চীনের প্রাচীর পৃথিবীর সবচেয়ে দীর্ঘ স্থাপত্য
চীনের প্রাচীর সম্পর্কে জানার আগ্রহ আজও শেষ হয়নি। এটি পৃথিবীর সপ্তম আশ্চর্যের মধ্যে একটি অন্যতম স্থাপনা। চীনের মহাপ্রাচীর মানুষের তৈরি পৃথিবীর সবচেয়ে বড় এবং দীর্ঘ স্থাপত্য সম্পর্কে আজকের আলোচনা।
চীনের প্রাচীর পৃথিবীর সবচেয়ে দীর্ঘ স্থাপত্য
এই প্রাচীর টি পৃথিবীর সবচাইতে জনবহুল দেশ চীনে অবস্থিত। এই মহাপ্রাচীরের সম্মিলিত দৈর্ঘ পৃথিবীর বিষুব রেখার দৈর্ঘের অর্ধেকের ও বেশি। এটি কোন একক প্রাচীর নয়, চীনের বিভিন্ন রাজবংশের আমলে তৈরি প্রাচীর গুলোকে একত্রে মহাপ্রাচীর বলা হয়। অতীতের এই সামরিক প্রতিরক্ষা স্থাপনা আজ বিশ্ব ঐতিহ্য ও চীনের প্রতীক হয়ে দাড়িয়েছে।
এটার উচ্চতা প্রায় ৫ থেকে ৮ মিটার এবং দৈর্ঘ্য ৮৮৫১.৮ কিলোমিটার এবং চওড়ায় প্রায় ৩২ ফুট। কথিত আছে এই প্রাচীরের উপর দিয়ে একসাথে ১২ জোড়া ঘোড়া চলতে পারত। এটি শুরু হয়েছে সাংহাই পাস এবং শেষ হয়েছে লোপনুর নামক স্থানে। পাথর ও মাটি দিয়ে তৈরি দীর্ঘ প্রাচীর সারি। এগুলি খৃস্টপূর্ব ৫ম শতক থেকে খৃস্টীয় ১৬শ শতক পর্যন্ত চীনের উত্তর সীমান্ত রক্ষা করার জন্য তৈরি হয়।
চীনের প্রথম সম্রাট কিন শি হুয়াঙের অধীনে নির্মিত প্রাচীরটিই সবচেয়ে বিখ্যাত। বর্তমানে এটার সামান্যই অবশিষ্ট আছে। বর্তমানে যে প্রাচীরটি আছে সেটি মিং রাজবংশের শাসনামলে নির্মিত হয়। প্রাচীরটি চীনের ১৫ টি প্রদেশ, কেন্দ্রীয় সরকারের ৯৭ টি প্রশাসনিক অঞ্চল এবং ৪০৪ টি ছোট শহরের মধ্য দিয়ে ঘুরেছে। দীর্ঘ এই প্রাচীর ঘিরে পর্যটকদের উৎসাহের শেষ নাই। প্রতি ইঞ্চিতেই যেন বিষ্ময়।
প্রাচীরের নির্মাণকাল
এর মূল অংশের নির্মাণ শুরু হয়েছিল প্রায় খৃস্টপূর্ব ২০৮ সালের দিকে। নির্মাণ কাজ শুরু করেছিলেন চাইনিজরা কিন সাম্রাজ্যের সময়। এটি নির্মাণ করতে সময় লেগেছিল প্রায় ১৫ বছর। চীনের প্রথম সম্রাট কিন সি হুয়াং এটি প্রথম ব্যবহার করেছিলেন এবং শত্রুর হাত থেকে নিজের সম্রাজ্যকে রক্ষার জন্য অনেক দীর্ঘ করে নির্মাণ করেছিলেন।
তাদের দেশের প্রাকৃতিক বাঁধাগুলো ছাড়া অন্যান্য অঞ্চল পাহারা দেয়ার কাজে এবং উত্তর চীনের উপজাতি সুইং নু বিরুদ্ধে এটি প্রথম স্তরের নিরাপত্তা ব্যবস্থা ছিল। হান, সুই, নরদান এবং জিং সাম্রাজ্যের সময়ের ইতিহাসেও যে কারণে তারা এটি তৈরি করেছিলেন ঠিক একই কারণে চীনের প্রাচীরের পরিবর্ধন, পরিবর্তন, সম্প্রসারণ ও পুনঃনির্মানের উল্লেখ আছে।
বেইজিংয়ের উত্তরে এবং পর্যটন কেন্দ্রের কিছু অংশ সংরক্ষণ এমনকি পুনঃনির্মান করা হলেও দেয়ালের বেশ কিছু অংশ নাশকতার জন্য ধ্বংশের সম্মুখীন। ক্ষতিগ্রস্ত অংশগুলো গ্রাম্য খেলার মাঠ এবং বাড়ি ও রাস্তা তৈরির জন্য প্রয়োজনীয় পাথরের উৎস হিসাবে ব্যবহৃত হয়। কোন পূর্নাঙ্গ জরিপ না করার জন্য এটা জানা সম্ভব নয় যে কতটুকু স্থান রক্ষা পেয়েছে।
উন্নত পর্যটন এলাকার নিকটে মেরামতকৃত অংশ পর্যটন পণ্যের বিক্রয়স্থল হয়ে উঠেছে। এই প্রাচীরে নিয়মিত পর্যবেক্ষণ চৌকি আছে যা অস্ত্র সংরক্ষণ, সেনাবাহীনীর আবাসন, সেনাঘাটি এবং প্রশাসনিক কেন্দ্রসমূহ অবস্থিত। দেখার সুবিধার জন্য পাহাড়সহ অন্যান্য উচুস্থানে সংকেত টাওয়ার স্থাপন করা হয়েছে। মহাপ্রাচীর থাকার পরও দুইবার আক্রমন হয়েছিল। মাঞ্চুরিয়া আর মঙ্গোলিয়ার যাযাবর দস্যুরা চীনের বিভিন্ন অংশে আক্রমণ করত এবং বিভিন্ন ক্ষতি সাধন করত।
চীনের মহাপ্রাচীর চাঁদ থেকে দেখা যায় বলে জনশ্রুতি থাকলেও এটি সত্য নয়। তবে কয়েকজন নভোচারী আন্তর্জাতিক মহাকাশ স্টেশন থেকে এটি দেখতে পাওয়ার দাবি করেছেন। পর্যটকদের জন্য এর কিছু অংশ সংরক্ষণ ও পুণঃর্নিমাণ করা হলেও বেশিরভাগ অংশ কালের গর্ভে চলে গেছে। তবু আশ্চর্য এই প্রাচীর দেখতে পৃথিবীর বিভিন্ন স্থান থেকে প্রতিদিন লাখ লাখ পর্যটক ভিড় করে চীনের এই প্রাচীর দেখতে।
মহাপ্রাচীর তৈরির উদ্দেশ্য ও ইতিহাস
এ রকম বিশাল দীর্ঘ আকৃতির প্রাচীর তৈরি করার প্রয়োজন হয়েছিল কেন ? এমন প্রশ্ন থাকাটাই স্বাভাবিক। ইতিহাস থেকে জানা যায় সে সময় মাঞ্চুরিয়া আর মঙ্গোলিয়ার যাযাবর দস্যুরা চীনের বিভিন্ন অংশে আক্রমন করতো এবং বিভিন্ন ক্ষতি সাধন করতো ফলে দস্যুদের হাত থেকে চীনকে রক্ষা করার জন্য এই প্রাচীর তৈরি করা হয়েছিল।
মানুষের তৈরি বিশ্বের সবচেয়ে দীর্ঘ স্থাপনা তৈরি করা হয়েছিল এক গুজবের উপর ভিত্তি করে। সম্রাট কিং শি হুয়াং খৃস্টপূর্ব ২২১ সালে বিভিন্ন খণ্ড খণ্ড রাজ্য একত্র করে কিন সাম্রাজ্য গড়ে তুলেন। কিন সাম্রাজ্য প্রতিষ্ঠার আগে থেকেই চীনের বেশ কিছু ছোট ছোট রাজ্য শত্রুদের আক্রমন প্রতিহত করার জন্য প্রাচীর নির্মাণ করেছিল।
চীনের উত্তরে গোবি মরুভূমির পূর্বে দুর্ধর্ষ মঙ্গোলিয়দের বাস, যাদের কাজই হলো লুটতরাজ করা। এদের হাত থেকে দেশকে বাঁচানোর জন্য সম্রাটের আদেশে চীনের প্রাচীর তৈরির কাজ আরম্ভ হয়। সম্রাট কিন রাজ্য জয়ের পর এক যাদুকর বলেছিল উত্তরের যাযাবরেরা একদিন তাকে ক্ষমতাচ্যুত করবে। ক্ষমতা হারানোর ভয়ে তখন সম্রাট আসেপাশের ছোট ছোট প্রাচীর গুলোর মধ্যে সংযোগ তৈরি করার আদেশ দেন।
খৃস্টপূর্ব ২২০-২০০ সালের মধ্যে দেয়াল গুলোর মধ্যে সংযোগ সাধন করা হয়। ঠিক তখনই চীনের ছোট ছোট প্রাচীর মিলে মহাপ্রাচীরের আকার ধারণ করে। সেই প্রাচীরে খুব সামান্যই অবশিষ্ট্য আছে। বর্তমানে প্রাচীরের যে সব অংশ দেখা যায় অধিকাংশই মিং রাজবংশের আমলে নির্মিত হয়। তারা প্রায় ৮৮৫১ কিলোমিটার প্রাচীর নির্মাণ করতে সক্ষম হয়েছিল।
শুরু থেকে এই প্রাচীর নির্মাণে ২০ টি রাজবংশ অবদান রেখেছে। প্রাচীর নির্মাণে প্রায় ১০ লক্ষ মানুষকে জোরপূর্বক কাজে লাগানো হয়। সৈনিক, সাধারণ শ্রমিক, বেসামরিক জনতা এবং সাজাপ্রাপ্ত আসামীদেরকে প্রধানত শ্রমিক হিসাবে ব্যবহার করা হয়েছিল। নির্মাণ কাজে প্রায় ৪ লক্ষেরও অধিক লোক মারা যায়। তাদের অনেককে এই দেয়ালের মধ্যে সমাহিত করা হয়।
তাই এটাকে দীর্ঘ মানব সমাধিও বলা হয়ে থাকে। কেউ কেউ নাকি এই প্রাচীরের মধ্যে কান্নার আওয়াজ শুনতে পায়। প্রাচীরের সম্মিলিত দৈর্ঘ ২১১৯৬ কিলোমিটার। এ দেয়াল ছোট ছোট বহু আক্রমন ঠেকাতে পারলেও চেঙ্গিস খানের নেতৃত্বাধীন মোঙ্গল বাহিনী ১৩ শতকে প্রাচীর ভেদ করতে সক্ষম হয় এবং প্রায় ১০০ বছর এই প্রাচীর নিয়ন্ত্রণ করে।
প্রাচীর তৈরি হয়েছিল চিহলি-পুরোনো নাম পোহাই উপসাগরের কূলে শানসীকুয়ান থেকে কানসু প্রদেশের চিয়াকুমান পর্যন্ত। দীর্ঘ এই প্রাচীর ঘিরে আছে অনেক বিষ্ময়। এর মধ্যেও সবচেয়ে সুন্দর ও আকর্ষণীয় ছয়টি স্থান শীর্ষস্থান করে নিয়েছে।
ছয়টি শীর্ষস্থানীয় পর্যটন স্থান
ইয়ংতাই টার্টল সিটি : গ্রেটওয়াল কেবল একটি ইট ও পাথরের প্রাচীর নয়। পাশের উচু উচু পাহাড়ের চূড়া, দুর্গ দিয়ে সাজানো বিভিন্ন শহর সহ স্রোতের টানে বয়ে চলা নদীগুলোকেও এর অংশ হিসাবে গণনা করা হয়। বর্তমানে এই দুর্গ শহরটি চীনের উত্তরে কেন্দ্রীয় গানসু প্রদেশের জিংতাই এর সিতান শহরে অবস্থিত। জিংতাই থেকে মাত্র ৩০ মিনিটের দূরত্ব।
মুতিয়ানু এবং জিয়ানকু : মুতিয়ানু এবং জিয়ানকু মহাপ্রাচীরটির দুটি সংলগ্ন অংশ। বেইজিংয়ের থেকে পাহাড়ের চূড়া বরাবর প্রায় ২৫ কিলোমিটার পর্যন্ত প্রসারিত। ৯০ মিনিটেরও কম সময়ে এখানে যাওয়া যায়। ইতিহাস থেকে জানা যায় লাখ লাখ শ্রমিক এই অংশটুকু নির্মাণে প্রায় শতাব্দী ব্যয় করেছে। এর একবারে চূড়ায় দাড়ালে মাধ্যাকর্ষণ শক্তি অনুভব করা যায়।
মুতিয়ানু এবং জিয়ানকুও মিং রাজবংশের টিকে থাকার দুটি অস্ত্র হিসাবে কাজ করেছে। এর যে কোনটিতে আরোহন করা ভ্রমণপিপাসুদের জীবনের অন্যতম এক অভিজ্ঞতা দেয়। মুতিয়ান পর্যটন কেন্দ্র হিসাবে প্রাচীরের সেরা অংশ।
বাতাইজি : বাতাইজি গ্রামটি মহাপ্রাচীরের মতিয়ানলিং শহরের ঠিক ভিতরে অবস্থিত। ১৮৭৬ সালে নির্মিত একটি গির্জার ধ্বংসাবশেষ রয়েছে। একজন জার্মান ধর্মপ্রচারকের নির্দেশে নির্মিত হয়েছিল। ১৫০ বছরের ইতিহাসে বহুবার ক্ষতিগ্রস্থ হলেও বর্তমানে এটিকে মেরামত করা হয়েছে। গির্জার বেল টাওয়ারটিই একমাত্র অংশ, যা এখনো বিদ্যমান। সুন্দর একটি সকাল বা বিকাল কাটানোর জন্য বাতাইজি একটি অনন্য জায়গা। গ্রীষ্মের শেষের দিকে গ্রামটি দেখার আদর্শ সময়।
লাওনিউওয়ান : লাওনিউওয়ানের আরেক নাম ওল্ড অক্স বেন্ড গ্রেট ওয়াল। স্থানীয়রা মনে করে, লাওনিউওয়ান এমন একটি গ্রাম যেখানে প্রাচীর এবং শক্তিশালী হলুদ নদী এক সঙ্গে হাত মেলায়। এটি ১৪৬৭ সালে নির্মিত হয়েছিল। যখন এই এলাকার গ্রেট ওয়ালের সবচেয়ে বিখ্যাত টাওয়ার ওয়াংহে অবস্থিত। ১৫৪৪ সালে নির্মিত হয়েছিল। গ্রীষ্মের শেষের দিকে গ্রামটি ভ্রমণ করার জন্য উপযুক্ত সময়।
পরি টাওয়ার : সিমাতাই (যেখানে গ্রেটওয়াল নির্মাণ শুরু হয়েছিল) অংশের সবচেয়ে পরিচিত টাওয়ারগুলোর একটি হলো পরি টাওয়ার। কিন্তু এখানে প্রবেশ করা কঠিন বলে খুব বেশি পর্যটক এখানে আসেন না। এর পরিবর্তে ওয়াংজিং টাওয়ার থেকে পরি টাওয়ারের অবিশ্বাস্য সুন্দর দৃশ্য উপভোগ করা যায়। মুতিয়ানু এবং জিয়ানকুর মতো প্রাচীরের এই অংশটি বছরের যে কোনো সময় অনাবিল সৌন্দর্য অবলোকনের নিশ্চয়তা দেয়।
দুশিকৌ : সম্রাট জিয়াজিংয়ের শাসনামলে (১৫০৭-৬৭) নির্মিত প্রাচীরের এই একক অংশটি কিছু জায়গায় সাত মিটার পর্যন্ত লম্বা পাথরের স্তুপ দ্বারা তৈরি করা হয়েছিল। চীনের হুবেই প্রদেশের চিচেংয়ের দুশিকৌ শহরের রাস্তার ঠিক পাশে অবস্থিত। দুশিকৌর স্তুপ পাথরের দেয়ালটি অনন্য একটি স্থান। কারণ বেইজিংয়ের কাছে গ্রেট ওয়ালের অন্যান্য অংশগুলো পোড়া ইট ব্যবহার করে নির্মিত হয়েছিল। এটি জুলাই এবং আগস্টে সবচেয়ে সুন্দর থাকে। পাহাড়গুলো ঘন সবুজে ভরে যায়।
এই প্রাচীরের সবচেয়ে জনপ্রিয় অংশের নাম বাডালিং যা এখনো সুন্দরভাবে সংরক্ষিত আছে। আধুনিককালে প্রায় ৪ শতাধিক রাষ্ট্রপ্রধান চীনের প্রাচীর পরিদর্শন করেন। তাদের মধ্যে ৩০০ জনই এই বাডালিং ভ্রমণ করেছেন।
অর্ডিনারি আইটির নীতিমালা মেনে কমেন্ট করুন। প্রতিটি কমেন্ট রিভিউ করা হয়।
comment url