্ষণ করতেন। তাদের গণিতবিদরা সূর্য ও চন্দ্রগ্রহণের সঠিক সময় বলে দিতে পারতেন। 

সর্বপ্রথম পঞ্জিকা প্রচলন ঘটে ব্যাবিলনীয় সভ্যতায়। ৩৬০ ডিগ্রি কোণ আবিস্কার করেছিল আ্যাসিরীয়রা। পৃথিবীকে অক্ষাংশ ও দ্রাঘিমাংশে ভাগ বা সাত দিনে সপ্তাহ গণন আবিস্কারের কৃতিত্বটাও শুধু মেসোপটেমীয়দের। আজকের যুগের পাটিগণিত সে যুগেও প্রচলিত ছিল। চাঁদ, সূর্য বা বিভিন্ন গ্রহ নক্ষত্রের গতিবিধি নির্ণয়ে গণিতের ব্যবহার তারাই প্রথম শুরু করেছিল।

সেচ, খাল খনন ও দালান নির্মানে তারাই প্রথম চাকা আবিস্কার করেছিল। নদীর তীরে সভ্যতা গড়ে ওঠায় তারা কাদামাটিকে কাজে লাগায়। রাজপ্রাসাদ তৈরির জন্য উঁচু জায়গা বেছে নেয়া হত এবং চারিদিকে বেষ্ঠিত থাকত দূর্গপ্রাচীর। প্রবেশদ্বারের সামনে থাকত বিশাল প্রস্তর মূর্তি। মূর্তিগুলি মানুষ, ষাঁড় ও পাখির সংমিশ্রণে সৃষ্টি করা হত।

দেয়ালে খোদাই করা ভাস্কর্য ফুটিয়ে তুলত যুদ্ধ সম্পর্কিত বীরগাথা বা দেবদেবীর আখ্যান। সে সময়েই সম্রাটরা তাদের বীরত্বের কাহিনীও প্রস্তরফলকে দৃশ্যমান করতে চাইতেন। প্রাচীন মেসোপটেমিয়ার শেষ্ঠ নিদর্শনগুলোর মধ্যে জিগুরাত ছিল অন্যতম। এটি মূলত পিরামিডের মত সুউচ্চ ধর্মীয় স্থাপনা। সকল প্রধান শহরেই জিগুরাত স্থাপন করা হয়।

খৃস্টপূর্ব ৩০০ অব্দের দিকে প্রথম জিগুরাত নির্মিত হয়েছে বলে প্রমাণ পাওয়া যায়। একে ‘স্বর্গ-মর্তের সংযোগস্থল’ হিসাবে বিবেচনা করা হয়। ইশতার তোরণ ছিল ব্যাবিলন শহরের প্রধান প্রবেশদ্বার। এটিকে সৌন্দর্যময় করার জন্য ষাঁড়, ড্রাগন ও সিংহের চিত্র সম্বলিত উজ্জ্বল নীলরঙ্গা ইট দিয়ে সাজিয়ে তোলা হয়েছিল। প্রাচীন মেসোপটেমিয়ার উর্বরতা, শক্তি, প্রেম, যুদ্ধ ও যৌনতার দেবী ইশতারকে উৎসর্গ করেই এটি নির্মাণ করা হয়।

ভাষা ও সাহিত্য 


মেসোপটেমীয়রা সেমেটিক ভাষায় কথা বলত। মেসোপটেমীয়দের প্রধান কৃতিত্ব হল প্রয়োজনীয় ভাব বা বার্তা বোঝানোর জন্য আদিম লেখন পদ্ধতির উদ্ভাবন। প্রথম দিকে এই ভাষা কিছু ছবির মাধ্যমে প্রকাশ করা হত। প্রায় হাজার খানেক সংকেত চিহ্নের প্রচলন ছিল। এরা প্রধানত কাদামাটির ছোট ছোট স্লেট বা মৃত্তিকা ফলকের উপর সুঁচালো কাঠি দিয়ে লিখে শুকিয়ে নিত এবং পুড়িয়ে নিত আগুনে।

কিন্তু পরবর্তীতে তা আরো পরিশীল হয়ে বর্ণমালায় রূপ নেয়। সেই অক্ষর প্রকাশ করত সম্পূর্ণ একটি শব্দ বা শব্দাংশ। এগুলিকে কিউনিফর্ম বা কীলকলিপি বলা হয়। আনুমানিক ৩৪০০ খৃস্টপূর্ব অব্দের দিকে এই বর্ণমালার মাধ্যমে লিখিত দলিল পাওয়া যায়। আধুনিক যে দফতরীয় দলিল দেখতে পাওয়া যায় তা সুমেরীয়দের মধ্যেই প্রথম দেখা যায়।

সাহিত্যের জন্য যে ভাষা ব্যবহার করত তাকে বিজ্ঞানীরা হেমেটিক ভাষা বলত। এদের সাহিত্য থেকে জানা যায় লোকজন অত্যন্ত কল্পনাপ্রবণ ছিল। বস্তুত এইগুলো ছিল ধর্মাশ্রয়ী সাহিত্যচিন্তা। বিশেষজ্ঞগণ এই কীলকলিপির পাঠোদ্ধার করে মেসোপটেমিয়া সভ্যতার অনেক অজানা তথ্যের সন্ধান পেয়েছেন। পাথর খোদাই করে হাম্বুরাবি শাসনের নীতিমালাও রচিত হয়েছিল এই কীলকলিপিতে।

কীলকলিপি ছিল বেশ জটিল। এ সমস্যা থেকে উত্তরণের জন্য ফিনিশিয়রা ২২ টি ব্যঞ্জনবর্ণ আবিস্কার করেন। এ ক্ষেত্রে তারা কাজে লাগিয়েছিল মিশরীয় লিপি অভিজ্ঞতাকে। পৃথিবীর প্রাচীনতম মহাকাব্য গিলগামেশ মহাকাব্য এ ভাষাতেই রচিত। মহাকাব্যের মূল গাঁথুনি স্বর্গ, মর্ত, নরক, দেবতা ও অমরত্বের সন্ধান। এতে মেসোপটেমিয়ার নগর জীবন, বাণিজ্য ও সাহিত্যের অভ্যন্তরীণ সম্পর্কও উঠে এসেছে।

অর্থনৈতিক অবস্থা


খৃস্টপূর্ব ৩য় সহস্রাব্দের দিকে মেসোপটেমিয়ার অর্থনীতি সচল থেকেছে কৃষিকাজ, পশুপালন ও বস্ত্রশিল্পের মাধ্যমে। খেজুর গাছের বিবিধ ব্যবহার ছিল জনপ্রিয়তার শীর্ষে। খেজুর গাছকে তারা বলত প্রাণ বৃক্ষ। খেজুর থেকে তৈরি হত ময়দা আর রুটি, আঁটি ব্যবহার হতো জ্বালানি হিসাবে। গাছের ছাল থেকে বানানো হত ঝুড়ি আর দড়ি।

দক্ষিণ মেসোপটেমিয়ার কাপড়ের গুণগত মান এতটাই ভাল ছিল যে, তা দেশ-বিদেশেও সুখ্যাতি অর্জন করেছিল। খাদ্যশস্য, খেজুর ও পশমের বিনিময়ে সংগ্রহ করত ধাতু, কাঠ ও পাথর। এঁটেল মাটি দিয়ে তারা বালতি, বাক্স, নল ইত্যাদি প্রয়োজনীয় জিনিস বানাত। খৃস্টপূর্ব চতুর্থ সহস্রাব্দে কারিগরেরা প্রথমে সোনা ও তামার ব্যবহার আয়ত্ব করার পর ব্রোঞ্জের ব্যবহার শুরু করে।

তথ্য মতে সুমেরীয়রাই প্রথম শহরকেন্দ্রীক বাণিজ্য গড়ে তোলে। কোন কেন্দ্রীয় সরকার না থাকায় সকল শহর সমান ক্ষমতা ও সুযোগ সুবিধা ভোগ করত। তৎকালীন নগরায়ন ও শহর ব্যবস্থাপনায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করত উড়ুক শহর। ৬০০০ বর্গমিটার আয়তনের এই শহর ছিল পৃথিবীর সবচেয়ে বড় শহর। জনসংখ্যা ও ছিল অনেক।

কৃষিপণ্য রপ্তানি করেই তারা নিজেদেরকে সমৃদ্ধ করেছিল। প্রাচীন মহাকাব্য গিলগামেশ ও বাইবেলে এ শহরের উল্লেখ পাওয়া যায়। মেসোপটেমিয়ার সাথে এ প্রাচীন শহরটিও এ সভ্যতার অংশ হয়ে আছে।

শ্রেণিবিন্যাস


মেসোপটেমিয়ার সমাজে শ্রেণিবিন্যাসের বর্ণনা পাওয়া যায়। সম্ভ্রান্ত পরিবার ও পুরোহিতরাই সিংহভাগ সুযোগ-সুবিধা ভোগ করত। তারা অর্থের বিনিময়ে রৌপ্য সংগ্রহ করে রাখত। এদের সেবা করার জন্য ছিল অনেক দাস-দাসী। যুদ্ধ বন্দীদের দাসে পরিণত করা হত। দাসদের এতই করুণ অবস্থা ছিল যে, মনিবের দিকে তাকাবার সাহস পর্যন্ত ছিল না।

চড়া সুদের প্রচলন ছিল। ধনীরা সবসময় চাষি ও কারিগরদের ঋণের জালে আটকিয়ে রাখত। ঋণ পরিশোধ করতে না পারলে তার পুরো পরিবারকে দাস হয়ে থাকতে হত। ভুমিহীনরা ধনীদের জমি ইজারা নিত। এভাবেই কৃষিকাজ পশুপালন ও বস্ত্র শিল্পের উন্নতির সাথে সাথে সমাজে শ্রেণীবিন্যাস তৈরি হয়েছিল।

প্রাচীনতম রাষ্ট্র


প্রায় প্রত্যেক শহরই ছিল স্বয়ংসম্পূর্ণ রাষ্ট্র। সেখানে প্রহরী, আমলা, জল্লাদ প্রভৃতি নিযুক্ত ছিল। নিরীহ জনগনের ওপর তারা অত্যাচার চালাত। নগর রাষ্ট্রের রাজারা একে অপরের সাথে যুদ্ধে মত্ত থাকত। যুদ্ধে জয়ী হলে সেই নগরীকে ধ্বংস করে দিত। আর বাসীন্দাদের যুদ্ধবন্দি করে দাস বানাত।

এ সময়ে ব্যাবিলনের ভৌগলিক অবস্থানের কারনে খুবই জনপ্রিয় হয়ে ওঠে। নদীপথে ব্যবসায়ীরা যাতায়াত করার সময় ব্যাবিলনে নেমে কেনা-কাটা বা পণ্য বিনিময় করত। দলে দলে কাফেলা যাতায়াত করত। ধীরে ধীরে ব্যাবিলন পরিণত হলো মেসোপটেমিয়ার বাণিজ্য নগরীতে, হয়ে গেলো একটি শক্তিশালী রাষ্ট্রের রাজধানী।

শাসন ব্যবস্থা


মোসোপটেমিয়ার শাসন ব্যবস্থায় সবচেয়ে উজ্জল হয়ে আছে ব্যাবিলন সাম্রাজ্যের সম্রাট হাম্বুরাবি। তিনি খৃস্টপূর্ব ১৭৯২-১৭৫০ পর্যন্ত দীর্ঘ ৪২ বছর ক্ষমতায় ছিলেন। গড়ে তুলেন বিশাল এক সৈন্যবাহিনী। কলহপূর্ণ বিভিন্ন রাষ্ট্রের মধ্যে থেকে শক্তিশালী রাষ্ট্রের সাথে জোট বেঁধে অন্যান্য নগর রাষ্ট্র দখল করতেন তিনি।

তারপর সুযোগ বুঝে নিজের মিত্র পক্ষের উপর ঝাঁপিয়ে পড়ে সর্বস্ব লুট করে নিতেন। বিরোধিতা করার মত তখন আর কেউ থাকত না। এভাবে পুরো মেসোপটেমিয়াকে পদানত করলেন সম্রাট হাম্বুরাবি। তার সময়ে আইন-কানুনের অনুশাসনও তৈরি হয়েছিল, যা ইতিহাসে ‘হাম্বুরাবি কোড’ নামে পরিচিত। এই আইনে প্রতিটি অন্যায়ের জন্য নির্দিষ্ট শাস্তি নির্ধারিত থাকত। প্রত্যেক নাগরিককে এই আইন মেনে চলতে হত। এই আইনকে স্থায়ী রূপ দেয়ার জন্য পাথরে খোদাই করা হয়েছিল।

প্রাচীনকালের এই মেসোপটেমীয় সভ্যতা কীভাবে বহুকাল আগ থেকেই গণতন্ত্র, বিজ্ঞান ও স্থাপত্যের রুচিশীল চিন্তা-চেতনার লালন করে আসছে তা ভাবলে অবাকই হতে হয়। তারাই প্রথম গড়ে তোলে গণতন্ত্র ও আইন-প্রয়োগের যথাযথ ব্যবহার। বর্তমান বিশ্বের উন্নত চিন্তাধারার ক্ষেত্রে প্রাচীন মেসোপটেমিয়ার যে অবদান তা অনস্বীকার্য।

এই পোস্টটি পরিচিতদের সাথে শেয়ার করুন

পূর্বের পোস্ট দেখুন পরবর্তী পোস্ট দেখুন
এই পোস্টে এখনো কেউ মন্তব্য করে নি
মন্তব্য করতে এখানে ক্লিক করুন

অর্ডিনারি আইটির নীতিমালা মেনে কমেন্ট করুন। প্রতিটি কমেন্ট রিভিউ করা হয়।

comment url