মিশরীয় সভ্যতার গুরুত্বপূর্ণ অবদান ও ইতিহাস

আফ্রিকা মহাদেশের উত্তর-পূর্ব অংশে অবস্থিত দেশটির নাম ইজিপ্ট বা মিশর। ৩২০০ খৃস্টপূর্বাব্দ থেকে প্রথম রাজবংশের শাসন আমল শুরু হলে ফারাওদের অধীনে মিশর প্রাচীন বিশ্বসভায় একের পর এক উল্লেখযোগ্য অবদান রাখতে সক্ষম হয়। মিশরীয় সভ্যতার গুরুত্বপূর্ণ অবদান ও ইতিহাস আলোচনা করা হল।

মিশরীয় সভ্যতার গুরুত্বপূর্ণ অবদান ও ইতিহাস

তিনটি মহাদেশ এশিয়া, আফ্রিকা ও ইউরোপ দ্বারা ঘিরে থাকা ভূমধ্যসাগরের উপকুলে অবস্থিত মিশরের অবস্থান অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ । মিশরীয় সভ্যতার মত আর কোন সভ্যতা মানব জাতির ক্রম বিবর্তন, উন্নতি ও উৎকর্ষতায় এতবড় অবদান রাখতে পারেনি। খৃস্টপূর্ব ৫০০০ থেকে ৩২০০ অব্দ পর্যন্ত নীল নদের অববাহিকায় একটি সমৃদ্ধ জনপদের উদ্ভব হয়।

মিশরীয় সভ্যতার গোড়াপত্তন হয় মেনেসের নেতৃত্বে, যা প্রায় তিন হাজার বছর ধরে স্বমহিমায় উজ্জল ছিল। খৃস্টপূর্ব দশম শতকে লিবিয়ার এক বর্বর জাতি ফারাওদের সিংহাসন দখল করে নেন। ৬৭০-৬৬২ খৃস্টপূর্বাব্দে অ্যাসিরীয়রা মিশরে আধিপত্য বিস্তার করে। ৫২৫ খৃস্টপূর্বাব্দে পারস্য মিশর দখল করে নিলে প্রাচীন মিশরের সভ্যতার সূর্য অস্তমিত হয়। এই সভ্যতা ২৫০০ বছরেরও বেশি সময়ব্যাপী স্থায়ী হয়েছিল।

মিশরের নীল নদের উৎপত্তি আফ্রিকার লেক ভিক্টোরিয়া থেকে। সেখান থেকে নদটি নানা দেশ হয়ে ‍মিশরের মধ্য দিয়ে ভূমধ্যসাগরে এসে পড়েছে। প্রাচীনকালে প্রতিবছর নীল নদে বন্যা হতো। বন্যার পানি সরে গেলে দুই তীরে পলিমাটি পড়ে জমি উর্বর হতো। জন্মাতো নানা ধরনের ফসল। নীল নদ না থাকলে মিশর মরুভূমিতে পরিণত হতো। ইতিহাসের জনক হেরোডোটাস তাই বলেছেন- ‘মিশর নীল নদের দান’।

সুপরিচিত বন্যা ও উর্বর উপত্যকার নিয়ন্ত্রিত সেচব্যবস্থার ফলস্রুতিতে উদবৃত্ত ফসল ফলতো। যা থেকে এই অঞ্চলের সামাজিক ও সাংস্কৃতিক বিকাশ ত্বরান্বিত হয়। এই সম্পদের সাহায্যেই প্রশাসনের সহায়তায় উপত্যকা ও পার্শ্ববর্তী মরু অঞ্চলে খনিজ পদার্থের উত্তোলন শুরু হয়। লিখন পদ্ধতির বিকাশ হয়, স্থাপনা ও কৃষিজ পণ্যের সুসংহত ব্যবহার শুরু হয়।

পার্শ্ববর্তী অঞ্চলগুলির সঙ্গে বাণিজ্যিক সম্পর্ক স্থাপিত হয় এবং সামরিক বাহিনী বহিঃশত্রুদের পরাজিত করে মিশরীয় প্রাধান্য স্থাপন করে। এই সকল কাজে প্রেরণা জোগানো এবং সুসংহতভাবে সম্পাদন করা ছিল ধর্মনেতা ও ফারাওদের অধীনস্ত প্রশাসকদের আমলাতন্ত্রের নিদর্শন। সমগ্র মিশরের জনগণকে একটি বহুব্যাপী ধর্মবিশ্বাসের বন্ধনে আবদ্ধ করতে সক্ষম হয়েছিলেন।

প্রাচীন মিশরীয় সভ্যতার গুরুত্বপূর্ণ অবদানগুলির মধ্যে উল্লেখযোগ্য খনি থেকে অট্টালিকাদি নির্মানের জন্য পাথর খনন, সমীক্ষণ ও নির্মাণ কৌশলের দক্ষতা। এরই ফলস্রুতি ঐতিহাসিক মিশরীয় পিরামিডসমূহ, মন্দির, ওবেলিস্কসমূহ, মিশরীয় গণিত ব্যবস্থা, কার্যকরী চিকিৎসা ব্যবস্থা, সেচ ব্যবস্থা ও কৃষি উৎপাদন কৌশল, প্রথম জাহাজ নির্মাণ, চীনামাটি ও কাঁচশিল্পবিদ্যা, নতুন ধারার সাহিত্য এবং বিশ্বের ইতিহাসের প্রাচীনতম শান্তিচুক্তি (হিট্টাইটদের সাথে)।

প্রাচীন মিশর এক দীর্ঘস্থায়ী উত্তরাধিকারকে পিছনে ফেলে যায়। শিল্পকলা ও সাহিত্যের ব্যাপক প্রসার লক্ষিত হয়। বিশ্বের দুরতম প্রান্তে বয়ে নিয়ে যাওয়া হয় এর পুরাকীর্তিগুলি। আধুনিক কালের প্রথমভাগে পুরাকীর্তি ও খননকার্যের প্রতি নতুন করে মানুষের মধ্যে আগ্রহ জেগে উঠলে বৈজ্ঞানিক পদ্ধতিতে মিশরের সভ্যতা সম্পর্কে অনুসন্ধান শুরু হয়। এর ফলে মিশরীয় সভ্যতার সাংস্কৃতিক উত্তরাধিকারগুলি মিশর ও বিশ্ববাসীর সম্মুখে নতুন রুপে উপস্থাপিত হয়।

প্রাচীনকাল থেকেই নীল নদ মিশরের জীবনযাত্রায় মূল ভূমিকা পালন করেছে। নীল নদের উর্বর প্লাবন সমভূমি এই অঞ্চলের মানুষের স্থায়ী কৃষি অর্থনীতি ও একটি জটিল ও কেন্দ্রীভূত সমাজ গঠনে সাহায্য করে যা মানব সভ্যতায় একটি মাইলফলক রূপে প্রতিষ্ঠিত হয়। উদ্ভিদ এবং প্রাণীতে নীল অঞ্চল সমৃদ্ধ ছিল। বিপুল পরিমাণ জলজ পাখিও এখানে পাওয়া যেত। এই পরিবেশে শিকারী প্রাণীদের জীবনযাপন ছিল সাধারণ এবং অনেক প্রাণী এই সময়ে পোষ মানানো হয়েছিল।

পূর্ব-রাজবংশীয় মিশর


৫৫০০ খৃস্টপূর্বাব্দের মধ্যেই নীলনদের উপত্যকায় ছোট ছোট গোত্র বিকশিত হয়ে উন্নত সংস্কৃতিতে পরিনত হয়। পশুপালন, কৃষিকাজ, মৃৎশিল্প এবং বিভিন্ন ব্যক্তিগত জিনিষ যেমন চিরুনি, ব্রেসলেট ছিল তাদের বিশেষ বৈশিষ্ট্য। উন্নত সিরামিক সামগ্রী, পাথরের হাতিয়ার এবং তামার ব্যবহারের জন্য তারা সবচেয়ে বেশি জ্ঞাত।

এই সকল আদি সংস্কৃতির মাঝে সবচেয়ে বড় ছিল বাদারি। তাদের উৎপত্তি সম্ভবত লিবিয় মরুভুমিতে। বাদারিদের পরে আসে আমরতিয় (নাকাদা) এবং গেরজেহ (নাকাদা) যারা আরো কিছু প্রযুক্তির উন্নতি সাধন করে। এ সময় মিশরীয়রা ব্লেড বানানো শুরু করে এবং নিকটপ্রাচ্যের সাথে বাণিজ্যিক যোগাযোগ গড়ে তুলে।

নাকাদা সংস্কৃতি বিভিন্ন ধরনের ব্যক্তিগত ব্যবহার সামগ্রী তৈরি করত যেমন চিরুনি, ছোট ভস্কর্য , ছবি অঙ্কিত মৃৎপাত্র, উচ্চ মানের নকশাকৃত পাথরের পাত্র, স্বর্ণ, ল্যাপিস, আইভরির অলংকার ইত্যাদি। এই সংস্কৃতির শেষের দিকে চিহ্নলিপি ব্যবহার শুরু করে যা অবশেষে প্রাচীন মিশরীয় ভাষার লিখন পদ্ধতি হায়ারোগ্লিফের জন্ম দেয়। মাত্র এক হাজার বছর সময়েই ছোট ছোট কিছু কৃষি সম্প্রদায় থেকে এক শক্তিশালী সভ্যতায় পরিণত হয় এবং নীল অঞ্চলের সম্পদ এবং মানুষদের পূর্ণ কর্তৃত্ব বজায় রাখতে সমর্থ হয়।

আদি রাজবংশীয় যুগ (৩০৫০-২৬৮৬ খৃস্টপূর্বাব্দ)


প্রাচীন সুমেরিয়-আক্কাদিয় এবং প্রাচীন এলামিয় সভ্যতার প্রায় সমসাময়িক যুগ ছিল এই যুগ। খৃস্টপূর্ব তৃতীয় শতকে মিশরীয় পুরোহিত মানেথো তার সময় পর্যন্ত মিশরের ফারাওদের ত্রিশটি রাজবংশে ভাগ করেন যা এখনো স্বীকৃত। এ সময় প্রথম ফারাওরা মেমফিসে রাজধানী স্থাপন করে নিম্ন মিশরের উপর তাদের নিয়ন্ত্রণ বিস্তার করেন। রাজতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠান যা ভূমি, শ্রম এবং সম্পদের উপর রাষ্ট্রীয় কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠা করে প্রাচীন মিশরীয় সভ্যতার টিকে থাকা এবং বিকাশে অপরিহার্য ভূমিকা পালন করে।

প্রাচীন রাজবংশ (২৬৮৬-২১৮১ খৃস্টপূর্বাব্দ)


সুপ্রতিষ্ঠিত কেন্দ্রীয় নিয়ন্ত্রণের মাধ্যমে এই যুগে কৃষি উৎপদন আগের চেয়ে বৃদ্ধি পায় এবং কলা, স্থাপত্য ও প্রযুক্তিতে ব্যাপক উন্নতি সাধিত হয়। প্রাচীন মিশরের সর্বশ্রেষ্ঠ কীর্তিগুলোর মাঝে গিজা পিরামিড ও স্ফিংসের মূর্তি এই সময় নির্মাণ হয়। উজিরের নির্দেশনায় কর আদায়, সেচকাজ ও বিভিন্ন নির্মাণ প্রকল্পে কৃষকদের নিযুক্ত করতেন এবং একটি বিচার ব্যবস্থা পরিচালনা করতেন।

কেন্দ্রীয় নিয়ন্ত্রণের বিকাশের সাথে একটি শিক্ষিত লিপিকার ও কর্মকর্তা শ্রেণীর উদ্ভব হয়। ফারাওরা তাদের মৃত্যুর পর তাদের সমাধি অর্চনা করার জন্য ভূমিদান করত। প্রায় পাঁচ শতক ধরে চলা এই রীতির প্রভাবে ক্রমান্বয়ে ফারাওদের অর্থনৈতিক শক্তি দুর্বল হয়ে যায় এবং প্রশাসন চালাবার ক্ষমতা লোপ পায়। সাথে সাথে স্থানীয় প্রশাসকেরা ফারাওদের প্রাধান্য অস্বীকার করতে থাকে। খৃস্টপূর্ব ২২০০ থেকে ২১৫০ পর্যন্ত তীব্র খরার কারণে মিশরের প্রাচীন রাজবংশের অবসান হয়।

প্রথম অন্তর্বর্তী যুগ (২১৮১-১৯৯১)


মিশরের কেন্দ্রীয় সরকারের পতনের পর প্রশাসনের পক্ষে অর্থনীতির গতি ফিরিয়ে আনা অসম্ভব হয়ে পড়ে। খাদ্যাভাব, রাজনৈতিক সংঘাত এবং ছোটখাট গৃহযুদ্ধের পরও স্থানীয় নেতারা প্রদেশগুলোতে এক সমৃদ্ধ সংস্কৃতির সূচনা করতে সক্ষম হন। সম্পদের নিয়ন্ত্রণ নিজেদের হাতে ফিরে পেয়ে সৃজনশীলতার ব্যাপক প্রসার ঘটে। লিপিকারগণ নতুন ধরনের সাহিত্যশৈলীর বিকাশ ঘটান যার মধ্যে এই যুগের আশাবাদ এবং মৌলিকতা ফুটে উঠে।

মধ্যকালীন রাজ্য (২১৩৪-১৬৯০ খৃস্টপূর্বাব্দ)


অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক সুরক্ষা, কৃষি ও খনিজ সম্পদের প্রাচুর্য, কলা এবং ধর্মের ব্যাপক উন্নতি সাধন করে। দেবতাদের ব্যাপারে যে অভিজাত মনোভাব ছিলো তার স্থলে ব্যক্তিগত ভক্তির প্রকাশ লক্ষ করা যায়। এ যুগের বিশ্বাসে মৃত্যুর পর আত্মা দেবতাদের সাথে যোগ দিতে পারে। সাহিত্যে, লিখনশৈলীতে এবং ভাস্কর্যে সূক্ষ ব্যাপারগুলি এমনভাবে ফুটে উঠেছে যা এর পরিপূর্ণতাকে প্রকাশ করে। এ যুগের শেষে অর্থনীতি দুর্বল হলে মধ্যম রাজ্যের পতনের সূচনা হয়।

দ্বিতীয় অন্তর্বর্তী যুগ (১৬৭৪-১৫৪৯ খৃস্টপূর্বাব্দ)


১৭৮৫ খৃস্টপূর্বাব্দের দিকে হিসকোস নামের এক সেমিটিক কানানীয় সম্প্রদায় ফারাওয়ের দুর্বলতার সুযোগ নিয়ে মিশরের ক্ষমতা নিয়ে নেয়। মিশরের কেন্দ্রীয় সরকারকে থেবেসে সরে যেতে বাধ্য করে। তবে মিশরীয় সরকার পদ্ধতি বহাল রাখে এবং নিজেদের ফারাও বলে পরিচয় দেয়। পরবর্তীতে থেবেসীয়রা শক্তিশালী হয়ে বেশ কয়েকটি সফল অভিযান পরিচালনা করেন যার ফলে হিসকোসরা মিশর থেকে বিতাড়িত হয়। এর মাধ্যমে মিশরে নতুন রাজ্যের কাল শুরু হয়।

নতুন রাজ্য (১৫৪৯-১০৬৯ খৃস্টপূর্বাব্দ)


নতুন রাজ্যের ফারাওগণ নজিরবিহীন সমৃদ্ধির যুগ প্রতিষ্ঠা করেন। সাম্রাজ্যকে বিস্তৃত করেন এবং অনেকগুলো পুরোনো বাণিজ্যপথ চালু করেন। এর ফলে ব্রোঞ্জ এবং কাঠের মত গুরুত্বপূর্ণ মালামাল মিশরে আমদানির পথ উম্মুক্ত হয়। নতুন রাজ্যের রাজার মিশরীয় দেবতা আমুনকে নিবেদন করে বিশাল বিশাল মন্দির নির্মাণ শুরু করেন।

কালক্রমে বহিঃশত্রুর আক্রমণের সাথে সাথে অভ্যন্তরীন সমস্যা যেমন দুর্নীতি, গণবিক্ষোভ, সমাধি লুট মিশরের সমস্যাকে আরো গভীর করে। আমুনের পুরোহিতগণ বিশাল সম্পদ এবং ভূসম্পত্তির মালিক হয়। তাদের অত্যধিক ক্ষমতা মিশরকে খন্ডবিখন্ড করে ফেলে এবং মিশর তৃতীয় মাধ্যমিক কালে প্রবেশ করে।

তৃতীয় অন্তর্বর্তী যুগ (১০৬৯-৬৫৩ খৃস্টপূর্বাব্দ)


১০৭৮ খৃস্টপূর্বাব্দে রামসেস এর মৃত্যুর পর তানিস নগরের শাসনকর্তা স্পেন্দেস উত্তর মিশরের উপর কর্তৃত্ব বিস্তার করেন। আর দক্ষিণাংশের নিয়ন্ত্রণ ছিল থেবেশের দেবতা আমুনের পুরোহিতদের হাতে। এ সময় লিবিয়ার বারবার গোত্রের লোকেরা পশ্চিম বদ্বীপ এলাকায় বসতি স্থাপন করে ক্রমান্বয়ে স্বাধীন হতে থাকে। এভাবে ২০০ বছর ব্যাপী শাসন করা বারবার রাজবংশের সূচনা হয়।

শেষযুগ (৬৭২-৩৩২ খৃস্টপূর্বাব্দ)


স্থায়ী দখলদারিত্বের পরিবর্তে আসিরীয়রা স্থানীয় সামন্ত রাজাদের হাতে ক্ষমতা ছেড়ে দিয়ে যায়। এসকল রাজা সৈতে নামে পরিচিত হয়। সৈতে রাজাদের অধীনে মিশরে স্বল্প সময়ের জন্য শিল্প এবং অর্থনীতি উজ্জীবিত হয়। ৩৮০-৩৪৩ খৃস্টপূর্বাব্দ পর্যন্ত মিশরের শেষ রাজবংশ মিশর শাসন করে। মিশরের শেষ রাজা নেকতানেবোর মৃত্যুতে এই রাজবংশের অবসান হয়। ৩৩২ খৃস্টপূর্বাব্দে পারসিক শাসক মাজাকেস ম্যসিডোনিয় বিজেতা আলেক্সান্দারের হাতে বিনা যুদ্ধে মিশর সমর্পন করেন।

মিশরীয় সভ্যতার পতন 


মিশরীয় সভ্যতার বিশতম রাজবংশের শেষ সম্রাট ছিলেন একাদশ রামসিস। তার সময়ে মিশরে গৃহযুদ্ধের সূচনা হয়। তারপর ১০৮০ খৃস্টপূর্বাব্দে মিশরের থিবস শহরের প্রধান ধর্মযাজক মিশরের সিংহাসন দখল করে নেয়। ৫২৫ খৃস্টপূর্বাব্দে পারস্য রাজশক্তি মিশর দখল করে এবং এর মধ্যদিয়ে মিশরীয় সভ্যতার অবসান ঘটে। ৩৩২ খৃস্টপূর্বাব্দে আলেকজান্ডার মিশর অধিকার করলে মিশরে টলেমি নামক রাজবংশ প্রতিষ্ঠিত হয়।

মিশরীয় সভ্যতার গুরুত্বপূর্ণ অবদান


সরকার এবং অর্থনীতি 

ফারাও ছিলেন দেশের সর্বময় রাজা এবং দেশের সকল ভূমি এবং সম্পদের উপর কর্তৃত্বশালী। প্রশাসনের দায়িত্বপালন করতেন উজীর, যিনি ছিলেন ফারাওদের প্রতিনিধি। মন্দিরগুলি ছিল প্রাচীন মিশরের অর্থনীতির মেরুদন্ড। শেষ যুগের আগ পর্যন্ত মিশরে মুদ্রার প্রচলন হয়নি তবুও তাদের মাঝে এক ধরনের দ্রব্যবিনিমিয় ব্যবস্থা প্রচলিত ছিল। একজন সাধারণ শ্রমিক মাসে সাড়ে পাঁচ বস্তা প্রায় ২০০ কেজি খাদ্যশস্য পেত। দ্রব্যমূল্য সারা দেশে নির্দিষ্ট করা থাকত। খৃস্টপূর্ব পঞ্চম শতকে বিদেশিদের দ্বারা মুদ্রার প্রচলন হয়।

সমাজব্যবস্থা 

মিশরীয় সমাজ ছিল বিভিন্ন স্তরে বিভক্ত এবং সামাজিক অবস্থান সবসময় স্পষ্টভাবে প্রকাশ করা হত। কৃষকরা ছিল সমাজের সবচেয়ে বড় অংশ। কিন্তু উৎপাদিত ফসলের মালিক ছিল রাষ্ট্র, মন্দির অথবা কোন অভিজাত পরিবার যারা ঐ ভূমির মালিক। কারিগর এবং শিল্পীদের সামাজিক অবস্থান ছিল কৃষকদের উপরে কিন্তু তারাও রাষ্ট্রের অধীন ছিল।

লিপিকার এবং কর্মকর্তারা ছিল মিশরের উচ্চশ্রেণি। অভিজাত সম্প্রদায়ের ঠিক নিচে ছিল পুরোহিত, বৈদ্য এবং প্রকৌশলিদের অবস্থান। নারীদের ব্যক্তিস্বাধীনতা অনেক বেশি ছিল। প্রাচীন মিশরে দাসেরা নির্দিষ্ট সময়ে কাজ করে নিজেদের মুক্তি অর্জন করে নিতে পারত।

আইনি ব্যবস্থা 

আইনি ব্যবস্থার প্রধান ছিলেন ফারাও। তার দায়িত্ব ছিল আইন তৈরি করা, ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠা এবং আইন-শৃঙ্খলা বজায় রাখা। তাদের কোন বিধিবদ্ধ আইনের সন্ধান পাওয়া যায় না। স্থানীয় বয়স্কদের নিয়ে গঠিত কাউন্সিল ছোটখাট ব্যাপারে মীমাংসা করত। গুরুতর বিষয়গুলি দেখতো উজীর কিংবা ফারাও। লিপিকারেরা অভিযোগ, স্বাক্ষী এবং রায় ভবিষ্যতের জন্য লিখে রাখত।

কৃষি ব্যবস্থা 

প্রাচীন মিশরের কিছু ভৌগলিক বৈশিষ্ট্য মিশরীয় সভ্যতার সাফল্যে অবদান রেখেছে। নীল নদের বাৎসরিক বন্যা নীল নদের পাশ্ববর্তী মাটিকে উর্বর করে তোলে। খালের মাধমে জমিতে সেচ দেয়া হত এবং ভবিষ্যতের জন্য খাদ্যশস্য জমা করে রাখা হত। মিশরীয়রা গম, বার্লি এবং আরো কিছু শস্য উৎপাদন করে রুটি এবং বিয়ার তাদের প্রধান দুটি খাদ্য তৈরিতে ব্যবহার করত।

তারা কাপড় তৈরি করত, প্যাপিরাস কাগজ তৈরিতে ব্যবহার করত, ফল ও সবজির বাগানের মাঝে পেঁয়াজ, রসুন, লেটুস, ডাল, তরমুজ, স্কোয়াশ এবং অন্যান্য ফসল ফলাত। আঙ্গুর থেকে মদ তৈরি করত। প্রচুর উৎপাদনের ফলে সাহিত্য, কলা, প্রযুক্তির পিছনে সময় সম্পদ ব্যয় করার সুযোগ পেয়েছিল।

প্রাণীজ সম্পদ 

মিশরীয়রা মানুষ, পশু এবং গাছপালাকে জীবনের গুরুত্বপূর্ণ বিষয় বিবেচনা করত। পশু সম্পদের উপর কর আদায় করা হত এবং মন্দির ও জমিদারদের জন্য পশুপালন তাদের মর্যাদা ও প্রতিপত্তির পরিচায়ক। গবাদিপশুর সাথে ভেড়া, ছাগল ও শুকুরও পালন করত। হাঁস, কবুতর এবং মৌমাছি চাষ করা হত। গাধা ও ষাঁড় ভারবাহী পশু হিসাবে এবং কৃষি কাজে ব্যবহার করত। কুকুর, বিড়াল এবং বানর ছিল সাধারণ পোষা প্রাণী। এইসব প্রাণী বলি দেয়ার জন্য বড় বড় খামারে পালা হত।

প্রাকৃতিক সম্পদ 

নির্মাণকাজে ব্যবহৃত পাথর, অলঙ্কারের পাথর, তামা, সীসা এবং দামি পাথরে মিশর সমৃদ্ধ। এ সকল সম্পদের প্রাচুর্য ইমারত, ভাস্কর্য, হাতিয়ার এবং অলঙ্কার তৈরিতে সহায়ক হয়। নুবিয়ার বিস্তীর্ণ অঞ্চল জুড়ে ছিল সোনার খনি। ওয়াদি হাম্মামাত ছিল গ্রানাইট, সোনা গ্রেওয়াকের সুপরিচিত উৎস। চকচকি পাথর ছিল প্রথম সংগৃহীত খনিজ পদার্থ যা হাতিয়ার তৈরিতে ব্যবহৃত হত।

চকচকি পাথরের তৈরী কুঠার হল নীলনদ উপত্যকায় মানব বসতির প্রথম নিদর্শন। তামার ব্যবহার শুরু হওয়ার পরও এসব পাথর দিয়ে ধারালো ক্ষুর এবং ফলা তৈরি করা হত। গন্ধক রূপচর্চার কাজে ব্যবহারে মিশরীয়রাই ছিল প্রথম। হাতিয়ার তৈরির কাজে ধাতু ছিল তামা, মালাকাইট আকরিক যা সিনাইয়ে পাওয়া যেত তা থেকে তামা উৎপাদন করা যেত।
পাললিক শিলার মধ্য হতে সোনার খণ্ড সংগ্রহ করা হত। বিভিন্ন স্থান থেকে লোহা, চুনাপাথর, গ্রানাইট, ব্যাসাল্ট ও বেলেপাথর সংগ্রহ করা হত। চুনি এবং পান্না উত্তোলন করা হত।

বাণিজ্য 

নুবিয়ার সাথে সোনা এবং ধুপ সংগ্রহের জন্য বাণিজ্য সম্পর্ক স্থাপিত হয়। রাজা নারমার কানানে মিশরীয় মৃৎপাত্র তৈরি করাতেন এবং তা মিশরে আমদানি করাতেন। পঞ্চম রাজবংশের সময় থেকে পুন্ট থেকে সোনা, সুগন্ধি, আবলুস, হাতির দাঁত এবং বন্য প্রাণী যেমন বানর ও বেবুন আমদানি শুরু হয়। টিন ও তামার জন্য আনাতোলিয়ার উপর নির্ভরশীল ছিল। সুদূর আফগানিস্থান হতে লাপিস-ল্যাজুলি আমদানি করত। ভূমধ্যসাগর অঞ্চল হতে ক্রীট এবং গ্রীস হতে জলপাই তেল আসত।

ভাষা 

প্রাচীন মিশরীয় ভাষা উত্তর অফ্রো এশিয়াটিক ভাষা পরিবারের অন্তর্ভুক্ত, বারবার এবং সেমেটিক ভাষাগুলির নিকট সম্পর্কিত। প্রাচীন মিশরীয় ভাষাকে কয়েকটি পর্যায়কালে ভাগ করা যায় : প্রাচীন, মধ্য, পরবর্তী ডেমোটিক ও কপটিক। অন্যান্য আফ্রোএশিয়াটিক ভাষার মত মিশরীয় ভাষায় ২৫ টি ব্যঞ্জনবর্ণ ছিল এবং নয়টি স্বরবর্ণ।

হায়ারোগ্লিফিক লিপি খৃস্টপূর্ব ৩২০০ অব্দ হতে ব্যবহৃত হয় এবং এত শত শত চিহ্ন রয়েছে। একটি চিহ্ন ধ্বনি, শব্দ কিংবা শুধুমাত্র নির্দেশক রূপে ব্যবহার হতে পারে। এই লিপি অত্যন্ত যত্নের সাথে লেখা হত। প্রতিদিনের লেখার জন্য লিপিকাররা টানা হাতের লেখার এক লিপি ব্যবহার করত যাকে হায়ারেটিক লিপি বলা হয়, এতে লেখা ছিল দ্রুত ও সহজ। হায়ারেটিক লেখা ডান থেকে বামে লেখা হত। পরবর্তীতে একটি নতুন ধরনের লিপি, ডেমোটিক লিপি প্রাধান্য লাভ করে।

ধর্মীয় বিশ্বাস

প্রাচীন মিশরের ধর্মীয় বিশ্বাস মিশরীয় পুরানে প্রতিফলিত হয়েছে। ৩০০০ বছরেরও কিছু বেশি সময় ধরে মিশরে পৌরানিক ধর্মীয় বিশ্বাস প্রচলিত ছিল। পৌরানিক ধর্মে মূলতঃ বহু দেব-দেবীর অস্তিত্ব থাকলেও আখেনআতেনের শাসনামলে একশ্বরবাদের চর্চা করতে দেখা যায়। তার মৃত্যুর পর আগের বহু দেব-দেবীর ধর্মে পুনরায় ফিরে আসে।

প্রাচীন সভ্যতাসমূহের মধ্যে মিশরীয় সভ্যতা জ্ঞান-বিজ্ঞান, শিল্প-সভ্যতা এবং নব নব আবিস্কারে মিশর ছিল বিশ্বসভায় অগ্রগামী। নীলনদের অববাহিকায় কৃষিব্যবস্থা চরম উন্নতি লাভ করে এবং আধুনিক সভ্যতার বিকাশে মিশরীয় সভ্যতার অবদান অপরিসীম।

এই পোস্টটি পরিচিতদের সাথে শেয়ার করুন

পূর্বের পোস্ট দেখুন পরবর্তী পোস্ট দেখুন
এই পোস্টে এখনো কেউ মন্তব্য করে নি
মন্তব্য করতে এখানে ক্লিক করুন

অর্ডিনারি আইটির নীতিমালা মেনে কমেন্ট করুন। প্রতিটি কমেন্ট রিভিউ করা হয়।

comment url