ব্যাবিলনের ঝুলন্ত উদ্যান প্রাচীন যুগের সপ্তাশ্চর্য

ব্যাবিলনের ঝুলন্ত বা শুন্য উদ্যান ইরাকের ইউফ্রেটিস নদীর তীরে নির্মিত হয় খৃস্টপূর্ব ৬০০ অব্দে। এটি প্রাচীন যুগের আকর্ষণীয় সপ্তাশ্চর্যের মধ্যে একটি। আকাশ থেকে নেমে আসা সারি সারি সবুজের স্নিগ্ধতা আর বাহারি ফুলের সৌরভ। এই বাগানের নাম শোনেনি এমন মানুষ খুব কমই আছে।

ব্যাবিলনের ঝুলন্ত উদ্যান প্রাচীন যুগের  সপ্তাশ্চর্য

ব্যাবিলনের ঝুলন্ত উদ্যান প্রাচীন যুগের  সপ্তাশ্চর্য


মনোহর এই বাগানটিকে প্রাচীন যুগের অত্যাশ্চর্য বলা হয় শুধু একটি কারণে তা হলো - বাগানটিকে দুর থেকে দেখে মনে হতো হাওয়ায় ভাসছে। তপ্ত মরুভূমির বালিতে হটাৎ যেন চোখ ধাঁধিয়ে যায়। বালুর বুক চিরে জেগে উঠেছে গাড় সবুজে ঢাকা আস্ত একটি পাহাড়। তার গা বেয়ে ঝরনা নেমে আসছে ছলছল করে। সবুজের মাঝখানে ফুটে আছে রং-বেরঙের ফুল।

পাখি আর প্রজাপতি সেখানে উড়ে বেড়াতো। হটাৎ দেখলে বিভ্রম জাগতেই পারে। ঐতিহাসিক হেরোডোটাস এই বাগানের মনোরম শোভায় এতই মুগ্ধ হয়েছিলেন যে, বাগানটিকে তিনি প্রাচীন পৃথিবীর এক অপার বিষ্ময় বলে অভিহিত করেছিলেন। যুগ যুগ ধরে হাজারো রহস্যে ঘিরে আছে হেলেনীয় সভ্যতার এই স্থাপনা।

ব্যাবিলনের এই উদ্যানটি সম্রাট নেবুচাদনেজার সম্রাজ্ঞীর প্রেরণায় এটি নির্মাণ করেন। প্রথমে নির্মাণ করা হয় বিশাল এক ভিত, যার আয়তন ছিল ৮০০ বর্গফুট। ভিতটিকে স্থাপন করা হয় তৎকালীন সম্রাটের খাস উপাসনালয়ের সুবিস্তৃত ছাদে। ভিত্তি স্থাপন করার পর মাটি থেকে এর উচ্চতা প্রায় ৮০ ফুট। এই ভিত্তির উপরেই নির্মিত হয় বিশ্বের সর্ববৃহত এবং বিস্ময়কর পুস্পবাগ।

প্রায় ৪০০০ শ্রমিক রাতদিন পরিশ্রম করে তৈরি করেছিল এই বাগান। বাগান পরিচর্চার কাজ করত প্রায় ১০৫০ জন মালী। ৫ থেকে ৬ হাজার জাতের ফুলের চারা রোপণ করা হয়েছিল এই বাগানে। ৮০ ফুট উচুতে অবস্থিত বাগানের সুউচ্চ ধাপগুলিতে নদী থেকে পানি উঠানো হত মোটা পেচানো নলের সাহায্যে। পার্শ্ববর্তী পারস্য রাজ্যের সাথে ৫১৪ খৃস্টাব্দে এক ভয়াবহ রক্তক্ষয়ী যুদ্ধে এই মনোরম সুন্দর উদ্যানটি সম্পূর্ণরূপে ধ্বংস হয়ে যায়।

এই উদ্যানের নামকরণ


ইউফ্রেটিস নদীর তীরে গড়ে উঠা মেসোপটেমিয় সভ্যতার মধ্যে এই ব্যাবিলন শহরটি ছিলো জাঁকজমকপূর্ণ। চারকোণা এ শহরটির প্রতিরক্ষা প্রাচীরের উচ্চতা ও প্রশস্থতা ছিলো বিস্ময়কর। শহরের সামনে ছিল মজবুত ও উচু প্রবেশ পথ। আবার শহরের মধ্যে একটি বড়ো স্তম্ভও তৈরি করা হয়েছিল যার নাম ছিলো ব্যাবিলন টাওয়ার। নামটির সঙ্গে সম্ভবত ব্যাবিলন নামটির সম্পর্ক ছিল।

ব্যাবিলনের পতন


পারস্য সম্রাট সাইরাস ৫১৪ খ্রিষ্টপূর্বাব্দে জেরুজালেম দখল করে শহরটি ধ্বংস করেন। তাদের উপসনালয় এবং রাজপ্রাসাদ পুড়িয়ে দেন। তার সময় থেকেই ব্যাবিলনের সাম্রাজ্য ম্লান হতে থাকে। তার পরবর্তীকালে নেবোনিডাস সম্রাট হন। তবে ব্যাবিলনের সমৃদ্ধি হারিয়ে যেতে থাকে। ব্যাবিলন এখন ধ্বংস স্তুপ।

পারসিয়ান সম্রাটের প্রচন্ড আক্রমণে নিমিষেই ধুলোয় মিশে গিয়েছিলো ব্যাবিলন নগরী। পৃথিবীর সবচাইতে প্রাচীন সপ্তাশ্চর্য হাজারো রহস্যে ঘেরা ব্যাবিলনের শুন্যদ্যান বা ঝুলন্ত উদ্যান। এটি ছিল পৃথিবীর সর্ববৃহৎ বাগান এবং মানুষের তৈরি পৃথিবীর সবচাইতে সুন্দর ও চমকপ্রদ বাগান।

এই বাগান সম্পর্কে কিছু চমকপ্রদ তথ্য


  • পৃথিবীর সাতটি বিস্ময়ের অন্যতম হলেও ব্যাবিলনের শুন্যদ্যানের আজ পর্যন্ত কোন অস্তিত্ত্ব পাওয়া যায়নি কিন্তু কিছু পৌরানিক প্রমান পাওয়া যায়।
  • বিভিন্ন রোমান ও গ্রিক সাহিত্যিকগণ বাগান সম্পর্কে প্রচুর লেখা লিখেছেন। এই লেখাতে বিভিন্ন তথ্য পাওয়া যায়।
  • স্ত্রীকে খুশী করতেই এটি তৈরি করেন এ সম্পর্কে সবচাইতে বেশি ইতিহাসবীদ ও কবি সাহিত্যিক একমত হয়েছেন।
  • বাগানে প্রতিদিন ৮২ হাজার গ্যালন পানির প্রয়োজন হত যা একটি পাইপের সাহায্যে তোলা হত।

ব্যাবিলনের শুন্য উদ্যান সৃস্টির ইতিহাস


সম্রাট নেবুচাদনেজার ছিলেন ভীষণ আমুদে স্বভাবের। সম্রাট মিদিয়ার রাজকন্যার রূপে আকৃষ্ট হয়ে আমিতিসকে বিয়ে করেন। রাজার সেই পারসিক স্ত্রীর পিতার বাড়ি মিদিয়া ছিল সবুজ পাহাড় আর মনোরম উপত্যকা দিয়ে ঘেরা। এই রুক্ষ মরুভূমির দেশে এসে রাণীর খুব মন খারাপ হতো। মরুময় পরিবেশ তার ভাল লাগেনা। মনকে মানিয়ে নিতে না পারায় রাণী হয়ে পড়েন গৃহকাতর।

তাকে খুশি করতে রাজা ঠিক করেন, মরুময় বালির বুকেই গড়ে তুলবেন সুজলা-সুফলা, শস্য-শ্যামল এক সবুজের বাগান। কিন্তু কাজটা ছিল বড়ই কঠিন। একদিকে মরুভূমি তার উপর পানির বড়ই অভাব। কিভাবে সম্ভব হবে এমন সবুজ বাগান তৈরির কাজ। আবার গাছ লাগালেও তো শুকিয়ে যাবে। এসব নানা ভাবনা সকলের মনে কাজ করলেও শেষ পর্যন্ত রাজার ইচ্ছাকে মর্যাদা দেয়ার জন্য দেশ-বিদেশ থেকে বিশেষজ্ঞদের ডাকা হলো।

তাদের সুচিন্তিত পরামর্শ ছিল সেচ প্রযুক্তি ব্যবহার করে এই সমস্যার সমাধান করা যেতে পারে। কীভাবে এই কাজ এগিয়ে যাবে তাদের কাছে মতামত নেয়া হলো। প্রথমে মরুভূমিতে মাটি ফেলে কৃত্রিম পাহাড়ের উপর বাগানটি তৈরি করা হয়। ইটের কলাম দিয়ে তৈরি করা হয় অনেকগুলো ধাপ। ধাপে ধাপে সেই পাহাড়ের গায়ে গাছপালা লাগানো হয়েছিল।

দূর থেকে দেখলে বাগানটিকে মনে হতো শুন্যে ঝুলছে। আসলে ঝুলন্ত বাগান শুন্যে ভাসমান ছিল না মোটেও। এর প্রযুক্তিগত কৌশল ছিল চমকপ্রদ। ব্যাবিলন নগরের আরেকটি আকর্ষণ ছিল টাওয়ার অব বাবেল। ধারণা করা হয় প্রাচীন সুমেরীয় সভ্যতার মানুষ স্বর্গ ছোঁয়ার জন্য টাওয়ারটি নির্মাণ করেছিল।

বাগানকে ঘিরে রাণীর মনোমুগ্ধকর প্রাসাদ


চতুর্ভূজাকৃতির বাগানটির ছাদেই গাছ রোপন করা হয়েছিল। ছাদগুলো কিউব আকৃতির ছককাটা স্তম্ভের উপর দাঁড় করানো ছিল। ভিত্তিগুলো পর্যাপ্ত ভার সামলানোর মত করে তৈরি করা হয়। এই আকৃতিতে ছাদ তৈরির ফলে সামনে থেকে বাগানটিকে পাহাড়ের মতো মনে হতো। ছাদের উপর উঠার জন্য পেঁচানো সিঁড়ি তৈরি করা হয়েছিল।

সিঁড়ির পাশ দিয়ে মোটা নল রাখার স্থান ছিল যাতে করে ছাদের একদম উপর পর্যন্ত পানি উঠানো যায়। ভাবতে অবাকই লাগে, অত বছর আগে অবিশ্বাস্য সেচ প্রযুক্তির মাধ্যমে রাজা এই অসম্ভবকে সম্ভব করেছিলেন। রানী আমিতিসের জন্য এভাবে তৈরি হলো রাজা নেবুচাদনেজারের স্বপ্নের ঝুলন্ত বাগান। এই বাগানের সাথে রাণীর জন্য একটি সবুজ রঙ্গের মনোমুগ্ধকর প্রাসাদও তৈরি করা হয়। এই প্রাসাদকে রাজা নাম দিয়েছিলেন, ‘মানবজাতির বিস্ময়’

ঝুলন্ত বাগানের নগরীর এই ব্যাবিলনকে বিশ্ব ঐতিহ্য হিসাবে ঘোষণা করেছে জাতিসংঘের শিক্ষা ও সংস্কৃতি বিষয়ক সংস্থা ইউনেস্কো। ব্যাবিলনের ঝুলন্ত উদ্যান প্রাচীন যুগের সপ্তাশ্চর্যগুলোর মধ্যে এটি একটি। হাম্বুরাবি ও নেবুচাদনেজারের মতো সফল শাসকদের অধীনে ব্যাবিলন শহর ও ব্যাবিলীয় সভ্যতার সৃষ্টিশীলতার গভীরতার প্রতিনিধিত্ব করে এটি।

১৮৯৯ সালে জার্মান প্রত্নতাত্ত্বিক রবার্ট কোল্ডওয়ে ব্যাবিল শহরে খনন কাজ শুরু করেন। এই খনন কাজে রাজার প্রাসাদ, দুর্গ, টাওয়ার অব ব্যাবিল এবং নগর রক্ষাকারী দেওয়াল সবই পাওয়া যায়। তিনি ১৪ টি রুমবিশিষ্ট একটি স্থান খুঁজে পান যার ছাদ ছিল পাথরের তৈরি। এটিকে তিনি ঝুলন্ত বাগান বলে দাবি করেন।

গবেষকদের মতে কোল্ডম্যানের সাথে ইতিহাসবিদদের বাগানের অবস্থান সম্পর্কে এবং সেচ ব্যবস্থা সম্পর্কিত ধারণার সাথে মিলে না। প্রত্নতত্ত্ববিদদের মতে এই অংশটি কোনো উদ্যান নয়, বরং প্রশাসনিক কাজকর্মের জন্য এটি ব্যবহৃত হতো।

নথিপত্র বা মিথ যাই বলিনা কেন এটা অস্বীকার করার কোনো উপায় নাই ব্যাবিলন শহরে সত্যিই একটি শুন্য উদ্যান ছিল। কিন্তু সেটি কোথায় কীভাবে হারিয়ে গেছে - এসব প্রশ্নের উত্তর নাই। এতো বর্ণনার পরও বাস্তবে সেই শুন্য উদ্যানের কোনো নিদর্শনই খুঁজে পাওয়া যায়নি।

তাই অনেকে বলে থাকেন ব্যাবিলনের ঝুলন্ত বাগান প্রাচীন যুগের সপ্তাশ্চর্যের এক অপরূপ কল্পনা মাত্র। এই বাগানের অস্তিত্ব সম্পর্কে প্রত্নতত্ত্ববিদদেরও এখনও পর্যন্ত নিরাশই করেছে। কোনো প্রামান্য তথ্য তারা পাননি। তবু কল্পনার জগতে দিন দিন উজ্জলতর হয়েছে এ বাগানটি। হয়তো একদিন ইউফ্রেটিস নদীর কোনো এক গহীন অন্ধকারের নীচে মিললে ও মিলতে পারে এই উদ্যানের অস্তিত্ব।

এই পোস্টটি পরিচিতদের সাথে শেয়ার করুন

পূর্বের পোস্ট দেখুন পরবর্তী পোস্ট দেখুন
এই পোস্টে এখনো কেউ মন্তব্য করে নি
মন্তব্য করতে এখানে ক্লিক করুন

অর্ডিনারি আইটির নীতিমালা মেনে কমেন্ট করুন। প্রতিটি কমেন্ট রিভিউ করা হয়।

comment url