মৃত সাগর বিষ্ময়কর বিভিন্ন বিষয়ের মধ্যে অন্যতম
ডেড সি বা মৃত সাগর ! গা ছমছম করা এক অনুভূতি। যেখানে ভাসছে লাশ আর লাশ। আসলে মোটেও তা নয়। বরং ভীষণ সুন্দর। প্রাচীন আমলের বিরল নিদর্শন দেখার জন্য চমৎকার একটি স্থান। এই মৃত সাগরের পানি এতটাই ঘন যে কেউ চাইলে শুয়ে থাকতে পারে। মৃত সাগর বিষ্ময়কর বিভিন্ন বিষয়ের মধ্যে একটি অন্যতম বিষ্ময়।
মৃত সাগর বিষ্ময়কর বিভিন্ন বিষয়ের মধ্যে অন্যতম
পৃথিবীর বুকে সবচেয়ে লবনাক্ত জলাশয় গুলোর মধ্যে একটি। সাগর বলা হলেও এটি মূলত একটি লেক যার সর্বোচ্চ গভীরতা ১২৪০ ফুট। আয়তনে অনেক বড় বলে এর নামের সাথে সাগর শব্দটি যুক্ত হয়ে গেছে। এর দৈর্ঘ প্রায় ৬৭ কিলোমিটার এবং প্রস্থ ১৮ কিলোমিটার। এটি জর্ডানে অবস্থিত। ডেড সী’র পূর্ব সীমান্তে জর্ডান এবং পশ্চিম সীমান্তে যথাক্রমে ইসরাইল ও প্যালেস্টাইন।
মৃত সাগর সমুদ্র পৃষ্ঠ থেকে ১৩৭৮ ফুট নিচে অবস্থিত। এই স্থানটি পৃথিবীর সবচেয়ে নিম্নতম স্থান। এই সাগরের পানির লবণাক্ততা শতকরা ৩০ ভাগ যা অন্যান্য সমুদ্রের পানির ৮.৬ গুণ বেশি।
ডেড সি বা মৃত সাগর নাম কেন হলো ?
সাগরের পানির লবণাক্ততার কথা আমরা সবাই জানি। সাগরের পানির লবণাক্ততার তুলনায় সাড়ে আট গুণ বেশি। এত নোনতা পানিতে কোন মাছ বা সাগরের নিচে কোন গাছ বাঁচতে পারে না। তাই এত বিশাল হ্রদে নাই কোন মাছ বা পানির নিচে নাই কোন গাছপালা। আর সে কারনেই এই হ্রদকে বলা হয় ডেড সি বা মৃত সাগর।
মাছ বা জীবন্ত কোন প্রাণী না থাকলেও এই হ্রদে বসবাস করে নানা রকমের ব্যাকটেরিয়া আর ছত্রাক। মৃত সাগরের পানি কিন্তু মোটেও বিষাক্ত নয়। শুধু মাত্র অতিরিক্ত লবণাক্ততার কারণে এখানে কোন প্রাণী বাঁচতে পারে না। অন্য কোন কারনে নয়। তেমনিভাবে এর পাশে জর্ডান নদীতেও কোন মাছ নাই। এই পুরো অঞ্চলটি স্বাস্থ্যের জন্য অনেক ভালো।
এখানকার আবহাওয়া অনেক রোগ সারিয়ে তোলার জন্য ভালো এবং সূর্যস্নান করার জন্যও একেবারে উপযুক্ত স্থান। তাই পর্যটকদের কাছেও দিন দিন জনপ্রিয় হয়ে উঠছে। যারা পরিবেশ বান্ধব ও স্বাস্থ্যের উন্নতির জন্য বিভিন্ন স্পট খুঁজে বেড়ান তাদের জন্য এটা এক টুকরা স্বর্গ সদৃশ।
কোন কিছু ডুবে না কেন ?
গবেষণায় দেখা গেছে মৃত সাগরের পানিতে মিশে থাকা লবণে ১৪% ক্যালসিয়াম ক্লোরাইড, ৪% পটাসিয়াম ক্লোরাইড, ৫০% ম্যাগনেসিয়াম ক্লোরাইড এবং ৩০% সোডিয়াম ক্লোরাইড আছে। এই সকল উপাদানের কারনে মৃত সাগরের পানির ঘনত্ব অনেক বেশি হওয়ায় পানির প্লবতা শক্তি পৃথিবীর অন্যান্য সকল নদী বা সাগরের পানির চেয়ে অনেক বেশি।
আর এই উচ্চ প্লবতা শক্তির কারনে এই সাগরে কোনো কিছু ডুবে না। যে কেউ এই মৃত সাগরের পানিতে ভেসে থাকতে পারে। যুক্তরাষ্ট্রের ইউটাহ তে অবস্থিত গ্রেট সল্ট লেকেও একই ভাবে ভেসে থাকা যায়।
চিকিৎসা ক্ষেত্রে ডেড সি
প্রাচীনকাল থেকে এই হ্রদটি মমি তৈরির জন্য এবং সার তৈরির জন্য পটাশ সহ বিভিন্ন প্রাকৃতিক খনিজ পদার্থের উৎস হিসাবে ব্যবহৃত হয়ে আসছে। এখানকার লবণ ও খনিজ পদার্থ বিভিন্ন প্রসাধনী সুগন্ধি দ্রব্য তৈরিতে ব্যবহার করা হয়। মৃত সাগর অঞ্চলটি বর্তমানে চিকিৎসা শাস্ত্রের গবেষণা স্থল হয়ে উঠছে। কারন হ্রদের পানিতে খনিজ দ্রব্যাদির বিপুল উপস্থিতি, উচ্চ ভূমণ্ডলীয় চাপ, সৌর বিকিরণে অতি বেগুনি উপাদানের কম উপস্থিতি। শ্বাসকষ্ট ও চর্ম রোগীদের জন্য সূর্যস্নান বেশ উপকারী।
ডেড সি তীরবর্তী পাহাড়ি অঞ্চলে উট, খরগোস, খেঁকশিয়াল এমনকি চিতাবাঘ ও দেখতে পাওয়া যায়। অতীতে জর্ডান নদী অঞ্চলে প্যাপিরাস এবং পাম গাছে সমৃদ্ধ বনভূমি ছিল। রোমান এবং বাইজেনটাইন সাম্রাজ্যের সময় ইক্ষু, সিকামোর এবং হেনা এ অঞ্চলের উদ্ভিদ বৈচিত্রে সমৃদ্ধি এনে দিয়েছিল। জেরিকোতে বেলসাম গাছের রস থেকে প্রস্তুত করা হত উন্নত মানের পারফিউম এবং সুগন্ধি।
ডেড সি’র ইতিহাস
প্রায় তিন মিলিয়ন বছর পূর্বে বর্তমান জর্ডান নদী, মৃত সাগর এবং ওয়াদি আরাবাহ অঞ্চল লোহিত সাগরের পানিতে বারবার প্লাবিত হত। এর ফলে একটি সরু উপসাগরের সৃষ্টি হয়। উপসাগরটি জেজরিল উপত্যকায় একটি সরু সংযোগের মাধ্যমে লোহিত সাগরের সাথে যুক্ত ছিল। প্রাকৃতিক তত্ত্ব অনুযায়ী প্রায় ২ মিলিয়ন বছর পূর্বে উপত্যকা এবং ভূমধ্যসাগরের মধ্যবর্তী স্থলভাগ যথেষ্ট উচ্চতা লাভ করে। ফলে মহাসাগরের প্লাবনে এই অঞ্চলে সৃষ্ট উপসাগরটি পরিবেষ্ঠিত হয়ে হ্রদে পরিণত হয়।
৭০,০০০ বছর পূর্ব থেকে ১২,০০০ বছর পূর্ব পর্যন্ত ডেড সি,র পানির উচ্চতা বর্তমান উচ্চতার চাইতে ১০০ থেকে ২৫০ মিটার বেশি ছিল। ১০,০০০ বছর পূর্বে এর পৃষ্ঠ উচ্চতা নাটকীয়ভাবে কমতে শুরু করে। গত কয়েক হাজার বছর ধরে এর পানির পৃষ্ঠ উচ্চতা মোটামুটি ৪০০ মিটারের আশেপাশে অবস্থান করছে।
ডেড সি বা মৃত সাগরের রহস্য
এখন থেকে প্রায় ৩১০০ বছর পূর্বে বর্তমান জর্ডান ও ইসরাইলের মধ্যবর্তী স্থানে অবস্থিত ডেড সি বা মৃত সাগরের স্থানটিতেই ছিল সাদূম গোত্রের আবাসস্থল সদম ও গোমরা নগর। এই নগরের অধিবাসীরা ব্যাপক সমকামিতায় জড়িয়ে পড়লে মাহান আল্লাহ তাদের সংশোধনের জন্য তাদের নিকট লুত (আঃ) কে নবী হিসাবে পঠান।
কিন্তু সামুদ জাতি লুত (আঃ) এর আহবানে সাড়া না দিয়ে নিকৃষ্ট এই কু-কর্ম সমকামিতা চালিয়ে যেতে থাকে। আল্লাহর নবী নানা ভাবে তাদের বুঝিয়েও যখন মন্দ স্বভাব থেকে বিরত হচ্ছিল না, তখন মহান আল্লাহ তাদের উপর আসমান থেকে অগ্নীকুন্ড নিক্ষেপ করেন এবং তাদের নগরকে উল্টে দিয়ে গোটা জনপদকে ধ্বংস করে দেন।
হাজারো প্রাণের বিচরণ এবং কর্মচঞ্চলতায় মুখর আস্ত একটি জনপদ মহূর্তেই গজবে পরিনত হয়ে বিশাল এক হ্রদে পরিণত হয়। এই হৃদটিকেই পরবর্তীতে অতিরিক্ত লবণাক্ততার কারনে মৃত সাগর নামে ডাকা শুরু হয়। এ সাগরে আজ পর্যন্ত কোন মাছ বা জলজ প্রাণী বাঁচতে পারে না। পৃথিবীর মানুষের জন্য নিদর্শন হিসাবে আল্লাহ আজও রেখে দিয়েছেন এই ডেড সি বা মৃত সাগর। এই ধরনের জঘন্য কুকর্ম হতে মানবজাতিকে মুক্ত রাখতে আমাদের উচিত এখনই সর্বাত্মক প্রচেষ্টা চালিয়ে যাওয়া।
বিভিন্ন ধর্মে মৃত সাগর
ইসলাম ধর্মে : ডেড সি বা মৃত সাগরের এ অঞ্চলকে হযরত লুত (আঃ) এর অনুসারীদের আবাস স্থল হিসাবে চিহ্নিত করা হয়েছে। তৎকালীন সময়ে লুত (আঃ) এর অনুসারীরা সমকামিতার চরম পাপে লিপ্ত হয়েছিল। লুত (আঃ) বারবার এই পাপ কাজ হতে বিরত থাকার আদেশ প্রদান করে ব্যর্থ হলে আল্লাহর আদেশে ফেরেশতারা এই স্থানের ভূমি উল্টে দেন।
ফলে পাপিষ্ঠ জাতিটি মাটি চাপা পড়ে ধ্বংস হয়ে যায়। মাটি উল্টে দেয়ার কারনে এখানকার মাটি নিচে নেমে যায়। বর্তমানে এই স্থানটি পৃথিবীর সবচেয়ে নিচু স্থান। পবিত্র কোরআনে চমৎকারভাবে এই ঘটনা উল্লেখ করা হয়েছে- ‘আর আমি লুতকে পাঠিয়েছিলাম। তিনি তাঁর সম্প্রদায়কে বলেছিলেন, তোমরা এমন কুকর্ম করছ, যা তোমাদের আগে বিশ্বে কেউ করেনি। তোমরা তো কামতৃপ্তির জন্য নারী ছেড়ে পুরুষদের কাছে গমন করো, তোমরা সীমালঙ্ঘনকারী সম্প্রদায়।’ (সুরা: আরাফ-৮০-৮১)
খ্রিস্ট ধর্মে : মৃত সাগরের দুর্গম এ অঞ্চল বাইজেনটাইন শাসকদের আমল থেকে গ্রিক অর্থোডক্স সন্ন্যাসীদের আকৃষ্ট করতে শুরু করেছিল। এই সকল স্থানে খ্রিস্টানদের যাতায়াত ছিল বহু বছর ধরে। ওয়াদি কেল্টে অবস্থিত সেইন্ট জর্জ গির্জা এবং জুদাই মরুভূমিতে মারসাবা মন্দির খ্রিস্টানদের তীর্থস্থান।
ইহুদী ধর্মে : মৃত সাগরের উত্তর তীরবর্তী জেরিকো শহরের নামটি ইহুদী ধর্মগ্রন্থগুলিতে উল্লেখ করা হয়েচে। নবী আব্রাহামের সময়কালে ধ্বংসপ্রাপ্ত সোডম এবং গোমোরা শহর এবং তিনটি সমতল ভূমির শহর আদমাহ, জোবোইম এবং জোয়ার শহরের অবস্থান সম্ভবত মৃত সাগরের দক্ষিণপূর্ব উপকূলে বলে ধারণা করা হয়।
মৃত সাগর সম্পর্কে বাইবেলের ভবিষ্যদ্বাণী : বাইবেলে মৃত সাগরের লবণাক্ততা বিলুপ্ত হওয়া সম্পর্কে ভবিষ্যদ্বাণী করা হয়েছে যে, ‘মৃত সাগরের পানি স্বাদু হয়ে যাবে, এমনকি মাছের বসবাসের উপযোগী হয়ে উঠবে।’ জেকরিয়াহ’তে উল্লেখ আছে, ‘জেরুজালেমের পানি দুভাগ হয়ে যাবে, একভাগ জমা হবে পূর্ব সাগর বা মৃত সাগরে এবং অন্য ভাগ জমা হবে পশ্চিম সাগর বা ভূমধ্যসাগরে।’
প্রাকৃতিক সম্পদ ও পর্যটন স্থান
আন্তর্জাতিক বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানগুলোর বিনিয়োগের ফলে জর্ডান উপকূল ব্যাপকভাবে সমৃদ্ধ হচ্ছে। বিশ্বের বিভিন্ন দেশ এই সাগর থেকে মূল্যবান সম্পদ সংগ্রহ করছে। পটাশ, কস্টিক সোডা, ব্রোমিন, ম্যাগনেসিয়াম ধাতু এবং সোডিয়াম ক্লোরাইড এর মত অনেক মূল্যবান সম্পদ পাওয়া যায় এই সাগর অঞ্চলে। শুধু পটাশ বছরে উৎপাদন হয় ২ মিলিয়ন টন।
মৃত সাগরের পাশ দিয়ে চলে গেছে বিশ্বের সবচেয়ে নিচু হাইওয়ে যেটি ইসরাইল ও পশ্চিম তীরের মধ্য দিয়ে চলে গেছে। সেখানে বিভিন্ন হোটেল গড়ে উঠেছে। বিশ্বের বিভিন্ন দেশ থেকে প্রচুর পর্যটক ডেড সি দেখতে আসেন। ডেড সি’র পানিতে নেমে সাঁতার কাটেন, ডুবে যাওয়ার কোন ভয় নাই, শুধু ডুবে যাওয়ার মজা করেন। কেউ কেউ এই পানিতে শুয়ে শুয়ে পত্রিকা পড়ে সময় কাটান। রোগ নিরাময়ের আশায় এখানকার মাটি তাদের সমগ্র শরীরে লাগাতে দেখা যায়।
ডেড সি শুধু আনন্দ বা বিনোদনের একটি স্থান নয়। বহুকালের প্রাচীন বিশাল এই জলাধারটি সৃষ্টির পিছনের ইতিহাস জেনে তা থেকে আমাদের শিক্ষা নিতে হবে। যে সমকামিতার মত জঘন্যতম পাপাচারের কারণে এই ডেড সির সৃষ্টি, আজ সেই পাপাচারের অবাধ চাষ হচ্ছে পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে দেশে। ডেড সি বা মৃত সাগর দেখে মানুষ অবাক হয়।
মানুষের কাছে অতি বিষ্ময়কর ও বৈচিত্রপূর্ণ একটা বিষয়। মৃত সাগর বিষ্ময়কর বিভিন্ন বিষয়ের মধ্যে অন্যতম। শুধু আশ্চর্য হয়ে থেমে গেলে হবে না। এখান থেকে শিক্ষা গ্রহণ করতে হবে। তাছাড়া একই পাপাচার চলতে থাকলে আবারও কোনো মৃত সাগরের চেয়ে ভয়াবহ কোন গজব আসবেনা তার গ্যারান্টি কে দেবে ?
অর্ডিনারি আইটির নীতিমালা মেনে কমেন্ট করুন। প্রতিটি কমেন্ট রিভিউ করা হয়।
comment url