পারস্য সভ্যতা পৃথিবীর প্রাচীনতম ও বৃহৎ সাম্রাজ্য

পারস্য ইরানের প্রাচীন নাম। পারস্য শব্দটি এসেছে প্রাচীনকালের একটি ভাষা পার্স থেকে। পৃথিবীর ইতিহাসে আজ পর্যন্ত যতগুলো বৃহৎ এবং প্রভাবশালী সাম্রাজ্যের নাম পাওয়া যায় তার মধ্যে পারস্য সাম্রাজ্যের নাম অন্যতম। হাজার বছরের ইরানের ইতিহাস নিয়েই আজকের আলোচনা।

পারস্য সভ্যতা পৃথিবীর প্রাচীনতম ও বৃহৎ সাম্রাজ্য

পারস্য সভ্যতা পৃথিবীর প্রাচীনতম ও বৃহৎ সাম্রাজ্য


পৃথিবীর প্রাচীনতম সভ্যতা গুলির মধ্যে একটি হলো পারস্য সভ্যতা। একটা সময় ছিলো যখন সবচেয়ে শক্তিশালী সাম্রাজ্য ছিলো পারসিয়ানদের। মাত্র ২০০ বছরের শাসনে তারা ২০০ মিলিয়ন বর্গ মিটার অঞ্চল দখলে এনেছিলো। মিশর-গ্রিসের উত্তরাঞ্চল থেকে শুরু করে ভারতের পূর্বাঞ্চল তাদের দখলে ছিলো। পারসিয়ান সম্রাট দক্ষ রাজ্য পরিচালনা এবং সামরিক শক্তির জন্য সুপরিচিত ছিলেন।

পারস্য উপসাগরের উপকূল ঘেঁসে, উত্তর-পশ্চিম এবং দক্ষিণ-পূর্ব কোণ বরাবর সগৌরবে দাঁড়িয়ে রয়েছে জাগ্রোস পর্বতমালা। এই পর্বতমালার পাদদেশ থেকে পূর্ব দিকে ভারতীয় প্লেট পর্যন্ত বিস্তৃত ইরানি মালভূমি। ভৌগলিকভাবে ত্রিকোণাকৃতির এই অঞ্চল ১৯৩৫ সাল পর্যন্ত পারস্য নামে পরিচিত ছিল। যা আজকের দিনে ইরান নামে পরিচিত।

সাম্রাজ্যের সূচনা যেভাবে 


প্রাচীন পারস্য ছিলো প্রাচীন নিনেভের অসিরীয় সাম্রাজ্যের অধীনে। খৃস্টপূর্ব পাঁচ/ছয়’শ বছর আগে পারসিয়ানরা অসিরীয়দের হটিয়ে নিনেভ দখল করে নেয়। ইরান জাতিতে ছিলো আর্য। পারস্যবাসী আর্যরা পর্যায়ক্রমিকভাবে এক বিরাট সাম্রাজ্য স্থাপন করেন। ইতিহাসবিদগণ এই সময়কালকে চারটি প্রধান ভাগে ভাগ করেছেন- আকামেনিদ সম্রাজ্য, সেলুসিড সম্রাজ্য, পার্থিয়ান সাম্রাজ্য এবং সর্বশেষ সাসানীয় সাম্রাজ্য।

এদের বিখ্যাত রাজাদের নাম ছিলো কাইরাস, দারিয়ুস, জেরোক্সিস। ইতিহাসে এরা আকিমেনিড রাজবংশ নামে পরিচিত ছিলো। প্রায় ২২০ বছর পারসিয়ান আর্যরা এই বিশাল সাম্রাজ্য শাসন করে। এরপর মেসিডোনিয়ান সম্রাট আলেকজান্ডার এই সাম্রাজ্য ধ্বংস করে দেন।

সুবিস্তৃত ইরানি মালভূমিতে মূলত আর্য জাতির বিভিন্ন গোত্র খৃস্টপূর্ব ১০০০ অব্দের দিকে বসতি স্থাপন করে, যারা গরু, ছাগল, ভেড়া প্রভৃতি চরাত। এদের মধ্যে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ছিলো মেদেস ও পারসিক গোত্রদ্বয়। এদেরই এক গোষ্ঠীর প্রধান ছিলেন দ্বিতীয় সাইরাস যিনি সাইরাস দ্য গ্রেট নামে পরিচিত। খৃস্টপূর্ব ৫৫০ সালে বিভিন্ন গোত্রকে একত্র করতে সক্ষম হন।

একে একে শক্তিশালী রাজ্যগুলো জয় করেন। তার হাতে উৎপত্তি লাভ করা সাম্রাজ্যটিই পৃথিবীর প্রথম পরাশক্তি। ভৌগলিক অবস্থান, উন্নত শাসন ব্যবস্থা, শিল্প-সংস্কৃতি, স্থাপত্যকলা, বিজ্ঞান, প্রযুক্তি প্রভৃতি পরাশক্তি হওয়ার পেছনে মুল ভূমিকা পালন করেছিল।

সম্রাট সাইরাস ক্ষমতায় আরোহণ করেই’পারস্যের শাহ‘ উপাধি ধারণ করলেন এবং প্যাসারগাড শহরের গোড়াপত্তন করে সাম্রাজ্যের রাজধানী হিসাবে ঘোষণা করেন। তিনি ছিলেন অত্যন্ত দূরদৃষ্টিসম্পন্ন একজন শাসক। সাম্রাজ্যকে টিকিয়ে রাখার জন্য জনগণের আস্থা অর্জনের কারনে অধিকারকৃত রাজ্যগুলোর শাসন ব্যবস্থায় তেমন কোনো পরিবর্তন আনেননি।

৫৫৯ খৃস্টপূর্বাব্দে সাইরাস ব্যাবিলন জয় করেন। পরাজয়ের সংবাদ শুনে রাজা নবনিডাস শহর ছেড়ে পালিয়ে যায়। তবে নগরবাসীরা রীতিমতো উৎসব করে বরণ করে নেয়। ব্যাবিলন অধিকারের পর সাইরাসের নির্দেশে একটি শিলাস্তম্ভ নির্মিত হয় যাতে সাইরাসের গুণকীর্তন লিপিবদ্ধ ছিল। ইতিহাসে এটি সাইরাস সিলিন্ডার নামে পরিচিত।

ধর্মের প্রতি সাইরাস ছিলেন উদার। জনগণের স্বাধীনভাবে ধর্ম পালনের অধিকার ছিল। নির্বাসিত ইহুদীদের জেরুজালেমে ফেরার ব্যবস্থা করেন এবং ধ্বংসপ্রাপ্ত বায়তুল মুকাদ্দাস পুননির্মাণ করে দেন। এ জন্য বাইবেলে তার নাম উল্লেখ পাওয়া যায়। যেখানে স্রষ্টার প্রতিনিধি বলে উল্লেখ করা হয়েছে। ইতিহাসে যে দুজন ব্যক্তিকে পবিত্র কোরআনে বর্ণিত যুলকারনাইন বলে দাবি করা হয়, তাদের মধ্যে তিনি একজন। অপরজন হলেন সম্রাট আলেকজান্ডার দ্য গ্রেট।

আকামেনিদ সাম্রাজ্যের তৃতীয় সম্রাট দারিয়ুস দ্য গ্রেট সাম্রাজ্যকে সর্বাধিক বিস্তৃতি ঘটায়। মানব সভ্যতার ইতিহাসে গুরুত্বপূর্ণ তিনটি সভ্যতা- মেসোপটেমিয়া সভ্যতা, মিশরীয় সভ্যতা এবং সিন্ধু সভ্যতা এই সাম্রাজ্যের অন্তর্ভূক্ত ছিল। তিনি বিভিন্ন পরিমাপের একক নির্ধারণ এবং অভিন্ন মুদ্রাও চালু করেন। এ সময় সমগ্র পারস্য জুড়ে অসংখ্য রাস্তা নির্মিত হয়।

এরাই সর্বপ্রথম এশিয়া, ইউরোপ ও আফ্রিকার মাঝে সড়ক পথে যোগাযোগ স্থাপন করতে সক্ষম হয়। পৃথিবীর প্রথম ডাকসেবা তার আমলেই চালু হয়। এজন্যই দারিয়ুসকে পারস্য সাম্রাজ্যের শ্রেষ্ঠ শাসক হিসাবে গণ্য করা হয়।

গ্রিক -পারস্য যুদ্ধ ও আকামেনিদ সাম্রাজ্যের পতন 


গ্রিস ও পারস্যের মধ্যে বিভিন্ন সময়ে অনেকগুলো যুদ্ধ হয়েছিল। সম্রাট দারিয়ুসের সময়েই সর্বপ্রথম যুদ্ধটি সংঘটিত হয়। খৃস্টপূর্ব ৪৯০ এ এথেন্সের উত্তর-পূর্বে ম্যারাথন নামক স্থানে সংগঠিত হয়েছিল, যা ইতিহাসে ব্যাটল অফ ম্যারাথন নামে পরিচিত। এ যুদ্ধে পারসিকরা পরাজিত হয়। এ যুদ্ধের ১০ বছর পর সম্রাট জারজিসের আমলে ইতিহাসখ্যাত আরেকটি যুদ্ধ হয়।

এই যুদ্ধ ইতিহাসে ব্যাটল অফ থার্মোপাইলি নামে পরিচিত। এ সময়ই উত্থান ঘটে দিগ্বিজয়ী গ্রিক বীর আলেকজান্ডার দ্য গ্রেটের। সম্রাট তৃতীয় দারিয়ুসের সাথে তার কয়েকটি যুদ্ধ সংঘটিত হয়। অবশেষে ৩৩০ খৃস্টপূর্বাব্দে আলেকজান্ডারের হাতে পতন ঘটে প্রতাপশালী এই স্রাম্রাজ্যের।

পারসিক ধর্ম 


পারস্য সাম্রাজ্যের প্রধান ধর্ম ছিল জরথুস্ত্রবাদ। জরথুস্ত্র বা জরোয়েস্টার (খৃস্টপূর্ব ১৫০০-৫০০) এই ধর্মের প্রবক্তা। আহুরা মাজদা এই ধর্মের সর্বোচ্চ দেবতা। একেশ্বরবাদী এই ধর্মমতে জরথুস্ত্র ইশ্বর কর্তৃক প্রেরিত একজন বার্তাবাহক। অনুসারীদেরকে অনেক দেবতার উপাসনা না করে একক দেবতার উপাসনার শিক্ষা দেন। পারস্য সাম্রাজ্যের রাজাগণ ছিলেন জরথুস্ত্রবাদী ধর্মপ্রাণ। কিন্তু অন্যান্য ধর্মের প্রতিও ছিলেন উদার।

গ্রীক বীর আলেকজান্ডার দ্য গ্রেট দারিয়ুসকে পরাজিত করলে পারস্যে একিমেনিড রাজবংশের অবসান হয়। আলেকজান্ডারের মৃত্যুর পর তার রাজ্য তার সেনাপতিরা ভাগ বাটোয়ারা করে নেয়। ইরান বা প্রাচীন পারস্য কিছুকাল সেলুকাসের বংশ দ্বারা শাসিত হয়। তখন ভারতবর্ষে ছিল কুষান সাম্রাজ্য। গ্রীকরা এদের শাসন করলেও পারসিয়ানদের ধর্ম কিন্তু জরথুস্ত্রই থেকে যায়। খৃস্টের জন্মের তৃতীয় শতাব্দী পর্যন্ত এভাবে পারস্য ধর্মীয় এবং গ্রীক শাসিত ছিল।

মুসলমানদের পারস্য বিজয় 


মুসলিমদের পারস্য বিজয় সাসানীয় সাম্রাজ্যের পতন ঘটায়। এই বিজয়ের ফলে ইরানে জরথুস্ত্র ধর্মের প্রভাব কমে আসে। ৬৩৩ সালে মুসলিমরা সাসানীয় অঞ্চলে আক্রমণ করে। এ সময় খালিদ বিন ওয়ালিদ বর্তমান ইরাকের অংশ মেসোপটেমিয়ায় হামলা চালায়। সিরিয়ার রোমান যুদ্ধক্ষেত্রে খালিদকে বদলি করা হয়।

৬৩৬ সালে সাদ ইবনে আবি ওয়াক্কাসের নেতৃত্বে দ্বিতীয় পর্যায়ের অভিযান শুরু হয়। যুদ্ধ বিজয়ের মাধ্যমে সাসানীয় অঞ্চলে মুসলিমরা স্থায়ীভাবে আধিপত্য লাভ করে। পারসিয়ানদের ক্রমাগত আক্রমণের ফলে ৬৪২ সালে খলিফা উমর ইবনুল খাত্তাব সাসানীয় সাম্রাজ্যে পূর্ণ মাত্রায় আক্রমণের নির্দেশ দেন।

৬৫১ সালে এই জয় সম্পন্ন হয়। মদিনা থেকে এই অভিযানের সফল দিক নির্দেশনা দিয়ে সামরিক ও রাজনৈতিক প্রজ্ঞার পরিচয় দেন। আরবদের এই পারস্য বিজয়ের পর ইসলাম সেখানে প্রধান ধর্ম হিসাবে আত্মপ্রকাশ করে।

পারস্যকে আরবরা জয় করে নিলেও সিরিয়া মিশর যেভাবে আরবদের সাথে মিশে একাকার হয়ে যায়, ইরান কিন্তু তার থেকে ব্যাতিক্রম ছিল। আরবরা ছিল সেমেটিক জাতি আর ইরানিরা প্রাচীন আর্য বংশীয়।আরবী সংস্কৃতি দ্বারা ইরানিরা প্রভাবিত হলেও স্বাতন্ত্রতা ছিল দেখার মত। পারসিয়ানদের ভাষাও ছিল আলাদা।

জাতি হিসাবে ইরানিরা আরবদের থেকে পৃথক থাকলেও কিন্তু ইসলাম ধর্ম অচিরেই জরথুস্ত্র ধর্মকে কোন ঠাসা করে ইরান ইসলামের পতাকাতলে চলে আসল। জরথুস্ত্র ধর্মের আবশিষ্ট লোকেরা ভারতে এসে আশ্রয় নিল। ভারতে এরা পারসিক নামে পরিচিত।

পার্সেপোলিস ইরানের দক্ষিণে অবস্থিত পৃথিবীর সেরা প্রত্নতাত্ত্বিক স্থান সমূহের একটি। সম্রাট দারিয়ুস দ্য গ্রেট এটির গোড়াপত্তনকারী। পার্সেপোলিস আকামেনীয়দের শিল্প-সংস্কৃতিতে অবদান সগৌরবে জানান দেয়। আলেকজান্ডার দ্য গ্রেট এটি পুড়িয়ে দেন। ১৯৭৯ সালে ইউনেস্কো এটিকে ওয়ার্লড হেরিটেজ সাইট হিসাবে ঘোষণা করে। এখনো প্রতিবছর লক্ষ লক্ষ পর্যটক এখানে ভিড় জমায়।

তৎকালীন সময়ে পারস্য ধর্ম, সংস্কৃতি, স্থাপত্যশিল্প, কলা, বিজ্ঞান, প্রযুক্তি প্রভৃতির বৈশ্বিক কেন্দ্র হিসাবে আত্মপ্রকাশ করে। ধাতবশিল্প, বস্ত্রশিল্প, শৈলস্থাপত্যশিল্পে বিশেষ অগ্রগতি অর্জন করে। পাহাড়ের গায়ে খোদাই করে বিভিন্ন ভাস্কর্য, সমাধিক্ষেত্র নির্মাণ বিশেষ উল্লেখযোগ্য। নাকশে রুস্তম তার জ্বলন্ত প্রমাণ। এখানে দারিয়ুস দ্য গ্রেট, জারজিস, আর্তাজারজিস এবং দ্বিতীয় দারিয়ুস- এই চারজনের সমাধি রয়েছে।

১৮৭৬-১৮৮০ খৃস্টাব্দে তাজিকিস্তানের অক্সাস নদীর উপকুলে আবিস্কৃত হয় ধাতুর তৈরি ১৮০ টি মূল্যবান জিনিসপত্র। এতে পাওয়া যায় স্বর্ণ এবং রৌপ্য নির্মিত মুদ্রা, পানপাত্র, মূর্তি, আংটি, ছোট আকারের রথ, তলোয়ারের খাপ প্রভৃতি যাদের গায়ে সুন্দর নকশা অঙ্কিত। বর্তমানে এগুলি বৃটিশ জাদুঘরে সংরক্ষিত আছে।

শাসন ব্যবস্থা 


আকামেনীয়দের শাসন ব্যবস্থা ছিল অত্যন্ত সময়োপযোগী। সাইরাস দ্য গ্রেট প্রশাসনিক সুবিধার্থে তার সাম্রাজ্যকে ২৬ টি এবং দারিয়ুস দ্য গ্রেটের সময়ে ৩৬ টি প্রদেশে বিভক্ত করেন। প্রত্যেক প্রদেশে একজন করে গভর্নর নিযুক্ত হতেন। কর আদায়, আইন-শৃঙ্খলা রক্ষা, বিচারিক দায়িত্ব পালন করতেন।

চেঙ্গিস খা 


এক সময় বাগদাদ হয়ে ওঠে আরব খলিফাদের রাজধানী। নবম শতাব্দীতে বাগদাদ সাম্রাজ্য ভেঙ্গে যায় এবং এর টুকরা টুকরা অংশ নিয়ে বিভিন্ন রাজ্য গড়ে ওঠে। পূর্ব অঞ্চলের তুর্কি উপজাতিরা পারস্য দখল করে নেয়। বাগদাদের খলিফা তখনো টিকে থাকলেও তার কোন প্রভাব ছিল না। এরপর পারস্য সেলজুকদের অধীনে আসে। এদের সাম্রাজ্য টিকে ছিল দেড়শ বছর।

এরপর আরেক তুর্কি উপজাতি এসে সেলজুকদের হটিয়ে পারস্য দখল করে দ্বাদশ শতাব্দীর শেষ দিকে। এরা প্রতিষ্ঠিত করেছিল খোয়ারিশম রাজ্যের। কিন্তু এদের সময়কাল ছিল অতি অল্প সময়। কারন খোয়ারিশমের শাহ চেঙ্গিস খার দুতকে অপমানের প্রতিশোধ নিতে গিয়ে পুরা পারস্য ছারখার করে দেয় ১২২০ সালের কাছাকাছি সময়ের দিকে।

হালাকু খা 


চেঙ্গিস খার মৃত্যুর পর সন্তানদের মধ্যে তার রাজ্য ভাগ করে দেয়া হয়। পারস্য এবং এর আসপাস হালাকু খার ভাগে পড়ে। তাকে দিয়েই ইলখান রাজবংশের সূচনা হয়। এই ইলখান রাজারা প্রথমদিকে মোঙ্গলদের ‘পৌত্তলিক‘ ধর্মে থাকলেও পরে মুসলমান হয়। এই ইলখান রাজবংশ ধ্বংস হয় তৈমুর লং এর হাতে।

এর পর ইরান শাষিত হতে থাকে তৈমুর এর বংশধর তাইমুরিদ রাজাদের হাতে। এক পর্যায়ে পারসিয়ানরা এই দখলদার তাইমুরিদ রাজবংশের হাত থেকে মুক্তি পেতে চোরাগুপ্তা হামলা চালায় কিন্তু স্বাধীনতা আসতে ষোড়শ শতাব্দী পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হয়।

সাফাভিদ সাম্রাজ্য 


তাইমুরিদদের হটিয়ে আবার এক পারসিয়ান রাজা সিংহাসনে বসেন। এই রাজ বংশের নাম সাফাভি বা সাফাভিদ। এই রাজবংশ ছিল মোটামুটি ভারতের মোগল রাজাদের সম সাময়িক। ১৭২৫ সালের কাছাকাছি সময়ে এই সাফাভি রাজবংশের পতন হয়। পারসিয়ানদের অধীনে তখন আফগানরা শাষিত হচ্ছিল।

এই অফগানদের হাতেই সাফাভি সাম্রাজ্যের পতন ঘটে এবং আফগানরা ইস্পাহান দখল করে নেয়। কিন্তু অল্পদিন পরেই এক পারসিয়ান সেনাপতি নাদির শাহ আফগানদের পরাজিত করে সিংহাসনে বসেন। অষ্টাদশ ও উনবিংশ শতাব্দী ছিল পারসিয়ানদের জন্য এক চরম দুর্যোগময় সময়। কখনো বৃটেন কখনো রাশিয়ার হাতে এরা পুতুল হিসাবে কাজ করত ।

পারস্যের শাহরা এই সময় মুলত: অকর্মন্য ভোগ বিলাসে মত্ত থাকত। শিল্প বিপ্লবের কারনে ইইরোপে তেলের চাহিদা বেড়ে যাওয়ায় শাহের মাথায় হাত বুলিয়ে একটা কোম্পানির নামে ৬০ বছরের চুক্তি করে পুরা পারস্যের তেল তারা নিয়ে যায়। এক সময় পুতুল শাহের বিরুদ্ধে দেশের মানুষ ক্ষেপে উঠলে রাশিয়া ও বৃটেনের সেনাবাহিনী এসে শাহকে রক্ষা করে মুলত: পারস্যকে রাশিয়া ও বৃটেন দুই ভাগে ভাগ করে নেয়।

রেজা শাহ পাহলভি


প্রথম বিশ্ব যুদ্ধের সময় পারস্য নিরপেক্ষ থাকতে পারেনি। তাই দেশের মধ্যে ঢুকেই বিদেশীরা যুদ্ধ করতে লাগল। যুদ্ধ শেষ হলে ১৯২১ সালে রেজা খা নামক একজন সাধারণ পারসিক সৈন্য বিখ্যাত হয়ে উঠলেন। পুরা সেনাবাহিনীর ওপর প্রভাব বিস্তার করেন এবং নিজে প্রধানমন্ত্রী হন। ১৯২৫ সালে শাহকে ক্ষমতাচ্যুত করেন।

একটি শাসন ব্যাবস্থা পরিষদ গঠিত হয়। এই পরিষদই রেজা খাকে নতুন শাহ নির্বাচিত করেন এবং তিনি নিজে রেজা শাহ পাহলভি নাম ধারণ করেন। তিনি এক সরকারী প্রজ্ঞাপনের মাধ্যমে পারস্যকে ইরান নামে নাম করন করেন। এই হল আধুনিক ইরানের ইতিহাস।

পাস্যের কবি সাহিত্যিক


পারস্য সভ্যতা পৃথিবীর প্রাচীনতম ও বৃহৎ সাম্রাজ্যগুলির মধ্যে অন্যতম। পারস্য নিয়ে লিখতে গেলে ‘শাহনামা’র রচয়িতা ফেরদৌসী (৯৩২-১০২১) র কথা যার সৃষ্টি সোহরাব রুস্তম সহ অসংখ্য গাথা উপগাথা, পারস্যের কবি ওমর খৈয়াম, যাকে বলা হয় ইসলামী স্বর্ণযুগের শ্রেষ্ট কবি। সিরাজের কবি শেখ সাদী, যার লেখা গুলিস্তান এবং ‘বুস্তান’, ইবনে সিনা, আধ্যাত্মিক কবি জালালুদ্দীন রুমি, কবি হাফিজ, সহ আরো অনেক কবি সাহিত্যিক পারস্য তথা ইরানকে সমৃদ্ধ করেছে।

এই পোস্টটি পরিচিতদের সাথে শেয়ার করুন

পূর্বের পোস্ট দেখুন পরবর্তী পোস্ট দেখুন
এই পোস্টে এখনো কেউ মন্তব্য করে নি
মন্তব্য করতে এখানে ক্লিক করুন

অর্ডিনারি আইটির নীতিমালা মেনে কমেন্ট করুন। প্রতিটি কমেন্ট রিভিউ করা হয়।

comment url