চৈনিক সভ্যতা পৃথিবীর আদিম সভ্যতাগুলোর মধ্যে অন্যতম
চৈনিক সভ্যতা পৃথিবীর কয়েক হাজার বছরের আদিম সভ্যতাগুলোর মধ্যে অন্যতম। হোয়াংহো নদীকে চৈনিক সভ্যতার সুতিকাগার বলা হয়। হোয়াংহো ও ইয়াংসিকিয়াং নদীর অববাহিকায় গড়ে ওঠা অনেক আঞ্চলিক সংস্কৃতি চীনের সভ্যতাকে বিভিন্ন ভাবে সমৃদ্ধ করেছে।
খৃস্টপূর্ব ১৫০০ সাল থেকে চীনের শাং সাম্রাজ্যের (১০৪৬-১০৪৬) আমলের লিখিত ও গ্রহণযোগ্য ইতিহাস পাওয়া যায়। চীন পৃথিবীর ভূুমির প্রায় এক-চতুর্থাংশ জুড়ে এবং এটি প্রায় সমগ্র ইউরোপের সমান। চীন বিশ্বের সবচেয়ে জনবহুল দেশগুলির মধ্যে একটি, শুধুমাত্র ভারতের প্রতিদ্বন্দী। তবে জাতিসংঘের অনুমান অনুসারে জনসংখ্যার দিক থেকে ভবিষ্যতে এটিকে ছাড়িয়ে যাবে।
চৈনিক সভ্যতা পৃথিবীর আদিম সভ্যতাগুলোর মধ্যে অন্যতম
সভ্যতার ধারাবাহিক বিবর্তনে চীন সাম্রাজ্যকে চারটি যুগে চিহ্নিত করা হয়। প্রাচীন যুগের চীন, ইম্পেরিয়াল যুগের চীন, প্রজাতান্ত্রিক চীন এবং আধুনিক যুগের চীন। প্রাচীন যুগের চীন (খৃস্টপূর্ব ২১০০-৬০০ থেকে ১০৪৬-২২১ শতাব্দী পর্যন্ত) জিয়া, শাং ও ঝো এই তিন রাজবংশ শাসন করেছিল। ইম্পেরিয়াল যুগে (খৃস্টপূর্ব ২২১-২০৬ থেকে ১৬৪৪-১৯১২ সাল পর্যন্ত) চিন, হান উত্তর ও দক্ষিণের রাজবংশ ওয়ে ও জিন, সোয়ে, ট্যাং, সং, ইউয়ান, মিন ও চিং এই ১০ টি রাজবংশ চীন শাসনের মধ্য দিয়ে সাম্রাজ্যের বিস্তৃতি ঘটায়।
২২১ খৃস্টপূর্বাব্দে রাজা কিন শি হুয়াং বিভিন্ন যুদ্ধরত রাজ্যগুলোকে একত্রিত করে ছোট ‘সাম্রাজ্য’ (হুয়াংডি) প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। এর মধ্য দিয়েই চীনা সাম্রাজ্যের ইতিহাসের সূচনা হয়। সে সময়ের ১৩ টি রাজবংশের যুদ্ধবাজ নেতারা বর্তমান জিংজিয়ান ও তিব্বত পর্যন্ত বিস্তৃত সাম্রাজ্য শাসন করতেন।
চীনের সর্বশেষ সাম্রাজ্য ছিল চিং সাম্রাজ্য (১৬৪৪-১৯১২)। এই সাম্রাজ্যের উচ্ছেদের পর ১৯১২ সালে নানজিং-এ একটি অন্তর্বর্তীকালীন সরকার গঠিত হয়। এর মধ্যদিয়ে চীনের ২০০০ বছরের রাজশাসনের সমাপ্তি ঘটে। ১৯২১ সালে চীনা কমিউনিস্ট পার্টি প্রতিষ্ঠিত হয়। এই পার্টি নানা রকমের সংস্কার ও পরিবর্তন করে প্রজাতান্ত্রিক চীনের শাসনকাল শুরু করে।
১৯৪৯ সালের মধ্যে চীনের অধিকাংশ অঞ্চল এই পার্টির অধীনে চলে আসলে চীনে গৃহযুদ্ধের সমাপ্তি ঘটে। এর পরই সমাজতান্ত্রিক বিপ্লবের মধ্য দিয়ে রিপাবলিকানদের বিতাড়িত করে কমিউনিস্ট পার্টির ক্ষমতা প্রতিষ্ঠিত হয়। এরই ধারাবাহিকতায় বর্তমান চীন পুঁজিবাদী রাষ্ট্র হিসাবে বিশ্বের অন্যতম পরাশক্তিতে পরিণত হয়েছে। প্রায় ৯৬ লাখ বর্গকিলোমিটার আয়তনের চীনে ১৪২ কোটি মানুষের বাস।
বিভিন্ন রাজবংশের শাসিত অঞ্চলসমূহ
ঝাউ রাজবংশের (১০৪০-২৫৬ খৃস্টপূর্ব) আমলে চীনের সংস্কৃতি, সাহিত্য ও দর্শনের প্রভূত উন্নতি হয়। খৃস্টপূর্ব ৮ম শতাব্দী থেকে ঝাউ শাসকরা নানা রকম অভ্যন্তরিন ও বাইরের চাপের কাছে নতি স্বীকার করতে শুরু করে এবং এক সময় ছোট ছোট রাজ্যে বিভক্ত হয়ে পড়ে। এই সময়টি ছিল চীনের ইতিহাসে অন্যতম ব্যর্থ শাসনামল। এই ব্যর্থ সর্বশেষ সময়টি ছিল ১৯২৭ সালে চীনের গৃহযুদ্ধের সময়।
বহু রাজ্য ও যুদ্ধবাজ নেতাদের শাসনামলে চৈনিক রাজবংশগুলো বর্তমান চীনের অংশবিশেষ শাসন করত। চৈনিক ইতিহাসের পর্যায়ক্রমে রাজনৈতিক ঐক্য এবং অনৈক্যের চিত্র দেখা যায়, আরও দেখা যায় যে স্তেপ জাতি দ্বারা চীন শাসিত হবার ইতিহাস। পৃথিবীর বিভিন্ন প্রান্তের সংস্কৃতি ও রাজনৈতিক প্রভাব, অভিবাসন, বৈদেশিক বাণিজ্য ও চুক্তি ইত্যাদি আধুনিক চীনের সংস্কৃতি গঠনে ভূমিকা পালন করেছে। চীনে প্রথম বারুদের ব্যবহার হয়।
পৌরানিক চীন
চৈনিকদের লোকগাঁধা থেকে জানা যায়, পৃথিবী সৃষ্টির আগে সবকিছু ছিল খুব বিশৃঙ্খল। এ অবস্থা থেকে ইয়াং ও ইন নামের দুইটি শক্তির জন্ম হয়। এ শক্তি দুটি সাদা ও কালো রংঙের একটি বৃত্তের মধ্যে চক্রাকারে ঘুরতে থাকে। বৃত্তের কালো অংশ থেকে সৃষ্টি হয় নারী সত্ত্বা আর সাদা অংশ থেকে সৃষ্টি হয় পুরুষ সত্ত্বা।
এদের থেকে জন্ম হয় পানকু নামের এক বিরাট আকারের মানুষ। এই পানকু আসলে পৃথিবীর একটি রূপ। এই পানকুকে খুশি করার জন্য চন্দ্র, সূর্য ও তারা সৃষ্টি করা হয়। ফিনিক্স পাখি, কালো কচ্ছপ আর ড্রাগন হল পানকুর সহকারী। ড্রাগনকে তাদের সৌভাগ্যের প্রতীক হিসাবে বিশ্বাস করা হত।
পুরাতন প্রস্তর যুগ
প্রায় দশ লাখ বছর পূর্বে হোমো ইরেক্টাস নামে মানুষের একটি প্রজাতি চীনের ভূখন্ডে বসবাস করত। সাংঝি প্রদেশে হোমো ইরাক্টাসদের আগুন ব্যবহারের প্রমাণ পাওয়া গেছে, যা ১.২৭ মিলিয়ন বছর পুরাতন প্রত্নস্থান খননের পর সেখানে প্রাচীন মানুষের আবাসের প্রমাণ পাওয়া যায়। এদের মধ্যে ১৯২৩-২৭ সালে প্রাপ্ত হোমো ইরাক্টাস জাতির প্রাচীন মানুষের কঙ্কালটি সবচেয়ে পরিচিত যা তথাকথিত পিকিং মানুষ হিসাবে পরিচিত।
নবপ্রস্তর যুগ
খৃস্টপূর্ব ১০,০০০ বছর আগের সময়কালকে নবপ্রস্তর যুগ বলা হয়। সবচেয়ে পুরাতন প্রাক-চৈনিক যুগের কৃষিকাজ হিসাবে মিলেট চাষের যে নিদর্শন পাওয়া যায় তার কার্বন ডেটিং অনুসারে উৎপাদিত হয়েছিল আনুমানিক খৃস্টপূর্ব ৭০০০ সালে। একই ভাবে ৮০০০ বছর পুরাতন ধান রোপনের প্রমাণ পাওয়া যায়। জিহাউ সংস্কৃতি (৭০০০-৫৮০০ খৃস্টপূর্বাব্দ) ছিল কৃষিভিত্তিক।
ব্রোঞ্জযুগ
Majiayao সংস্কৃতির প্রত্নস্থানে খৃস্টপূর্ব ৩১০০ থেকে ২৭০০ এর মধ্যবর্তী সময়ের পুরাকীর্তি পাওয়া গেছে। চীনের সর্ব উত্তরের অঞ্চলে নিম্ন Xiajiadizn সংস্কৃতিতেও ব্রোঞ্জ যুগের আরও নিদর্শন পাওয়া গেছে।
চীনের মহাপ্রাচীর
খৃস্টপূর্ব ৫ম শতাব্দী থেকে ১৬শ খৃস্টাব্দ পর্যন্ত চীনের উত্তর সীমান্ত রক্ষার জন্য এই প্রাচীর নির্মান করা হয়। প্রথম চীন সম্রাট শি হুয়াং এই প্রাচীর নির্মাণ শুরু করেন। এই মহা প্রাচীরের দৈর্ঘ ২১,১৯৬ কিমি। উচ্চতা ৫ থেকে ৮ ফুট এবং চওড়ায় প্রায় ৩২ ফুট। কথিত আছে এই প্রাচীরের উপর দিয়ে একসাথে ১২ জোড়া ঘোড়া চলতে পারত।
এটি শুরু হয়েছে সাংহাই পাস এবং শেষ হয়েছে লোপনুর নামক স্থানে। পাথর ও মাটি দিয়ে তৈরি দীর্ঘ প্রাচীর সারি। এগুলি খৃস্টপূর্ব ৫ম শতক থেকে খৃস্টীয় ১৬শ শতক পর্যন্ত চীনের উত্তর সীমান্ত রক্ষা করার জন্য তৈরি হয়। প্রাচীন চীনের উত্তর সীমান্ত থেকে প্রায়ই চীনের ভূখন্ডে হামলা হত। এই হামলা বাধা দানের জন্য বিভিন্ন সময়ের রাজারা এই প্রাচীর নির্মাণ করেছিলেন।
রেশম
সর্বপ্রথম চীনে রেশমগুটির চাষ শুরু হয়। সম্ভবত খৃস্টের জন্মের ৩৫০০ আগে থেকেই চীনারা রেশমের ব্যবহার করত। প্রাচীন চীনে রাজপরিবার ও ধনাঢ্য ব্যক্তিরাই কেবল রেশমের কাপড় ব্যবহার করত। কোন কিছু লেখার জন্য রেশম ব্যবহার হত। চীন থেকে আস্তে আস্তে জাপান, কোরিয়া ও ভারতে এর চাষ ছড়িয়ে পড়ে।
চৈনিক সভ্যতা পৃথিবীর আদিম সভ্যতাগুলোর মধ্যে অন্যতম। বিশ্বসভ্যতার উন্নয়নে চীনা সভ্যতার অগনিত অবদান রয়েছে। কম্পাস, কাগজ, গান পাউডার, সিল্ক, নুডলস, চীনামাটির বাসন, কাগজের টাকা এবং আরও নানান জিনিস যা আমরা প্রাত্যহিক জীবনে ব্যবহার করি এসব চীনা সভ্যতার অবদান। আধুনিক যুগ পর্যন্ত টিকে থাকা অল্পকিছু সভ্যতার মাঝে এটি একটি সভ্যতা।
চীনারা তাদের জীবনপ্রণালী বিস্তারিতভাবে সংরক্ষণ করে রাখায় তাদের ব্যাপারে খুব সামান্যই অজানা রয়েছে। চীনা সভ্যতার প্রভাব এর পার্শ্ববর্তী অঞ্চলসমূহেও পড়েছির। জাপান, কোরিয়া মঙ্গোলিয়া এবং ভিয়েতনাম অঞ্চলেে এই প্রভাব ছিলো সবচেয়ে বেশি।
তাদের ধর্মীয় বিশ্বাস
ব্রোঞ্জ যুগে অধিকাংশ চীনারা অনেক ঈশ্বর এবং আত্মার উপাসনা করত। সকল দেব-দেবী প্রাকৃতিক কিছুর প্রতিনিধিত্ব করতো যেমন ‘মাটির দেবতা’। পুরোহিতগণ ঈশ্বর এবং তাদের উপাসকদের মাঝে সেতু হিসাবে কাজ করতেন। ব্রোঞ্জ যুগের পরে চীনা ধর্মে তিনটি বিশ্বাস গুরুত্বপূর্ণ হয়ে ওঠে। চীনে স্থানীয়ভাবে তাওবাদ এবং কনফুসিয়াসবাদ গড়ে ওঠে। তৃতীয় বিশ্বাস হলো বুদ্ধ ধর্মবিশ্বাস যেটি ভারতীয় সন্নাসীগণ চীনে নিয়ে যান।
সিদ্ধার্থ গৌতম আনুমানিক ৫০০ খৃস্টপূর্বাব্দে বুদ্ধ ধর্ম প্রতিষ্ঠা করেন। তাই তাকে বুদ্ধ বা আলোকিত বলা হয়। সিল্ক রোড দিয়ে বৌদ্ধ ধর্ম চীনে পৌছায়। বৌদ্ধ ধর্ম নিজের পছন্দ এবং ইচ্ছা ত্যাগের শিক্ষা দেয়। ধ্যান এবং সঠিক জীবন পরিচালনার মাধ্যমে একজন বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বী দুঃখ-দুর্দশা থেকে মুক্তি পেতে পারে।
চীনের ইতিহাস যেমন পুরনো তেমনি পুরনো তাদের ঐতিহ্য, সংস্কৃতি, সভ্যতা ও আবিস্কার। শিল্পকলাসহ জ্ঞান-বিজ্ঞানের সর্বক্ষেত্রেই এ সভ্যতার মানুষ নানামুখী অবদান রেখেছিল। চৈনিক সভ্যতাই পৃথিবীর একমাত্র সভ্যতা যেটি খৃস্টপূর্ব ২০০০ অব্দ থেকে আজ পর্যন্ত সাংস্কৃতিক ধারাবাহিকতা বজায় রাখতে সক্ষম হয়েছে।
অর্ডিনারি আইটির নীতিমালা মেনে কমেন্ট করুন। প্রতিটি কমেন্ট রিভিউ করা হয়।
comment url