মাদকাসক্তির কারণ, ধরন, প্রভাব ও প্রতিকার
মাদকদ্রব্য সেবন যখন কোন ব্যক্তির নেশায় পরিণত হয়, তখন তা একসময় তার মানষিক ও শারীরিক নির্ভরতার অবলম্বনে পরিণত হয়। এ অবস্থাকেই মাদকাসক্তি বলে। মাদকাসক্তির কারণ, ধরন, প্রভাব ও প্রতিকার সম্পর্কে আজকের আলোচনা।
নেশাজাতীয় দ্রব্যের প্রতি ক্রমাগত আকর্ষণ বৃদ্ধি হয়। তার সমস্ত মনোযোগ কেড়ে নেয় নেশা। চেনা মানুষটি বদলে যায়। জীবনের সব ধরনের শৃঙ্খলা ভেঙ্গে পড়ে। জীবন যাপনে দেখা যায় উচ্ছৃঙ্খলতা। সামাজিক মানুষটি আস্তে আস্তে অসামাজিক হয়ে পড়ে। নেশার টাকার জন্য যে কোন কাজ করতে প্রস্তুত থাকে।
খুব সহজ ভাষায় বলতে গেলে মাদক গ্রহনের প্রতি যে নির্ভরশীলতা ও প্রবণতা তাকেই মাদকাশক্তি বলা হয়। মাদকের ক্ষতিকর প্রভাব এত বেশি যে জাতিসংঘ ১৯৯১ সাল থেকে ২০০০ সাল পর্যন্ত পুরো একটি দশককে মাদক বিরোধী দশক হিসাবে ঘোষণা করে। ২৬ জুনকে ঘোষণা করে মাদক বিরোধী দিবস হিসাবে।
পুরো পৃথিবীতে মাদক ছড়ানো
আফিম বানানো হয় পপি গাছের ফুল থেকে। এই আফিম ব্যবহার হয়ে আসছে খৃস্টপূর্ব ৩০০০ সাল থেকে। উনিশ শতাব্দীতে এই আফিম থেকে আলাদা করা হয় মরফিন। পরে পরীক্ষাগারে বানানো হয় হিরোইন। ১৯৮০ ও ১৯৯০ এর দশকে ঔষধ কোম্পানিগুলো ব্যাথানাশক হিসাবে এই মরফিন জাতীয় দ্রব্যের ব্যাপক প্রচলন করে।
নেশা সৃস্টিকারী পার্শ্ব প্রতিক্রিয়াকে লুকিয়ে এর প্রচলন করা হয়। যার ফলে এই মাদকের কবলে পড়ে হাজার হাজার মানুষ। সময়ের সাথে সাথে মস্তিস্কের কোষে আফিম জাতীয় পদার্থের প্রতি টলারেন্স বাড়ে। ফলে একই অনূভুতি পেতে অনেক বেশি মাদকের প্রয়োজন হয়। জন্মায় আসক্তি।
আসক্ত ব্যক্তির আচরনে কিছু পরিবর্তন
- হটাৎ পুরানো বন্ধু বাদ দিয়ে নতুন বন্ধুদের সাথে মেলামেশা বেড়ে যায়।
- খাওয়া দাওয়াতে পরিবর্তন ও চেহারায় ছাপ।
- অসংলগ্ন আচরণ ও কথাবার্তা বলা। ঘুম থেকে উঠে মেজাজ খারাপ করা।
- যদি দিনে ঘুমায় রাতে জেগে থাকে। অথবা বেশি ঘুমায়।
- বেশি সময় বাথরুমে থাকা বা ঘরের দরজা অনেকক্ষণ বন্ধ করে রাখা।
- মিথ্যা কথা বলা বেড়ে যায়। অনেক সময় তাদের চুরির অভ্যাসে তৈরি হয়।
- বিভিন্ন অজুহাতে ঘনঘন টাকা চাওয়া।
শিশু ও মাদকাসক্তি
বর্তমানে আমাদের দেশে ছোট শিশুদের মধ্যেও মাদকাসক্তির প্রবনতা দেখা যাচ্ছে। এক জরিপে দেখা যায় ৭-১১ বছর বয়সী ১০০০ জনের মধ্যে ২ জন মাদক গ্রহণ করে। এ বয়সে মাদক সেবনে প্রধানত দায়ী থাকে পরিবার আর সামাজিক পরিবেশ। বেশিরভাগ বস্তিতে শিশুরা মাদকের সাথে বেড়ে উঠতে দেখা যায়। অনেক সময় নিজেরাও জড়িয়ে পড়ে মাদক চোরাচালান সহ নানারকম অপরাধমূলক কাজে।
আর এ ভাবে মাদকাসক্ত হয়ে পড়ে। এছাড়াও জিনগত প্রভাব থেকেও মাদকে আসক্ত হয়ে পড়তে পারে। গবেষকরা দেখিয়েছেন ৪০-৬০ ভাগ ক্ষেত্রে এপিজেনেটিক্স আর পরিবেশগত প্রভাব একসাথে একজন ব্যক্তির মাদকাসক্তিতে কাজ করে।
বয়সের সাথে নেশার সম্পর্ক
বর্তমান তরুণ প্রজন্মের মধ্যে মাদকাসক্তির ব্যাপকতা সবচেয়ে বেশি দেখা যায়। সাধারণত ছোট অবস্থায় মাদক গ্রহণের স্বাধীনতা খুব একটা থাকে না। আবার পারিবারিক অনুশাসন কিছুটা বেশি থাকায় ছোট শিশুদের মধ্যে মাদকের ব্যবহার কম দেখা যায়। আবার মাদকাসক্তের গড় জীবনকাল স্বাভাবিক মানুষ থেকে কম হওয়ায় অনেকেই রোগ শোকে অকালে মারা যায়।
১২-১৭ বছর বয়সীদের মধ্যে ১.৫ শতাংশই মাদকাসক্ত। আর ১৮ বছরের বেশি বয়স্ক ৩.৩ শতাংশ মানুষই মাদকসেবী। অতি প্রাচীনকাল থেকে আমাদের দেশে বিভিন্ন ধরনের মাদকদ্রব্য সেবনের কথা জানা যায়। যেমন- তামাক, ধুমপান, ভাং, গাঁজা ও তাড়ি। যেসব মাদক দ্রব্য সারা দেশকে গ্রাস করে ফেলেছে তা হল হিরোইন, প্যাথেডিন, গাঁজা, আফিম, চরস, ভাং, মরফিন ও ফেনসিডিল সহ নানা ধরনের ঘুমের বড়ি।
কয়েক বছর আগে এক সরকারি জরিপে জানা গেছে সারা দেশে বর্তমানে ৫০ লক্ষ মানুষ মাদকাসক্ত। শহর-বন্দর গ্রামে মাদকাসক্তের সংখ্যা আশঙ্কাজনক হারে বেড়েই চলেছে। মাদকাসক্তি এখন মহামারী আকারে সর্বত্র ছড়িয়ে পড়েছে। এই সংখ্যা আরো বৃদ্ধি পাওয়ার আগেই যথাযথ কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণ একান্ত প্রয়োজন। এ কাজে প্রতিটি ব্যক্তি, পরিবার, সমাজ ও রাষ্ট্রকে একযোগে এগিয়ে আসতে হবে। এগিয়ে আসতে হবে কিশোর, যুবক, বৃদ্ধ সবাইকে।
মাদকাসক্তির প্রভাব
মাদকাসক্ত ব্যক্তির অস্তিত্ব বিপন্ন করে : মাদকাসক্ত ব্যক্তি মাদকদ্রব্যের ওপর বাধ্যতামূলকভাবে নির্ভরশীল হয়ে পড়ে। এই নির্ভরশীলতা ক্রমে মাদকাসক্তকে এমন এক পর্যায়ে নিয়ে যেতে পারে যেখানে মাদকাসক্ত ব্যক্তি আত্মহত্যা ছাড়া মাদকদ্রব্য গ্রহণের কোনো বিকল্প খুঁজে পায় না। মাদকাসক্ত ব্যক্তির জন্য অপেক্ষা করে এক করুণ পরিনতি।
মাদকাসক্তি পরিবারের সুখ-শান্তি বিপন্ন করে তোলে : একজন মাদকাসক্ত ব্যক্তি গোটা পরিবারিক পরিবেশকে কলুষিত করে তুলতে পারে। এমনকি কোনো কোনো ক্ষেত্রে মাদকাসক্তি পারিবারিক ভাঙ্গনের কারণ হয়ে দেখা দিয়েছে। মাদকাসক্তের গৃহত্যাগ অথবা স্বামী বা স্ত্রীর পৃথক বাস বা বিবাহ বিচ্ছেদের সূত্রপাত করছে।
মাদকাসক্তি নানা ধরনের অপরাধের কারণ
প্রথমত : কিছু কিছু মাদকদ্রব্য ব্যক্তিকে এমনভাবে উত্তেজিত করে তোলে যে ক্ষেত্রে ব্যক্তি আক্রমাণাত্মক স্বভাবী হয়ে পড়ে এবং অপরাধপ্রবণ করে তোলে।
দ্বিতীয়ত : যে কোনো মাদকাসক্ত ব্যক্তি ক্রমে মাদকদ্রব্যের প্রতি অত্যাসক্ত হয়ে পড়ে। মাদকদ্রব্য গ্রহণের মাত্রা বাড়তে থাকে। এতে প্রচুর অর্থের প্রয়োজন হয়। ফলে এই অর্থ সংগ্রহের জন্য অবৈধ পন্থার আশ্রয় নিতে হয়।
তৃতীয়ত : মাদক দ্রব্যের উৎপাদন, অবৈধ ব্যবসা ও পাচারকে কেন্দ্র করে নানা ধরনের অপরাধ সংঘটিত হওয়ার খবর প্রকাশিত হচ্ছে। ইদানিং আমাদের সমাজে অপরাধ বৃদ্ধির অন্যতম কারণ মাদকাসক্তি।
চতুর্থত : মাদকাসক্তি বিভিন্ন ধরনের অসামাজিক কার্যকলাপের জন্যও দায়ী। যেমন, মাদকাসক্তি কোনো ব্যক্তিকে জুয়া খেলা, অশ্লিল ছবি দর্শন, এমন কি পতিতালয়ে টেনে নেয়।
মাদকাসক্তি অর্থনীতির ওপর প্রতিকুল প্রভাব রাখে : মাদকাসক্তি অর্থনীতিকে পঙ্গু করে দেয়। কারণ মাদকাসক্ত ব্যক্তি কর্মক্ষমতা হারায়। ফলে উৎপাদন ব্যাহত হয়।
মাদকাসক্তি যানবাহন দুর্ঘটনার জন্য দায়ী : যানবাহন দুর্ঘটনার জন্য অন্যতম কারণ মাদকাসক্তি। মাদকাসক্ত ড্রাইভার সম্পূর্ণ স্বাভাবিকভাবে যানবাহন চালাতে পারে না। ফলে দুর্ঘটনা প্রায় অনিবার্য হয়ে দেখা দেয়।
মাদকদ্রব্য জনস্বাস্থ্যখাতে ব্যয় বৃদ্ধি করে : মাদকাসক্তদের চিকিৎসা ও পুনর্বাসনের জন্য প্রচুর অর্থের প্রয়োজন হয়। তাই মাদকদ্রব্য জনস্বাস্থ্য খাতে ব্যয় বৃদ্ধি করে।
মাদকাসক্তি আইন প্রয়োগকারী সংস্থার কাজের চাপ বৃদ্ধি করে : মাদকাসক্তি বিভিন্ন অপরাধের জন্য দায়ী এবং মাদকদ্রব্যের অবৈধ ব্যবসা ক্রমশ বিস্তার লাভ করেছে। এসব দিকে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী সংস্থাকে বিশেষ নজর দিতে হয়।
মাদকাসক্তি বিচার বিভাগের জন্যও অতিরিক্ত চাপ সৃষ্টি করে : মাদকাসক্তি বিভিন্ন অপরাধ সৃষ্টি করে। ফলে আদালতে কাজ বৃদ্ধি পাচ্ছে। মাদকদ্রব্যের চোরাচালান সম্পর্কেও অনেক মোকদ্দমা চলছে। ফলে আদালতে বাড়তি কাজ দেখা দিচ্ছে।
মাদকাসক্তি অনেকের জন্যই বিরক্তি ও আতঙ্কের কারণ : মাদকাসক্ত ব্যক্তির অস্বাভাবিক চাল-চলন, আচার-আচরণ ও কথাবার্তা সবার কাছেই বিরক্তি তথা উদ্বেগের কারণ। বস্তুত এভাবেই সামাজিক নিরাপত্তাকে দারুণভাবে বিঘ্নিত করে।
মাদকাসক্তি ও এইডস : যেসব মাদকাসক্ত ব্যক্তি ইনজেকশন নিতে অভ্যস্ত তারা অনেকেই দল বেধে একই সময় একই সুচ ও সিরিঞ্জ ব্যবহার করে। এটা এইডস রোগের অন্যতম কারণ। এভাবে গোটা সমাজ সংক্রামিত হতে পারে।
মাদকাসক্তির কারণ
মাদকাসক্তির অনেক কারণ আছে। বিভিন্ন ব্যক্তি বিভিন্ন কারণে অথবা একই ব্যক্তি একাধিক কারণে মাদকাসক্ত হতে পারে। বাংলাদেশে মাদকাসক্তির জন্য যেসব কারণকে সাধারনত দায়ী করা হয় সেগুলো হলো-
১. পারিবারিক কারণ : যে সব পরিবারের পিতামাতা বিভিন্ন কাজে অতিশয় ব্যস্ততার কারণে সন্তানদের ব্যক্তিত্ব গঠনে প্রয়োজনীয় সময় দিতে পারে না। ফলে সন্তানরা অবাদ্ধ হয়ে উঠতে পারে এবং পরিবারের অজ্ঞাতসারে মাদকে জড়িয়ে যেতে পারে। পরিবারের পিতামাতা বা অন্য কোন বয়স্ক ব্যক্তি যদি মাদকাসক্ত হন তাহলে তার প্রভাব সন্তানদের ওপর পড়তে পারে।
যেসব পরিবারে পিতামাতার মধ্যে প্রায় ব্যক্তিত্বের সংঘাত চলতে থাকে অথবা এক সময় বিবাহ বিচ্ছেদ ঘটে সে সব পরিবারের সন্তানদের মধ্যে হতাশার সৃষ্টি হতে পারে। এর ফলেও মাদকাসক্তিসহ অন্যান্য অসামাজিক আচরণে লিপ্ত হতে পারে।
২. প্রেমে ব্যর্থতা : প্রেমে ব্যর্থ হয়ে একে অপরের বিরুদ্ধে প্রতিশোধ নেওয়ার অভিমানবশে কেউবা মাদকাসক্ত হয়ে পড়তে পারে।
৩. উদ্বেগ উত্তেজনা : চারিদিকে নানা অনিয়ম, বিশৃঙ্খলা, অপরাধ, দুর্ঘটনা, সন্ত্রাস ইত্যাদি কারণে অনেকে কাজের আনন্দ থেকে বঞ্জিত হচ্ছে। কেউ যোগ্যতা থাকা সত্বেও চাকরি পাচ্ছে না বা প্রমোশন পাচ্ছে না। হাড়ভাঙ্গা খাটুনি খেটেও পরিবারে নানা অভাব অভিযোগ। বস্তুত এসব কিছুই উদ্বেগ- উত্তেজনার কারণ। এটা থেকে সাময়িক মুক্তির জন্য কেউবা ক্রমে ক্রমে মাদকাসক্ত হয়ে পড়তে পারে।
৪. সঙ্গদোষ : ‘সৎ সঙ্গ স্বর্গবাস, অসৎ সঙ্গ সর্বনাশ’ প্রবাদটি দীর্ঘদিনের সামাজিক অভিজ্ঞতার ফসলই বলা চলে। কিশোর যুবকরা পাড়া মহল্লায় ও স্কুল কলেজে নানা ধরনের সঙ্গী সাথীদের সংস্পর্শে আসে। তাদের অভ্যাস ও আচরণ দ্বারা কিশোর যুবকরা প্রভাবিত হয়। মাদকাসক্তি তাই সঙ্গদোষের কারণেও সৃষ্টি হতে পারে।
৫. কৌতুহল : মাদকাসক্তির বিস্তারের একটা অন্যতম কারণ হল মাদকের প্রতি আগ্রহ ও কৌতুহল। কৌতুহল নিবারণ করতে গিয়ে ক্রমে ক্রমে জ্ঞাত বা অজ্ঞাতসারে মাদকের প্রতি আকৃষ্ট হয়ে পড়ে। তখন আর ফিরে আসার উপায় থাকে না।
৬. অনুকরণ অনুসরণ : মাদকাসক্তির আরেকটি কারণ হল অনুকরণ। বিদেশী পত্র পত্রিকা পাঠ, সিনেমা, ইন্টারনেট ও মোবাইল দেখে মাদকাসক্তিকে একটি অনুকরণীয় ফ্যাশন বিবেচনা করে মাদকাসক্ত হয়ে পড়ে।
৭. মাদকদ্রব্যের সহজলভ্যতা ও প্রশাসন : প্রশাসনের কারো কারো সহায়তায় বা তাদের চোখ ফাকি দিয়ে মাদকদ্রব্য ক্রমেই বেশি বেশি পরিমানে আসছে। ফলে অনেকের কাছেই মাদকদ্রব্য হয়ে পড়ছে সহজলোভ্য
৮. রাজনৈতিক অস্থিরতা : একটি সুস্থ স্বাভাবিক ও নিয়মতান্ত্রিক রাজনৈতিক প্রকৃয়া ব্যক্তির রাজনৈতিক চিন্তাধারা স্বাভাবিক তথা যুক্তিসিদ্ধ ধারায় প্রভাহিত করতে পারে। রাজনৈতিক অস্থিরতা ব্যক্তির আচরণ ও চিন্তাকে স্বাভাবিক ধারায় চলতে দেয় না। এমন অবস্থার চাপেও কেউবা হয়ে পড়ে মাদকাসক্ত।
৯. বেকারত্ব ও দারিদ্র্য : বেকারত্ব জীবনে বয়ে আনে হতাশা। বেকার জীবনে অবসর সময় কাটে নানা দুশ্চিন্তা ও উদ্বিগ্নতার মধ্য দিয়ে। ফলে বেকারত্বের অভিশাপ থেকে সাময়িক মুক্তির জন্য কেউবা নেশাগ্রস্থ হয়ে পড়ে। মাদক ব্যবসায়ীরা দরিদ্র্য ব্যক্তিদের কাজে লাগায়। আর ব্যবসায় জড়িয়ে পড়লে দরিদ্র্য ব্যক্তির পক্ষে মাদকাসক্ত হওয়াটাই স্বাভাবিক।
১০.উচ্চাভিলাষ চরিতার্থে মাদকদ্রব্যের ব্যবসা : দ্রুত সময়ে রাতারাতি ধনী হওয়ার উচ্চ বাসনা যারা পোষণ করে তাদের কেউ কেউ মাদকদ্রব্যের অবৈধ ব্যবসায় জড়িয়ে পড়ে। অন্যদের কাছে মাদকদ্রব্য সহজলোভ্য করছে এবং নিজেরা মাদকাসক্ত হচ্ছে।
১১. বাংলাদেশ করিডোর : মাদকদ্রব্যের সহজলভ্যতার জন্য দেশটির ভৌগলিক অবস্থান অন্যতম। বাংলাদেশকে আন্তর্জাতিক ষড়যন্ত্রের অংশ হিসাবে মাদকদ্রব্য চোরাচালানের করিডোর বানানো হয়েছে। তাই মাদকদ্রব্যের সহজলভ্যতা লক্ষ করা যাচ্ছে।
১২. শিক্ষা ব্যবস্থা ও সেশন জট : লেখাপড়া শেষে চাকরির কোনো নিশ্চয়তা নাই ফলে ডেকে আনছে হতাশা। অন্যদিকে সৃষ্টি করছে সেশন জট। কারো কারো শিক্ষাশেষে চাকরির বয়স আর থাকে না। এসব পরিস্থিতি মাদকাসক্তি বৃদ্ধিতে কাজ করে।
১৩. অপরিনামদর্শিতা : কিশোর বয়সীরা অনেকেই অপরিনামদর্শিতার কারণে মাদকাসক্ত হয়ে পড়ে। এরা মাদকের কুফল সম্পর্কে তেমন অবগত না। দু একবার স্বাদ গ্রহণ করে অজান্তেই একসময় আসক্ত হয়ে পড়ে।
১৪. মূল্যবোধের অবক্ষয় : আমাদের সমাজ নানা কারণে মূল্যবোধ ও চরমভাবে নৈতিকতার অবক্ষয় ঘটেছে। আদর্শ ও মূল্যবোধহীন জীবন অর্থ বিশৃঙ্খল ও বল্গাহীন জীবন। এ ধরনের জীবনে অভ্যস্তরা মাদকদ্রব্য গ্রহণ সহ যে কোন অপরাধমূলক কাজকর্মে একটুকু কুণ্ঠা বোধ করে না।
মাদকাসক্তি সমস্যার প্রতিকার
- পারিবারিক সুন্দর পরিবেশ বজায় রাখা উচিত যাতে পরিবারের কোনো সদস্য পরিবারের আদর্শচ্যুত হয়ে মাদকাসক্তিতে জড়িয়ে পড়তে সুযোগ না পায়।
- সন্তান সন্ততি যেন কোনো রকমের অসৎ সঙ্গে না মেশে বা বদ অভ্যাসগুলো অনুসরণ না করতে শেখে সেদিকে লক্ষ রাখা পরিবারের অন্যতম দায়িত্ব। স্কুল ও কলেজ পর্যায়ে শিক্ষক- অভিভাবকগণও এক্ষেত্রে ভূমিকা রাখতে পারেন।
- মাদকদ্রব্যের অপব্যবহারকারীদের দমনার্থে প্রণীত আইন কার্যকর করা প্রয়োজন। মাদকাসক্তিরোধ, বেকারত্ব ও দারিদ্র্যের অবসানসহ শ্রেণীবৈষম্য কমিয়ে আনা আশু প্রয়োজন।
- মাদকদ্রব্য যাতে আমাদের সমাজে সহজলভ্য হতে না পারে সেজন্য প্রশাসনকে বিশেষভাবে সতর্ক থাকতে এবং কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে। ভৌগলিক অবস্থানগত কারণে বাংলাদেশে মাদকদ্রব্য চোরাচালানের করিডোর এমন অজুহাতে প্রশাসন অবশ্যই চুপ থাকতে পারে না।
- সমস্যাটি যেন আরো ব্যাপক ও জটিল হতে না পারে সে ধরনের উদ্যোগের পাশাপাশি বর্তমান মাদকাসক্তদের নিরাময় ও পুনর্বাসনের কাজ অত্যাবশ্যক। চিকিৎসকসহ সংশ্লিষ্ট অনেকেই আশাবাদ ব্যক্ত করেন যে মাদকাসক্তরা উপযুক্ত চিকিৎসা গ্রহণের ফলে তাদের অধিকাংশই স্বাভাবিক জীবনে ফিরে আসতে পারে।
মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ আইন, ১৯৯০
বর্তমানে বাংলাদেশে যুব সমাজের মধ্যে মাদকের ভয়াবহতা ব্যাপকহারে বৃদ্ধি পেয়েছে। ১৯৯০ সালে জাতীয় সংসদে মাদকাসক্তি রোধে একটি বিল পাস হয়েছে যা এখন মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ আইন নামে পরিচিত। এইসব আইনে দুই থেকে দশ বছরের কারাদণ্ড, মৃত্যুদণ্ড ও যাবজ্জীবন কারাবাসের বিধান রয়েছে। পরোয়ানা ছাড়াই তল্লাসীর ক্ষমতা রয়েছে।
তবে তল্লাসীর নামে কাউকে হয়রানী করা হলে কোনো কর্মকর্তাকে এক বছরের জন্য কারাবাসে দণ্ডিত করা যাবে। এই আইনে এ্যালকোহল ছাড়া সকল মাদকদ্রব্য উৎপাদন, পরিবহন, আমদানি, রপ্তানি, সরবরাহ, ক্রয়-বিক্রয়, সংরক্ষণ নিষিদ্ধ করা হয়েছে। বিশেষ চিকিৎসার জন্য অনুমোদন পেলে মাদকদ্রব্য ওষুধ হিসাবে ব্যাবহার করা যাবে এবং তা লাইসেন্সধারি ব্যবসায়ী ছাড়া কেউ বিক্রি করতে পারবে না।
এই আইনের আওতায় জেল হাসপাতালসহ যে কোনো সরকারি হাসপাতাল ও চিকিৎসা কেন্দ্রকে মাদকাসক্তি নিরাময় কেন্দ্র ঘোষণা করা যাবে। বাংলাদেশ মাদক নিয়ন্ত্রণের জন্য ২০১৮ সালে যুদ্ধ ঘোষণা করে।
মাদকাসক্তির এই আগ্রাসী থাবা নিয়ন্ত্রণের জন্য বাংলাদেশে বেশ কিছু ব্যবস্থা নেয়া হলেও তা যথেষ্ট না। এছাড়া বৈজ্ঞানিক পদ্ধতিতে মাদকাসক্তকে সাহায্য করার বদলে মাদকাসক্তি নিরাময় কেন্দ্রগুলোতে রোগীকে শিকল দিয়ে বেধে নির্যাতনের ঘটনাও সাম্প্রতিক সময়ে দেখা গেছে।
অর্ডিনারি আইটির নীতিমালা মেনে কমেন্ট করুন। প্রতিটি কমেন্ট রিভিউ করা হয়।
comment url