রোমান সভ্যতা পৃথিবীর সবচেয়ে প্রাচীন বৃহত্তম সাম্রাজ্য

পৃথিবীতে যতগুলো প্রাচীন সভ্যতা বা সাম্রাজ্য আছে তাদের মধ্যে রোমান সাম্রাজ্য অন্যতম যা খৃস্টপূর্ব ৮ম শতাব্দীর প্রথমভাগে ইতালীয় উপদ্বীপে সূচিত হয়। রোম শহরকে কেন্দ্র করে ভূমধ্যসাগরের তীর ধরে এই সভ্যতা বিকশিত হতে থাকে এবং প্রাচীন যুগের বৃহত্তম সাম্রাজ্যে পরিণত হয়।

রোমান সভ্যতা পৃথিবীর সবচেয়ে প্রাচীন  বৃহত্তম সাম্রাজ্য

রোমান সভ্যতা পৃথিবীর সবচেয়ে প্রাচীন বৃহত্তম সাম্রাজ্য 


এই সভ্যতার দীর্ঘ স্থায়ীত্বকালের মধ্যে রোমান সভ্যতা একটি রাজতন্ত্র থেকে একটি সম্ভ্রান্ত প্রজাতন্ত্র এবং পর্যায়ক্রমে একটি একনায়কতন্ত্রী সাম্রাজ্যে পরিবর্তিত হয়। যুদ্ধ বিজয় এবং আত্তীকরণের মাধ্যমে ইউরোপ, এশিয়া এবং আফ্রিকা পর্যন্ত এ সাম্রাজ্য বিস্তৃত ছিল। ভূমধ্যসাগরীয় অঞ্চলের সবচেয়ে প্রভাবশালী সাম্রাজ্য এবং প্রাচীন বিশ্বের সবচেয়ে ক্ষমতাশালী সাম্রাজ্যগুলোর একটি।

সাম্রাজ্যটি একজন সম্রাটের নেতৃত্বে থাকা সরকার দ্বারা পরিচালিত হত। খৃস্টপূর্ব ১০০-৪০০ খৃ: পর্যন্ত রোম পৃথিবীর সবচেয়ে বৃহত্তম নগরী ছিল এবং রোমান সাম্রাজ্যের জনসংখ্যা ৫০-৯০ মিলিয়নে উন্নীত হয় যা সে সময়ের পৃথিবীর জনসংখ্যার প্রায় ২০% ছিল। এর আগে গৃহযুদ্ধ এবং রাজনৈতিক সংঘাতের ফলে রোমে বিরাজমান ৫০০ বছরের রোমান প্রজাতন্ত্রে চরম অস্তিরতা সৃষ্টি হয়।

এ সময়ে জুলিয়াস সিজারকে স্থায়ী ডিক্টেটর হিসাবে নিযুক্ত করা হয়। খৃস্টপূর্ব ৪৪ এ তাকে কয়েকজন ষড়যন্ত্রকারীরা হত্যা করে। ফলে সেখানে গৃহযুদ্ধ এবং হত্যালীলা চলতে থাকে। সীজারের পোষ্য পুত্র অক্টাভিয়ান খৃস্টপূর্ব ৩১ এ এক্টিয়ামের যুদ্ধে মার্ক এন্টনি এবং ক্লিওপেট্রাকে পরাজিত করে ক্ষমতায় অদমনীয় হয়ে উঠে। রোমান সিনেটে তাকে আনুষ্ঠানিকভাবে অসীম ক্ষমতা প্রদান করে এবং আউগুস্তস উপাধি প্রদান করে যা রোমান সাম্রাজ্যের শুরুর একটি মাইল ফলক।

রোমান রাজধানী বাইজেন্টাইনে স্থানান্তর 


খৃস্টপূর্ব ৭৫৩ সালে রোম প্রতিষ্ঠা করেন রাজা রোমুলাস। তিনি ছিলেন রোমের প্রথম রাজা। কয়েকশ বছরের মধ্যেই এটি একটি ধনী শক্তিশালী রাষ্ট্র হিসাবে বেড়ে ওঠে। রোমান সাম্রাজ্যের প্রথম দুই শতক রাজনৈতিক স্থিরতা ও সমৃদ্ধির কারনে এদের রোমান শান্তির যুগ হিসাবে অভিহিত করা হয়। অক্টেভিয়ানের বিজয়ের পর রোমান সাম্রাজ্যের পরিসর নাটকীয়ভাবে সম্প্রসারিত হয়।

রোমান সভ্যতা পৃথিবীর সবচেয়ে প্রাচীন বৃহত্তম সাম্রাজ্যে পরিনত হয়। ক্লডিয়াসের নেতৃত্বে রোমানরা ব্রিটানিয়াকে নিজ সাম্রাজ্যের অন্তর্গত করে। অক্টেভিয়ানের পর এটাই ছিল সর্ববৃহৎ রাজ্য বিস্তারের ঘটনা। ক্লডিয়াসের পরবর্তী সম্রাট নীরো ৬৮ সালে আত্মহত্যা করায় পুনরায় রাজনৈতিক অস্থিরতার উদ্ভব হয়।

ডিয়ক্লেটিয়ানের শসনামলে দেশ চার ভাগে ভাগ করে প্রত্যেকটি অংশে একজন নির্দিষ্ট শাসনকর্তা নিয়োগ করা হয়। যার ফলে দেশে পুনরায় স্থিরতা আসলেও প্রথম কনষ্টেণ্টাইন এর শাসনামলে গৃহযুদ্ধের মাধ্যমে এর অবসান হয় এবং তিনি একচ্ছত্র সম্রাট হিসাবে অধিষ্ঠিত হয়ে রোমান রাজধানী বাইজেন্টাইনে স্থানান্তর করেন।

নগরীর পতনের আগ পর্যন্ত এটি ছিল প্রাচ্যের রাজধানী। তিনি খৃস্টান ধর্ম গ্রহণ করার পর রাষ্ট্রধর্ম হিসাবে এটা গৃহীত হয়। সাম্রাজ্যের পূর্বাঞ্চল (বাইজেন্টাইন) বিশ্বের এক অগ্রণী শক্তি হিসাবে পরিনত হয়। সংযুক্ত রোমান সাম্রাজ্যের শেষ সম্রাট প্রথম থিয়ডসিয়ার মৃত্যুর পর ক্ষমতার অপব্যবহার, গৃহযুদ্ধ, বহিরাগ্রাসন, অর্থনৈতিক মন্দা ইত্যাদি কারণে রোমান সাম্রাজ্য ক্রমশ শক্তি হারাতে থাকে।

অথচ এটি ছিল অর্থনৈতিক, সাংস্কৃতিক, রাজনৈতিক এবং সামরিক ক্ষেত্রে সেই সময়কার সবচেয়ে শক্তিশালী এবং সমৃদ্ধিশালী সাম্রাজ্যসমূহের অন্যতম। ট্রাজানের সময়কালে এর আয়তন ছিল ৫০ লাখ বর্গ কািলোমিটার। এ সময়ই ল্যাটিন এবং গ্রীক ভাষা, সংস্কৃতি, ধর্ম, আবিস্কার, স্থাপত্য, দর্শন, আইন এবং সরকার গঠনের বিস্তৃতি এবং স্থায়ীত্ব নিশ্চিত করেছিল।

কীভাবে স্থায়ী রাস্তা বানাতে হয় সেই পন্থা ও তারা শিখিয়েছে। তাদের ‘দ্য ল অব টুয়েলভ টেবলস’ থেকেই জন্ম নিয়েছে আধুনিক সিভিল আইন। প্রাচীন যুগের অন্যতম বিখ্যাত স্থাপনা হলো কলোসিয়াম। রোমের ঠিক কেন্দ্রে নির্মিত হয় এ মুক্তমঞ্চ। বিভিন্ন খেলা, অনুষ্ঠান কিংবা গ্ল্যাডিয়েটরদের যুদ্ধ দেখতে কলোসিয়ামে ভিড় জমাতেন নাগরিকরা।

সাম্রাজ্যের ব্যাপ্তি এবং সহনশীলতার কারণে এর প্রতিষ্ঠান এবং সংস্কৃতি তার অঞ্চল জুড়ে ভাষা, ধর্ম, শিল্প, স্থাপত্য, সাহিত্য, দর্শন, আইন এবং সরকারের বিভিন্ন বিভাগ বিকাশের উপর স্থায়ী প্রভাব ফেলেছিল। রোমান ও গ্রীক শিল্প ইতালীয় রেনেসাঁর উপর গভীর প্রভাব ফেলেছিল। রোমের স্থাপত্য ঐতিহ্য রোমানেস্ক, রেনেসাঁ এবং নিওক্লাসিক্যাল স্থাপত্যের ভিত্তি হিসাবে কাজ করে।

যা ইসলামিক স্থাপত্যকে প্রভাবিত করে। ইউরোপে দ্রুপদী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির পুন:আবিস্কার বৈজ্ঞানিক রেনেসাঁ এবং বৈজ্ঞানিক বিপ্লবে অবদান রেখেছে। অনেক আধুনিক আইনি ব্যবস্থা, যেমন নেপোলিয়নিক কোড, রোমান আইন থেকে এসেছে। অন্যদিকে রোমের প্রজাতন্ত্রী প্রতিষ্ঠানগুলি মধ্যযুগীয় সময়ের ইতালীয় শহর-রাজ্য প্রজাতন্ত্র, প্রথমদিকে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এবং আধুনিক গণতান্ত্রিক প্রজাতন্ত্রগুলিকে প্রভাবিত করেছে।

রোম থেকে রোমান জাতি ও সাম্রাজ্য 


গৌরবময় এই সাম্রাজ্যের শুরু কিন্তু সাম্রাজ্য হিসাবে না হয়ে বসতি হিসাবে গড়ে উঠেছিল। রোম থেকে রোমান জাতি ও সাম্রাজ্যের সূচনা হয়। ইতালি ছিল এ সাম্রাজ্যের সূতিকাগার। এখান থেকে এ সাম্রাজ্য চারিদিকে ছড়িয়ে পড়ে। তৃতীয় শতাব্দীতে এ সাম্রাজ্য পূর্ব ও পশ্চিম রোমান সাম্রাজ্যে বিভক্ত হয়ে যায়। পশ্চিম রোমান সাম্রাজ্য খুব বেশিদিন স্থায়ী হয়নি।

পশ্চিমের পতন হলে পূর্ব রোমান সাম্রাজ্যের রাজধানী কন্সটান্টিনোপলে রাজকীয় প্রতীক পাঠিয়ে দেয়া হয়। তখন থেকে পূর্ব রোমান সাম্রাজ্য ছাড়া রোমান সাম্রাজ্যের আর কোন অস্তিত্ব ছিল না। বাইজান্টাইন সাম্রাজ্য ছিল পূর্ব রোমান সাম্রাজ্যের। আরেক নাম। বাইজান্টাইন সাম্রাজ্য এশিয়ায় তাদের মূল প্রতিপক্ষ সাসানীয় পারস্য সাম্রাজ্যের সঙ্গে উপর্যুপরি সংঘর্ষে অবতীর্ণ হয়।

তবে ইসলামী খিলাফত একসময় পারস্য ও বাইজান্টাইন উভয় সাম্রাজ্যের প্রবল প্রতিপক্ষ হয়ে দাঁড়ায় এবং ইসলামের দ্বিতীয় খলিফা হযরত উমরের (র.) আমলে পারস্য সাম্রাজ্য ইসলামের কাছে নতীস্বীকার করে। ১৪৫৩ সালে অটোমান সুলতান দ্বিতীয় মোহাম্মদের কাছে পূর্ব রোমান সাম্রাজ্যের রাজধানী কন্সটান্টিনোপলের পতনের মধ্য দিয়ে রোমান সাম্রাজ্যের অস্তিত্ত্ব বিলুপ্ত হয়।

প্রাচীন বিশ্বের ক্ষমতাধর জাতি হিসাবে আত্মপ্রকাশের আগে তাদেরকে পাড়ি দিতে হয়েছে অনেকটা পথ। সেই খৃস্টপূর্ব ৫ম শতক থেকে শুরু হয়ে বহু ঘাত প্রতিঘাতের মধ্য দিয়ে বিলীন হয়ে যায় পঞ্চদশ শতকে। অর্থাৎ রোমান সাম্রাজ্যের ব্যপ্তি দুই হাজার বছর। হজরত মুহাম্মদ (স.) এর ওফাতের পরও রোমানদের সাম্রাজ্য টিকে ছিল প্রায় ৮শ বছর।

প্রাচীন রোম 


ইতালিয়ান উপদ্বীপের বিস্তৃতি ছিল ভূমধ্যসাগর পর্যন্ত। তিন দিক থেকে সমুদ্র ঘিরে রেখেছে দেশটাকে। টাইবার ইতালির সর্ববৃহৎ নদী ইতালির পশ্চিম উপকুলকে দুইভাগে ভাগ করেছে। আজকের রোমসহ টাইবার নদীর দক্ষিণের এলাকাটুকু এককালে পরিচিত ছিল ল্যাটিয়াম নামে। নৃতাত্ত্বিক গবেষণা অনুসারে এই ল্যাটিয়ামে প্রথম মানুষের পা পড়েছিল খৃস্টপূর্ব ১১ শতকে।

এই মানুষগুলো ছিল যাযাবর, এরা মূল ইউরোপ থেকে আগত। ল্যাটিয়ামে তারা গৃহপালিত ভেড়ার জন্য পেয়েছিল চারণভূমি। কৃষি জমিও ছিল বেশ উর্বর। সবমিলিয়ে বসবাসের জন্য উপযুক্ত। খৃস্টপূর্ব ৮৫০ সালের দিকে এই প্রাচীন মানুষদের অনেকে সেখান থেকে সরে গিয়ে প্রথম বসতি গড়ে তোলে অন্য এক এলাকায়।

সেটাই পরবর্তীতে রূপ নেয় রোম নগরীর। সেখানে বসবাসের জন্য ছোট ছোট গোলাকার কুটির বানিয়ে থাকত। সাত পাহাড়ের মাঝে আবাস তৈরি করা সেটলাররাই পরবর্তীতে পরিচিত হয় ল্যাটিন নামে। আরেকটা গোত্র এদের নাম স্যাবিন এরা খৃস্টপূর্ব ১০০০ অব্দের আগেই এ অঞ্চলের অ্যাপেইনাইন পাহাড়ের পাদদেশে বসতি গড়েছিল। এরা ল্যাটিনদের চেয়ে কিছুটা আলাদা। এক পর্যায়ে দুই প্রতিবেশীর দেখা হল এবং ল্যাটিনদের সাথে মিশেও গেল।

এটরুসকানদের কথা 


সতেরো শতকের শুরুর দিকে টাইবারের ল্যাটিন সমাজ আর দক্ষিণের ল্যাটিন সমাজগুলো একীভূত হতে শুরু করে। এদিকে উত্তর অংশের এটরুসকান নগর রাষ্ট্রগুলো শক্তিশালী হচ্ছিল। একপর্যায়ে ক্যাম্পানিয়া এবং ল্যাটিয়াম দখল করে নেয় তারা। পরবর্তী দেড়শো বছর এটরুসকানদের দখলে ছিল রোম। আরও দক্ষিণে গিয়ে সরাসরি গ্রিকদের সাথে মোলাকাত হয় এটরুসকানদের।

প্রথমদিকে গ্রিক শত্রুদের পরাজিত করতে থাকলেও শেষ পর্যন্ত কুলিয়ে উঠতে পারেনি। পতন হতে শুরু হয় তাদের। এই সুযোগে বিদ্রোহ করে বসে রোম। খৃস্টপূর্ব ৫০০ সনে স্বাধীনতা লাভ করে রোম। তবে রোমের উপর এটরুসকানদের প্রভাব অনস্বীকার্য। আজও টিকে আছে এটরুসকান সভ্যতার কিছু চিহ্ন। যেমন- এটরুসকান কূপ, ইতালীয় চিত্রকর্ম এবং ’মৃতদের শহর‘ হচ্ছে ইউরোপের সবচেয়ে ভালভাবে সংরক্ষিত সমাধিক্ষেত্রের একটি।

প্রাথমিক রোমান ধর্ম 


প্রথম দিকে রোমানরা পেশায় ছিল প্রধানত কৃষক এবং রাখাল। তারা জানত না বন্যা, খরা, বজ্রপাত ও ঋতু পরিবর্তনের কারন। এইসব রহস্যময় শক্তিগুলোর কারনে এক পর্যায়ে তারা শুরু করে নানা দেবতার প্রার্থনা। তারা বিশ্বাস করত দেবতারা মানুষের আশপাশেই এমনকি বাড়িতেই বসবাস করে। রহস্যময়তার কারনে তাদের প্রতিকৃতি হিসাবে কোন মনুষ্য আকৃতিও সৃষ্টি করেনি।

গ্রীক দেব-দেবীর ছিল আলাদা আলাদা ব্যক্তিত্ব ও প্রতিরূপ। নিজেদেরকে অশুভের হাত থেকে রক্ষা করতে এবং দেবতাদের তুষ্ট করতে রোমানরা উপাসনা করত সাধারণ বেদিতে। উৎসর্গ করত খাবার, পানীয় এবং সুগন্ধী। এ ভাবেই বিকাশ লাভ করতে থাকে তাদের ধর্মচর্চা।

রোমান কাদের বলা হত ?


রোমানদের উৎপত্তি মূলত ইতালিতে। রাজধানী রোমের নামানুসারে তাদের নামকরণ করা হয়েছে। টাইবার নদীর তীরে অবস্থিত রোম শহর চারদিকে সাতটি পাহাড় দ্বারা বেষ্টিত। শুরুর দিকে রোমান সাম্রাজ্য ইতালীর মধ্যে সীমাবদ্ধ ছিল। দু’শ বছর পর থেকে তাদের সীমানা প্রসারিত হতে থাকে। প্রথমদিকে তারা ভিন্ন ভিন্ন গোত্রে বসবাস করত।

এ জন্য রোমান সাম্রাজ্যকে কোনো একটি বিশেষ জাতিগোষ্ঠী বলা চলে না। রোমান সভ্যতা ছিল অনেকগুলো নগর রাষ্ট্রের সমষ্টি। সিনেটর বা প্রতিনিধিদের পরামর্শে চলত রোমের শাসন। এই যুগটাকেই বলা হত রিপাবলিকান বা প্রজাতন্ত্রের যুগ। কালক্রমে রোম রাজতন্ত্রে রূপ নেয়। প্রজাতন্ত্র টিকে ছিল ৫’শ বছর আর বাকী পনের’শ বছর বিরাজমান ছিল রাজতন্ত্র। এই দুই হাজার বছর মানব ইতিহাসে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ স্থান জুড়ে ছিল রোমান সাম্রাজ্য।

ক্রমবিকাশ ও ব্যাপ্তি 


শত শত যুদ্ধ বিগ্রহ, অভ্যুত্থান, পাল্টা অভ্যুত্থানের মধ্য দিয়ে সমৃদ্ধির দিকে এগিয়ে যেতে থাকে রোমান রিপাবলিক। বিভিন্ন সময়ে ডিক্টেটরদের আবির্ভাব ঘটতে থাকে প্রজাতন্ত্রে। জুলিয়াস সিজারের জন্ম রোমান রিপাবলিক যুগে। তিনি রোমের অত্যন্ত পরাক্রমশালী ডিক্টেটর হিসাবে আবির্ভুত হয়। তিনি শক্তিশালী মিশর জয় করেন। ভূমধ্যসাগরীয় অঞ্চলের একচ্ছত্র অধিপতিতে পরিনত হন।

জুলিয়াস সিজারের মৃত্যুর পর তার পালক পুত্র অগাস্টাস সিজার রোমের সিংহাসনে বসেন এবং প্রজাতন্ত্রের চিরতরে বিলুপ্তি ঘোষণা করে রোমান সাম্রাজ্য প্রতিষ্ঠা করেন। তাই অগাস্টাস সিজারকে রোমান সাম্রাজ্যের প্রথম সম্রাট বলা হয়। তার নামানুসারে আগস্ট মাসের নাম এবং তার পিতার নামানুসারে জুলাই মাসের নামকরণ করা হয়।

শুধু তাই নয় ফেব্রুয়ারি মাস থেকে একদিন কেটে আগস্টের সাথে আরও একদিন যোগ করে ৩১ দিন বানালেন। কারন জুলিয়াস সিজারের নামে জুলাই মাস ছিল ৩১ দিনে আর আগস্ট ছিল ৩০ দিনে। তখন থেকে ফেব্রুয়ারি মাস ২৮ দিনে।

রোমানদের ধর্ম 


রোমনরা প্রথমদিকে ছিল পৌত্তলিক। তারা প্রেতাত্মায় বিশ্বাস করত। তাদের প্রধান প্রধান দেব-দেবীর মধ্যে জুপিটার, ভেনাস, নেপচুন উল্লেখযোগ্য। ফিলিস্তিনে যীশু খৃস্টের জন্মের সময় রোমের ক্ষমতায় ছিল অগাস্টাস সিজার। খৃস্টধর্মের সবচেয়ে বড় শত্রুতে পরিনত হয় রোম। কেননা যীশু খৃস্টের একত্ববাদের সাথে রোমানদের বহু ইশ্বরবাদের মধ্যে পরোপুরি সাংঘর্ষিক।

এছাড়া যীশুর সাম্য ও ইনসাফের শিক্ষা ভোগবাদে বিশ্বাসী অত্যাচারী রোমানদের মসনদ কাঁপিয়ে দিয়েছিল। তাই খৃস্টানদের উপর অমানুষিক অত্যাচার করতে থাকে রোমানরা। তারপরও যীশুর প্রচারিত ধর্ম ব্যাপক জনপ্রিয় হতে থাকে। উচ্চ পর্যায়েও খৃস্টধর্ম প্রভাব বিস্তার করতে শুরু করে। খৃস্টীয় ৪র্থ শতকের প্রথম দিকে রোমান সম্রাট কন্সটানটাইন নিজেই খৃস্টধর্ম গ্রহণ করেন এবং এই ধর্মের প্রতি সহনশীল আচরণের নির্দেশ জারি করেন।

পরবর্তী ১০০০ বছর খৃস্টধর্মের রক্ষকের ভূমিকায় অবতীর্ণ হয় স্বয়ং রোমানরাই। রোম হয়ে উঠে খৃস্টধর্মের সমার্থক। আজও ভ্যাটিকান চার্চের অবস্থানও কিন্তু রোমের ভিতরেই এবং অধিকাংশ খৃস্টানই রোমান ক্যাথলিক।

মুসলমানদের সাথে রোমানদের যুদ্ধ 


ইসলামের প্রাথমিক উত্থান পর্বে মুসলমানদের খুব একটা আমলে নেয়নি রোমানরা। তবে মক্কা বিজয়ের এক বছর আগে মুসলমানদের সাথে প্রথম যুদ্ধ বাঁধে। সে সময় রোমান সম্রাট ছিলেন হেরাক্লিয়াস। ৬২৮ খৃস্টাব্দে ঘাসানিয়দের সাথে জর্ডানের মুতার প্রন্তরে যুদ্ধের মাধ্যমে রোমান ও মুসলমানদের মধ্যে বিরোধের সূচনা হয় এবং পরবর্তী প্রায় আটশ বছর পর্যন্ত চলেছিল।

মুতার যুদ্ধে কোনো পক্ষের বিজয় না হলেও অভূতপূর্ব বীরত্বের জন্য খালেদ ইবনে ওয়ালিদ (র.) কে ‘সাইফুল্লাহ’ উপাধিতে ভূষিত করা হয়। পরের বছর মুসলমানরা অনেক বড় সৈন্য সমাবেশ করলেও সে বছর আর কোন যুদ্ধ হয়নি। ৬৩২ খৃস্টাব্দে হযরত মুহাম্মদ (সা.) এর মৃত্যুর পর হযরত উমার (রা.) এর সময় রোমানদের সাথে মুসলিমদের বিরোধ চরমে পৌঁছায়।

একে একে রোমানরা মুসলমানদের কাছে ফিলিস্তিন, মিশর ও সিরিয়া হারাতে থাকে। সিরিয়ার দক্ষিণে অবস্থিত ইয়ারমুক প্রান্তরে চার দিন ধরে চলা যুদ্ধে রোমানরা চুড়ান্তভাবে পরাজিত হয় এবং সিরিয়ার কর্তৃত্ব চিরদিনের মত হারায়। শুধু তাই নয় খোলাফায়ে রাশিদিনের সময়েই রোমানরা খোদ আনাতোলিয়াতেও এলাকা হারাতে থাকে।

পরবর্তীতে উমাইয়াদের সময় মুসলিমদের ইউরোপ অভিযানের ফলে আর কখনোই রোমানরা আগের যায়গায় ফিরে যেতে পারেনি। এখানে একটি ব্যাপার উল্লেখ্য পবিত্র কুরআনে ‘রুম’ হিসাবে যাদের বলা হয়েছে তারা মূলত বর্তমান তুরস্কের বাসিন্দা বাইজান্টাইন। তাদের রাজধানী ছিল কন্সটানটিনোপলে। দ্বাদশ শতকের প্রখ্যাত কবি ও সুফি সাধক মাওলানা জালাল উদ্দীন রুমি ছিলেন বর্তমান তুরস্কের কনিয়ার অধিবাসী। তাই তিনি মাওলানা রুমি নামেই পরিচিত হন।

রোমান তথা বাইজান্টাইনদের সমাপ্তি 


পঞ্চদশ শতকে রোমান তথা বাইজান্টাইন সাম্রাজ্য শুধু কন্সটানটিনোপল নগরের মধ্যে আবদ্ধ হয়ে পড়ে। ১৪৫৩ সালে তাদের উপর চূড়ান্ত আঘাত হানেন ওসমানীয় সুলতান মুহম্মদ বিন ফতেহ। কন্সটানটিনোপলের নাম বদলে রাখা হয় ইসলামবুল। পরবর্তীতে ইস্তানবুল হিসাবে লেখা হয়। পৃথিবীর সবচেয়ে প্রাচীন বৃহত্তম সাম্রাজ্য এক কালের পরাক্রমশালী রোমানরা আজ আর নাই কিন্তু থেকে গেছে তাদের কীর্তি।

ঐতিহাসিকভাবে রোমান সভ্যতার বিস্তৃতি ও প্রভাব এতটাই যে কয়েক লক্ষ বই লেখার পরও সম্পূর্ণ বিশ্লেষণ করা সম্ভব নয়। তাই এই লেখাটা রোমানদের সেই বিশাল সিন্ধু থেকে বিন্দু তুলে আনার ছোট্ট প্রয়াস মাত্র।

এই পোস্টটি পরিচিতদের সাথে শেয়ার করুন

পূর্বের পোস্ট দেখুন পরবর্তী পোস্ট দেখুন
এই পোস্টে এখনো কেউ মন্তব্য করে নি
মন্তব্য করতে এখানে ক্লিক করুন

অর্ডিনারি আইটির নীতিমালা মেনে কমেন্ট করুন। প্রতিটি কমেন্ট রিভিউ করা হয়।

comment url