মায়া সভ্যতা জঙ্গলের ভিতর যেন আরেক প্রাচীন শহর

মধ্য আমেরিকার মেক্সিকো, গুয়াতেমালা, হন্দুরাস, বেলিজ এবং এল সালভাদর এই পাঁচ দেশের প্রায় তিন সহস্রাব্দীরও বেশি সময় জুড়ে গড়ে উঠেছিল মায়া সভ্যতা। এই এলাকায় ১১০০০ বছর আগে থেকে শিকারী যাযাবর মানুষদের বসবাসের সাক্ষ্য পাওয়া যায়।

মায়া সভ্যতা জঙ্গলের ভিতর যেন আরেক প্রাচীন শহর

মায়া সভ্যতা জঙ্গলের ভিতর যেন আরেক প্রাচীন শহর


পুরোনো ওলমেক ও এজটেক সভ্যতার উপর গড়ে উঠেছিল মায়া সভ্যতা। প্রায় ২৬০০ খৃস্টপূর্বাব্দে মেক্সিকোর ইয়াকাটুন উপদ্বীপে মায়া সভ্যতার প্রাচীনতম নিদর্শন পাওয়া যায়। প্রায় একই সময়ে বেলিজের কুয়েলোতে মায়া বসতি গড়ে উঠেছিল। ৩য় খৃস্টাব্দ এ প্রায় ৩ লক্ষ ১১ হাজার বর্গ কিলোমিটার আয়তন ছিল মায়া এলাকার।

জোতির্বিদ্যা, স্থাপত্যশিল্প, অংকশাস্ত্র, অঙ্কন ও চিত্রলিপি, ক্যালেন্ডার বা দিনপঞ্জির ব্যবহার প্রভৃতিতে মায়ারা বিশেষ অবদান রেখেছিল। দুরবীণ আবিস্কারের পূর্বে মায়ারা আকাশের তারকার একটি পরিব্যাপ্ত অঞ্চল শনাক্ত করেছিল। সঠিক ও নির্ভুলতার সাথে সৌর বছরের দৈর্ঘ পরিমাপ করেছিল। তারাই প্রথম ৩৬৫ দিনের বর্ষপঞ্জিকা তৈরি করেছিল।

জঙ্গল পরিস্কার করে চাষাবাদ শুরু করে কৃষিজীবী গ্রামের উৎপত্তি ঘটায়। মায়া সভ্যতা জঙ্গলের ভিতর যেন আরেক প্রাচীন শহর। এছাড়া রাস্তা তৈরি, জলাধার নির্মান, বুনন, মৃত্তিকা শিল্প প্রভৃতিতেও মায়ারা ছিল সমান দক্ষ।

মায়া সভ্যতার সময়কাল


অন্যান্য সভ্যতার মত মায়া সভ্যতারও আছে উত্থান-পতনের ইতিহাস। মায়া সভ্যতার কালকে মোটামুটি তিন ভাগে ভাগ করা যায়। প্রথমত: খৃস্টপূর্ব ১৮০০ শতাব্দী থেকে প্রশান্ত মহাসাগর সংলগ্ন অঞ্চলে গোড়াপত্তন হয় মায়া সভ্যতার। এই সময়ে তাদের মাটির তৈরি পাত্র এবং পোড়ামাটির সামগ্রীর সন্ধান পাওয়া যায়।

এই এলাকায় ২৫০ খৃস্টপূর্বব্দে মায়া ভাষার প্রথম চিত্রলিপির সন্ধান পাওয়া যায়। প্রিক্লাসিক পিরিয়ড টিকে থাকে ১০০ খৃস্টাব্দ পর্যন্ত। দ্বিতীয়ত: ৩য় খৃস্টাব্দ থেকে শুরু করে ১০ম শতাব্দী পর্যন্ত মায়া সভ্যতার কালকে বলা হয় ক্লাসিক পিরিয়ড। এ সময়টাকে বলা হয় মায়া সভ্যতার স্বর্ণযুগ। তৃতীয়ত: এর পরের সময় হল পোস্ট ক্লাসিক পিরিয়ড।

এ যুগে বড় বড় নির্মাণ এবং নগরবাদ, বিষ্ময়কর শিলালিপির লিপিবদ্ধ এবং উল্লেখযোগ্য বুদ্ধিবৃত্তিক এবং শিল্পকর্মের উন্নয়ন শিখরে পৌছায়। শহর রাজ্যের মধ্যে শহর কেন্দ্রিক সভ্যতা গড়ে উঠে। এ সময়কালে মায়ার জনসংখ্যা ছিল মিলিয়ন। প্রাসাদ এবং মন্দির তৈরি এবং চিত্রলিপিতে লেখার পদ্ধতি বিকশিত করেছিল।

সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য স্থাপত্য হল তাদের ধর্মীয় কেন্দ্রে নির্মিত ধাপে ধাপে পিরামিড এবং তাদের শাসকদের সহগামী প্রাসাদসমূহ। কানকুয়েন প্রাসাদ মায়া এলাকায় সর্ববৃহৎ কিন্তু এলাকায় কোন পিরামিড নেই। পাথর স্ল্যাবে তাদের বংশ তালিকা, সামরিক জয়লাভ ইত্যাদি চিত্রিত করে রাখত।

মায়া জনগোষ্ঠীর অন্তর্গত হচ্ছেন সেইসব মানুষ যারা প্রত্নতাত্ত্বিক সংস্কৃতির আধুনিক জনগণ। এরা সকলে মেক্সিকোর দক্ষিণে ও উত্তর-মধ্য আমেরিকায় বসবাস করত। এটি ছিল বিশ্বের সর্বাপেক্ষা ঘন জন বসতি এবং সংস্কৃতিভাবে গতিশীল একটি সমাজ।

যতদুর দেখা যায় মায়া অঞ্চল থেকে ১০০০ কিলোমিটারের চেয়েও বেশি দুরে মায়া সভ্যতার প্রভাবান্বিত শিল্প এবং স্থাপত্যের প্রভাব লক্ষ করা যায়। মায়া জনগন কখনো অন্তর্ধান হয়নি। আজ পুরো মায়া অঞ্চল জুড়ে মায়া এবং তাদের বংশধরদের বিস্তার। তারা আজও মায়া ভাষায় কথা বলে।

প্রায় ৬০০ খৃস্টপূর্বাব্দে এল মিরাডোর শহরে বিশাল বিশাল স্থাপত্যের নির্মাণকাজ শুরু হয়। তারা আধুনিক পদ্ধতিতে জলসেচের ব্যবস্থা করে চাষাবাদ শুরু করে। এই সময় টিকাল শহরে বসতি স্থাপন করে এবং এটি রাজধানীর পরেই মায়াদের বৃহত্তম শহরে পরিণত হয়। প্রায় ২৫০ খৃস্টপূর্বাব্দে প্রথম লিখিত শিলালিপি হায়ারোগ্লিফর চিহ্নিত করা হয়েছিল।

৪০০ খৃস্টপূর্বাব্দে তারা একটি শিলাস্তম্ভের উপর প্রথম মায়া জ্যোতিষ পঞ্জিকা তৈরি করে। মায়া সংস্কৃতি অন্যান্য সংস্কৃতিকে দারণভাবে প্রভাবিত করে।

মায়ানদের দৈনন্দিন জীবন


অভিজাত জীবন : একজন মায়া সম্রাট এবং অভিজাতদের জীবন অত্যন্ত সহজ ও বিলাসবহুল ছিল। তাদের এমনকি জামা কাপড় ছাড়া কিছু বহনও করতে হত না। তাদের সব ভার বহন করত সাধারণ মায়া অথবা অন্যান্য জাতি হতে আগত ক্রীতদাসরা।

সাধারণ জীবনযাত্রা : একজন মায়া সাধারণ মানুষের জীবন যেমন কষ্টকর তেমনি কঠিন পরিশ্রমের ছিল। মজদুররা সাধারণ কৃষাণ হিসাবে জীবিকা নির্বাহ করত। তাদের স্ত্রীরা রান্নাবান্না এবং সেলাইয়ের কাজে ব্যস্ত থাকত।

পোষাক : পোষাক তাদের সামাজিক স্তরের প্রকারভেদ এর ওপরে নির্ভর করত। অভিজাত ও সাধারণ মায়াদের পোষাক এক ছিল না। ধনী ও অভিজাতরা পশুর চর্ম ও লোম দিয়ে তৈরি বস্ত্র পরিধান করত। তারা মহামূল্যবান রত্ন ও সোনার গয়না পরতে পছন্দ করত।

সাধারণ মায়ারা নেংটি পরে থাকত। গ্রীষ্মকালে খালি গায়ে থাকলেও শীতকালে গায়ে পোষাক পরত। মেয়েরাও একই পোষাক পরে থাকত। তবে মেয়েরা লম্বা স্কার্ট গোছের পোষাক পরত। বিয়ের পর গায়ে উল্কি মেরে রাখত। বিশাল কেশরাজি বহন করত।

খাদ্য : মায়াদের কাছে প্রধান খাবার ছিল ভুট্টা বা মেইজে। তারা ভুট্টা দিয়ে সব রকম খাবার তৈরি করত। এমনকি ভুট্টা পচিয়ে মদও তৈরি করে খেত। শিম, সব রকমের শুঁটি, স্কোয়াশ, লঙ্কা খাদ্য হিসাবে গ্রহন করত। এছাড়া হরিণ, হাঁস, বক, টার্কি এবং মাছ খেত। তারা সমুদ্রের মাছ বেশি করে খেত। তেলাপিয়া ছিল তাদের প্রিয় মাছ।

মায়াদের কাছ থেকে বিশ্ব বিভিন্ন প্রকারের খাদ্য উপহার পেয়েছে। তারা মনে করত চকোলেট হল ঈশ্বরের অবদান। চকোলেট তৈরির বীজকে তারা মুদ্রার বিকল্প হিসাবে ব্যবহার করত।

বাড়িঘর : অভিজাত আর সম্রাটের আত্মীয় বর্গের লোকজন গ্রানাইট পাথরের বাড়িতে বসবাস করতেন। সেখানে বাগান বাড়ি ও বিরাট গোসলখানা থাকত। আর মায়া জনসাধারণ গ্রামে কৃষিক্ষেতের পাশে কুঁড়েঘরে থাকত। এগুলি এটেল মাটি দিয়ে তৈরি করা হত। বাড়ির ছাদ পাম গাছের পাতা দিয়ে ছাওয়া থাকত। তবে সব মায়াই মাটি থেকে উঁচুতে পাথর দিয়ে মাচা বানিয়ে তার উপর বাড়ি বানাত। সুনামি বা সামুদ্রিক জলোচ্ছাসের জন্যই এমন ব্যবস্থা প্রচলিত ছিল মায়া অঞ্চলে।

বিনোদন : অত্যন্ত কঠিন জীবনযাপনের মধ্যে ও তারা বিনোদনের ব্যবস্থা করত। বিশেষত ছুটির দিনে কিংবা ধর্মীয় দিবসে নাচতে, গাইতে এবং খেলতে খুবই উৎসাহ পেত। অনেকের ধারণা তারা ছিল ভলিবলের জনক।

ভাষা : মায়ানদের তৈরি পান্ডুলিপি থেকে জানা গেছে, ভাবের আদান-প্রদানের জন্য তারা একটি ভাষার ব্যবহার করত। কোন বর্ণমালা তাদের ছিল না। ছবি বা চিহ্ন ব্যবহার করা হত। প্রায় ৮০০ টির বেশি ছবি ব্যবহৃত হত তাদের লেখায়। গাছের বাকল দিয়ে তৈরি কাগজ দিয়ে বই বানাত। মায়ান সভ্যতার মাত্র ৪টি বই বা কোডেক্স উদ্ধার করা হয়েছে। এসব লেখা থেকে তাদের সংস্কৃতি আর সভ্যতার বেশ ধারণা পাওয়া যায়।

মায়া নগর রাষ্ট্র


মায়ারা বিভিন্ন নগর রাষ্ট্র মিলে এক বিশাল সাম্রাজ্য নির্মাণ করেছিল। প্রত্যেকটা শহর ছিল এক একটা নগররাষ্ট্র। তাদের খাজনায় চলত এইসব মায়া নগর রাষ্ট্র। প্রত্যেক নগর রাষ্ট্রের মাঝখানে সূর্য মন্দির বানানোটা ছিল খাঁটি মায়া রীতি। সব সূর্য মন্দির ছিল পিরামিডের ন্যায়। প্রত্যেক নগর রাষ্ট্রে একটা করে স্থানীয় রাজা বা আহাও থাকতো।

তিনি এক বিরাট রাজপ্রাসাদে বসবাস করতেন। তার সাথে রাজ পরিবারও থাকত। প্রত্যেক রাজপ্রাসাদের উত্তরে থাকতো একটা বাণিজ্য কুঠি, বড় রাস্তা এবং দক্ষিণ প্রান্তে থাকতো পিরামিড ও কৃষি জমি।

মায়াদের ধর্ম


মায়াদের জীবনযাপনের প্রতিটি ক্ষেত্রে ধর্মীয় বিশ্বাসের প্রয়োগ ছিল। তারা অনেক বেশি ধর্মবিশ্বাসী ছিল। তারা ঈশ্বরের ভয়ে সর্বদাই ভীত থাকত। তাদের লিখিত পুরাণ আর শিলালিপি এবং পোড়ামাটির পুঁথি হতে তাদের ধর্ম সম্বন্ধে জানা যায়। মায়ারা হিন্দুদের মতই বহু দেবতায় বিশ্বাস রাখত। তাদের কাছে সম্ভবত সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ দেবতার নাম ইটজাম্না।

মায়া পুরাণ অনুসারে তিনিই মহাবিশ্বের স্রষ্টা। মায়ারা তীব্রভাবে মৃত্যু পরবর্তী জীবন আছে বলে বিশ্বাস করত। তাদের সব পিরামিডই ছিল দেবতার প্রতি উৎসর্গিত। পিরামিডের চুড়ায় কেবল পুরোহিতরা উঠতে পারত। সেখানে তারা নরবলি এবং অন্যান্য ধর্মীয় অনুষ্ঠান পালন করত। সাধারণ মানুষদের মত রাজারাও সেখানে যেতে পারত না।

কেবল শুভ দিনগুলিতে রাজা এবং অভিজাতরা পিরামিডে উঠতেন। রাজার জন্মদিন উপলক্ষে বছরে একদিন মাত্র সাধারণ মানুষদের ওঠার সৌভাগ্য হত। মায়া বিশ্বাস অনুসারে সম্রাট হলেন ঈশ্বর ও মানুষের মধ্যে সংযোগ রক্ষাকারী। তারা রাজাকে স্রষ্টার পুত্র হিসাবে ভাবত।

মায়া সভ্যতার পতন


দক্ষিণাঞ্চলীয় নিচুভূমির অঞ্চলের মায়া কেন্দ্র ৮ম এবং ৯ম শতাব্দীতে পতন হয়। ৯২৫ খৃস্টাব্দের সময় বিখ্যাত মায়া নগররাষ্ট্র চিচেন ইৎজা খুবই প্রভাবশালী এবং ক্ষমতাধর হয়ে ওঠে। তারাই এ সময়ে মায়া সাম্রাজ্যের কার্যত রাজধানীতে রুপান্তরিত হয়ে আসে। পরবর্তী ২০০ বছর ধরে এটাই ছিল শ্রেষ্টতম মায়া শহর। এ সময়ে বিশ্ববিখ্যাত মায়ান পিরামিড চিচেন ইৎজাতে নির্মিত হয়।

মায়া সভ্যতার উত্থানের পেছনে যেমন ছিল কৃষির সাফল্য তেমনি আবার ব্যর্থতার পেছনেও ভূমিকা আছে কৃষির। মায়া পতনের মধ্যে অতিরিক্ত জনসংখ্যা, বিদেশী আক্রমণ, চাষি বিদ্রোহ এবং বিশেষ বাণিজ্য পথের পতন ইত্যাদি রয়েছে। তাদের বনভূমি কেটে চাষাবাদের ভূমিতে রূপান্তরের ফলে বাষ্প হ্রাস পায় এবং তাপমাত্রা ৬ ডিগ্রি বেড়ে যায়।

পরে বৃষ্টিপাত কমে যায় এবং খাদ্যের ব্যাপক ঘাটতি দেখা যায়, যা মায়া পতনের কারন হতে পারে বলে চিহ্নিত করা হয়। এছাড়া ২০০ বছরের দীর্ঘায়িত একটি তীব্র ক্ষরা মায়া সভ্যতার পতনের কারন। একই সঙ্গে আসে যুদ্ধ আর রাজনৈতিক অস্থিরতা। মায়া শহরগুলো পৃথক রাজা দিয়ে শাসিত হওয়ায় ঘন ঘন যুদ্ধ আর সংঘর্ষে জড়িয়ে পড়ে তারা।

১৬ শতকে স্প্যানিশরা মায়ায় আসার আগেই সভ্যতা ভেঙ্গে পড়েছিল। রোগ, দাসত্ব আর সাংস্কৃতিক দমনে তারা আরও ভেঙ্গে পড়ে। মায়ার মায়া ত্যাগ করে দুরদুরান্তে চলে যায়। মায়া সভ্যতা হয়ে পড়ে ইতিহাসের গল্প।

এই পোস্টটি পরিচিতদের সাথে শেয়ার করুন

পূর্বের পোস্ট দেখুন পরবর্তী পোস্ট দেখুন
এই পোস্টে এখনো কেউ মন্তব্য করে নি
মন্তব্য করতে এখানে ক্লিক করুন

অর্ডিনারি আইটির নীতিমালা মেনে কমেন্ট করুন। প্রতিটি কমেন্ট রিভিউ করা হয়।

comment url