বিবাহ, বিবাহের ধরন ও কার্যাবলি
বিয়ে বা বিবাহ হচ্ছে প্রাপ্তবয়স্ক একজন নারী ও পুরুষের মধ্যে এমন এক যুগল বন্ধন যা সমাজ, ধর্ম ও আইন দ্বারা সমর্থিত। এ বন্ধন সংশ্লিষ্ট পুরুষ ও নারীকে স্বামী ও স্ত্রীর মর্যাদা প্রদান করে এবং একত্রে বসবাস, পরিবার গঠন ও সন্তান জন্মদানের অধিকার অর্জন করে। বিবাহ, বিবাহের ধরন ও কার্যাবলি আলোচনা করা হল।
বিবাহ পরিবার গঠনের অন্যতম প্রাথমিক শর্ত পূরণ করে এবং সংশ্লিস্ট নারী-পুরুষের মধ্যে মোটামুটি স্থায়ী সম্পর্ক প্রতিষ্ঠা করে। পারস্পরিক বিশ্বাস, সম্মানবোধ, আবেগ-অনুভূতি ও সুখ-দুঃখ ভাগ করে নেওয়ার মনোবৃত্তি বৈবাহিক সম্পর্কের আরও কিছু গুরুত্বপূর্ণ দিক। সাধারণ ভাবে বিবাহ এমন একটি প্রতিষ্ঠান যার মাধ্যমে দুজন মানুষের মধ্যে ঘনিষ্ট ও যৌন সম্পর্ক সামাজিক স্বীকৃতি লাভ করে।
বিবাহের সংজ্ঞা
বিবাহ হল একটি বৈশ্বিক সার্বজনীন সংস্কৃতি। কোন রাষ্ট্র, কোন সংস্থা, কোন ধর্মীয় কর্তৃপক্ষ, কোন আদিবাসী গোষ্ঠী, কোন স্থানীয় সম্প্রদায় দ্বারা স্বীকৃত হতে পারে। একে প্রায়শই একটি চুক্তি হিসাবে দেখা হয়। সাধারনত ধর্মীয় আচার অনুষ্ঠানের মধ্যদিয়ে বিবাহ সম্পন্ন করা হয়। বৈবাহিক কার্যক্রম সাধারনত দম্পতির মাঝে সমাজ স্বীকৃত বা আইনগত দায়িত্ববোধ তৈরি করে এবং এর মাধ্যমে তারা বৈধভাবে স্বেচ্ছায় সন্তান জন্ম দিতে পারে।
বিশ্বের কিছু স্থানে পরিবার পরিকল্পিত বিবাহ, শিশু বিবাহ, বহুবিবাহ এবং জোরপূর্বক বিবাহ সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য হিসাবে পালিত হয়। বিভিন্ন ধর্মে বিবাহের বিভিন্ন রীতি প্রচলিত। একইভাবে বিভিন্ন সমাজে বিভিন্ন প্রথায় বিবাহ অনুষ্ঠিত হয়ে থাকে। বিবাহ মূলত একটি ধর্মীয় রীতি হলেও আধুনিক সভ্যতায় এটি একটি আইনি প্রথাও বটে।
ইসলামী বিবাহরীতিতে পাত্র পাত্রী উভয়ের সম্মতির এবং বিবাহের সময় উভয়পক্ষের অভিভাবকদের উপস্থিতি ও সম্মতির প্রয়োজন হয়। বিয়ের পূর্বেই পাত্রের পক্ষ হতে পাত্রীর দাবি অনুযায়ী পাত্রীকে একটি নির্দিষ্ট অঙ্কের টাকা বা অর্থসম্পদ বাধ্যতামূলকভাবে দিতে হয়, একে দেনমোহর বলা হয়। ইসলামী বিধান অনুযায়ী একজন পুরুষ সকল স্ত্রীকে সমান অধিকার প্রদানের শর্তে সর্বোচ্চ চারটি বিয়ে করতে পারে।
একজন মুসলিম অন্য ধর্মের মেয়েকে বিয়ে করতে পারবে যদি মেয়েটি ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করে। হিন্দু ধর্মানুযায়ী বিবাহ একটি ধর্মানুষ্ঠানও বটে। যদিও পাত্র-পাত্রী উভয় পক্ষের মতামত ভিত্তিক চুক্তির প্রয়োজন হয়।
সমাজতাত্ত্বিকভাবে বলা চলে যে বিবাহ হল বয়োপ্রাপ্ত একজন পুরুষ ও মহিলার মধ্যে সম্পাদিত এমন চুক্তি যার ফলে তারা একত্রে বসবাস করার, পরিবার গঠনের, সন্তান জন্মদানের একটি আইনগত ও সামাজিক সম্মতি লাভ করে।
বিবাহের সর্বজন স্বীকৃত সংজ্ঞা নাই। বিভিন্ন সমাজবিজ্ঞানীরা বিভিন্নভাবে বিবাহকে সংজ্ঞায়িত করেছেন । এডওয়ার্ড ওয়েস্টারমার্ক বলেন, বিবাহ হচ্ছে মেয়ে ও পুরুষের মোটামুটি স্থায়ী এমন একটি সম্পর্ক যা কেবল সন্তান জন্মদান পর্যন্তই স্থায়ী হয় না বরং এরপরও কিছুদিন অন্তত স্থায়ী হয়। ই আর গ্রোভস নামক এক সমাজবিজ্ঞানী বলেন, বিবাহ হচ্ছে এমন এক দুঃসাহসিক বন্ধুত্ব যার আইনগত রেজিষ্ট্রেশন এবং সামাজিক গোষ্ঠীর সমর্থন আছে।
বিবাহ যেখানে মেয়ে ও পুরুষের মধ্যে সমাজ, রাষ্ট্র ও ধর্ম সম্পর্কিত চুক্তির সম্পর্ককে নির্দেশ করে পরিবার সেখানে সমাজিক সংগঠনকে নির্দেশ করে। আধুনিক কিছু সমাজবিজ্ঞানী বিবাহকে পরিবারের আনুষ্ঠানিক দিক বলে আখ্যা দেন।
বিবাহের গুরুত্বপূর্ণ কিছু শর্ত
- বয়োপ্রাপ্ত হওয়া। মেয়েদের ক্ষেত্রে কমপক্ষে ১৮ বছর এবং ছেলেদের ক্ষেত্রে কমপক্ষে ২০ বছর বয়স হওয়া বিবাহের অন্যতম শর্ত। অর্থাৎ অপ্রাপ্ত বয়স্কদের মধ্যে বিবাহ অনুষ্ঠিত হতে পারবে না।
- বিবাহের আরেকটি শর্ত হল বিবাহের প্রস্তাব পেশ করা। এক পক্ষ অন্য পক্ষের কাছে বিবাহের প্রস্তাব করবে।
- উক্ত প্রস্তাবে অপর পক্ষ সম্মতি দিবে।
- বিবাহে স্বাক্ষী থাকবে।
- বিবাহ অনুষ্ঠানকালে প্রস্তাব বা অন্যান্য উচ্চারিত শব্দাবলি অবশ্যই সুস্পষ্ট হতে হবে।
- প্রস্তাব এবং এর গ্রহণ একই বৈঠকে উচ্চারিত হতে হবে।
- পাত্র অবশ্যই স্ত্রী এবং তাদের সন্তানদের ভরণ-পোষণের দায়িত্ব নেয়ার উপযুক্ত হবে।
বাংলাদেশে বিবাহের বিভিন্ন ধরন
মনোগামী বা একক বিবাহ : মনোগামী বা একক বিবাহ হল বাংলাদেশের সমাজের বিবাহের সাধারণ রীতি। প্রায় সব সমাজেই অধিকংশ বিবাহ মূলত এক বিবাহ। অর্থাৎ বয়োপ্রাপ্ত একজন পুরুষ বয়োপ্রাপ্ত একজন মহিলার সাথে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হওয়ার রীতিই প্রাধান্য পেয়ে আসছে। আর এটাই স্বাভাবিক এবং সাধারণ রেওয়াজ।
বহুস্ত্রী বিবাহ : গ্রিক ভাষায় পলিজিনি অর্থ অনেক মহিলা। এক জন পুরুষের সঙ্গে একাধিক মহিলার বিবাহকে বহু স্ত্রী বিবাহ বলা হয়। পৃথিবীর বিভিন্ন স্থানে বহু স্ত্রী বিবাহের উদাহরণ আছে। এক স্ত্রীর বর্তমানে আরেক স্ত্রী গ্রহণ করার মাধ্যমে বহুস্ত্রী বিবাহ ভিত্তিক পরিবারের উদাহরণ কম নয়। ইসলাম ধর্মে স্ত্রীর প্রতি সমান আচরণ করার কঠিন শর্তে চারটি পর্যন্ত স্ত্রী গ্রহণ করার অনুমতি রয়েছে। গ্রামীন বাংলাদেশে এক সময় ধনী কৃষক কৃষিকাজের সংসারে একাধিক স্ত্রী গ্রহণ করত । বর্তমানে শিক্ষা ও সচেতনতা বৃদ্ধির ফলে বহু স্ত্রী গ্রহণের প্রবণতা অনেকটা কমে গেছে।
বিধবা বিবাহ : বাংলাদেশের মুসলিম সমাজে বিধবা বিবাহের স্বীকৃতি আছে। পক্ষান্তরে হিন্দু সমাজে বিধবা বিবাহ অদ্যবধি সামাজিকভাবে নিরুৎসাহিত করা হয়েছে। স্বামীর মৃত্যুর পর নানা কারণে কোনো বিধবা মহিলা বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হয়ে দ্বিতীয়বার স্বামী গ্রহন করে থাকে। যে স্বামী নিজেও আগে একবার বিবাহ করেছিলেন।
বিপত্নিক বিবাহ : স্ত্রীর মৃত্যুতে একজন পুরুষ ব্যক্তি বিপত্নিক হন। বাংলাদেশের সমাজে বিপত্নিকদের অনেকেই পুনরায় বিবাহ করেন। সাধারনত সন্তানহীন অথবা দু’একটি সন্তানসহ যারা বিপত্নিক হন তারা প্রায় ক্ষেত্রে দ্বিতীয়বার স্ত্রী গ্রহণ করেন।
লেভিরেট বিবাহ : কোনো বিধবা মহিলার সঙ্গে তার মৃত স্বামীর যে কোন ভাইয়ের বিবাহকে লেভিরেট বিবাহ বলা হয়। এই রীতি অনুযায়ী কোন ব্যক্তি মারা গেলে তার বিধবা স্ত্রী মৃত স্বামীর যে কোন ভাইকে বিবাহ করে। আমাদের সমাজে এর উদাহরণ একবারে কম নয়।
সরোরেট বিবাহ : সরোরেট প্রথায় মৃত স্ত্রীর ছোট বোনকে বিয়ে করলে তাকে সরোরেট বিবাহ বলে। আমাদের সমাজে মৃত স্ত্রীর ছোট বোনকে বিয়ের রীতিও লক্ষ করা যায়। বৈবাহিক সম্পর্ককে স্থায়ী করতে অথবা অল্প বয়সী শিশু সন্তানের লালন-পালনের সুবিধার্থে অনেকে এই পথ বেছে নেন।
প্যারালাল বিবাহ : চাচাত এবং খালাত ভাইবোনদের মধ্যে বিবাহকে প্যারালাল বিবাহ বলে। আমাদের সমাজে চাচাত এবং খালাত ভাই বোনের মধ্যে বিবাহের ঘটনা কম নয়। সন্তানদের প্রতি স্নেহ-মায়ামমতার কারণেও কেউবা এ ধরনের বিবাহ রীতি বেছে নেন।
ক্রসকাজিন বিবাহ : মামাত-ফুফাত ভাইবোনদের মধ্যে বিবাহকে ক্রসকাজিন বিবাহ বলে। মামাত-ফুফাত ভাই বোনের মধ্যে বিবাহ অনুষ্ঠিত হওয়ার ঘটনাও খুব কম নয়। আত্মীয়তার সম্পর্ককে জোরদার করা এবং সম্পত্তি নিজেদের মধ্যে রাখার উদ্দেশ্যে সাধারনত এই ধরণের বিবাহ হয়ে থাকে।
অন্তর্বিবাহ : নিজের সমাজ বা গোত্রের ভিতরে বিবাহ করাকে অন্তর্বিবাহ বলে। এটা এমন একটা বিবাহ রীতি যে ক্ষেত্রে পাত্র-পাত্রী নির্বাচনের সময় কাউকে নিজ গোষ্ঠীর ভিতেরে খুঁজতে হয়। এতে রক্তের বিশুদ্ধতা তুলনামূলকভাবে বেশি রক্ষিত হয়। কার্যত একই ভাষা, একই দেশ, একই সমাজ ও আর্থ-সামাজিক মর্যাদার লোকদের মধ্যেই বিবাহ অগ্রাধিকার পায়।
বহির্বিবাহ : কোন ব্যক্তির নিজ সমাজ বা গোত্রের বাইরে বিবাহ করাকে বহির্বিবাহ বলে। এ ক্ষেত্রে কোন ব্যক্তিকে পাত্র-পাত্রী তার গোষ্ঠীর বাইরে থেকে নির্বাচন করতে হয়। বহির্বিবাহ মানব সম্পর্কের বলয় বৃদ্ধিতে বেশ সহায়ক ভূমিকা পালন করে।
বিবাহের ভূমিকা ও কার্যাবলি
কোন অনুষ্ঠান বা প্রতিষ্ঠান বিনা প্রয়োজনে গড়ে ওঠে নি। বিবাহ একটি সামাজিক অনুষ্ঠান যার মাধ্যমে পরিবার নামক সংঘ তথা সংগঠন গড়ে ওঠে। পরিবার যেমন বিভিন্ন কাজের মাধ্যমে টিকে আছে তেমনি বিবাহও কতগুলো গুরুত্বপূর্ণ কাজের মাধ্যমে টিকে আছে।
বিবাহ একজন পুরুষ ও মহিলার মধ্যে সমাজ স্বীকৃতভাবে এমন একটা চুক্তি সম্পাদন করে যা নানাভাবে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ বলে বিবেচিত। যেমন বিবাহ একটি সন্তানকে বৈধতা দান করে। বিবাহ ছাড়া সন্তান হলে সেই সন্তানকে অনেক সমাজেই অবাঞ্চিত মনে করা হয় এবং তার পারিবারিক ও সামাজিক স্বীকৃতি নিয়ে অনেক জটিল প্রশ্ন উত্থাপিত হয়।
বিবাহ একটি সন্তানকে সামাজিকভাবে স্বীকৃত পিতামাতা দান করে। কেননা একজন পুরুষ এবং মহিলা জৈবিক পিতামাতা হলেও বিবাহ ছাড়া তারা সামাজিক পিতামাতা হতে পারে না। সামাজিক পিতামাতা আইনগত মর্যাদা লাভ করে।
বিবাহ যৌন জীবনকে সুনিয়ন্ত্রিত করে। বিবাহই হচ্ছে একমাত্র মাধ্যম যা একজন পুরুষ ও মহিলাকে দাম্পত্য জীবনের সামাজিক, ধর্মীয় ও আইনগত স্বীকৃতি দান করে। আনুষ্ঠানিক প্রকৃয়ায় বিবাহ ব্যবস্থা না থাকলে সমাজে যৌন উচ্ছৃঙ্খলা দেখা দিত।
বিবাহ সামাজিক বন্ধন এবং সম্পর্ককে তৈরি করে। বিবাহের মাধ্যমে চেনা-অচেনা অনেকের সাথে সামাজিক সম্পর্ক গড়ে উঠে অর্থাৎ সামাজিক সম্পর্কের প্রসার ঘটায়।
বিবাহ কখনও বা কারও জন্য নতুন নতুন পেশা, কর্মক্ষেত্র এবং নতুন ধরনের অর্থনৈতিক কার্যাবলীর সুযোগ সৃষ্টি করে। স্বামীপক্ষ বা স্ত্রীপক্ষ উভয় পক্ষই নিজেদের সংস্পর্শে এসে নতুন নতুন কর্মক্ষেত্রের সন্ধান লাভ করে থাকে।
বিবাহ স্থানান্তর গমনের সুযোগ সৃষ্টি করে। অনেক সময় বিয়ের পর নব দম্পতি স্বামী বা স্ত্রী পক্ষের কোন এলাকায় গিয়ে বসবাস করে। যে সব এলাকায় জনসংখ্যা অনুপাতে ভূমি এবং অন্যান্য প্রাকৃতিক সম্পদ পাওয়ার সম্ভাবনা বেশি, সেখানে যদি কারও আত্মীয় থাকে তবে অন্য স্থান থেকে সেখানে স্থান্তরিত হয়ে বসবাস করার সম্ভাবনা থাকে।
বিবাহ নব-দম্পতির মধ্যে দায়িত্ব, কর্তব্য এবং মর্যাদাবোধ বৃদ্ধি করে। বিবাহের মাধ্যমে মানুষ পরিবার গঠন করে। বিবাহ নব-দম্পতির মধ্যে বৈষয়িক বিষয়ে সচেতনতা এবং দায়িত্বশীলতা জাগিয়ে তোলে।
বিবাহ মানবজীবনের পূর্ণতা আনতে এক গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। এখানে বিবাহ, বিবাহের ধরন ও কার্যাবলি বিশদভাবে আলোচিত হয়েছে। বিবাহ ছাড়া মানবজীবনে সর্বাঙ্গীন পরিপূর্নতা আসে না। বস্তুত বিবাহ দম্পতির মধ্যে এক ধরনের সমাজ কর্তৃক কাঙ্খিত ভারসাম্যপূর্ণ আচরণের ভিত তৈরি করে।
অর্ডিনারি আইটির নীতিমালা মেনে কমেন্ট করুন। প্রতিটি কমেন্ট রিভিউ করা হয়।
comment url