বেকার সমস্যার ধরন ও কারণ এবং সমাধানের উপায়
বর্তমান বিশ্বের উন্নত এবং অনুন্নত সব দেশেই কমবেশি বেকার সমস্যা বিদ্যমান। বাংলাদেশের বেকার সমস্যা একটি অন্যতম মারাত্মক সামাজিক সমস্যা হিসাবে দেখা দিয়েছে। বাংলাদেশে বেকার সমস্যার বিভিন্ন ধরন ও কারণ এবং সমাধানের বিভিন্ন দিক সম্পর্কে আলোচনা করা হল।
বাংলাদেশের শ্রমশক্তি সম্পর্কিত জরিপ অনুসারে বেকার হচ্ছে সেই ব্যক্তি যার বয়স ১৫ বছর বা তার চেয়ে বেশি এবং যে সক্রিয়ভাবে কাজের সন্ধান করা বা কাজের জন্য তৈরি থাকা সত্বে কোন কাজ করছে না। দেশে কর্মজীবি শক্তির চেয়ে শ্রমশক্তির বেশি বৃদ্ধির কারণে বেকার সংখ্যার পরিমান বেড়েই চলেছে।
বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর ২০১৬-১৭ জরিপ মতে, বেকার সংখ্যা প্রায় ৪ কোটি ৮২ লক্ষ ৮০ হাজার। কাজের বাজারে চাহিদার সঙ্গে শিক্ষাব্যবস্থা সংগতিপূর্ণ না হওয়ায় দেশে শিক্ষিত বেকারের সংখ্যা দিন দিন বেড়েই চলেছে। প্রতি বছরই উচ্চশিক্ষা নিয়ে শ্রমবাজারে আসা শিক্ষার্থীদের প্রায় অর্ধেক বেকার থাকছেন অথবা যোগ্যতা অনুযায়ী চাকরি পাচ্ছেন না।
বিশ্ববিখ্যাত ব্রিটিশ সাময়িকী ইকোনমিস্ট- এর ইকোনমিস্ট ইন্টেলিজেন্স ইউনিটের এক বিশেষ প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, বর্তমান বাংলাদেশের ৪৭% স্নাতকই বেকার। দক্ষিণ এশিয়ায় এর চেয়ে বেশি উচ্চশিক্ষিত বেকার আছেন কেবল আফগানিস্থানে, ৬৫%। এর বাইরে ভারতে এর হার ৩৩%, নেপালে ২০%-র বেশি, পাকিস্থানে ২৮% এবং শ্রীলঙ্কায় ৭.৮%।
বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর শ্রমশক্তি জরিপ ২০১০ অনুযায়ী দেশে বর্তমানে শ্রমশক্তির পরিমান পাঁচ কোটি ৬৭ লাখ। এর মধ্যে পাঁচ কোটি ৪১ লাখ মানুষের কাজ আছে। এর অর্থ মাত্র ২৬ লাখ মানুষ বেকার। তবে জরিপেই বলা আছে পরিবারের মধ্যে কাজ করে কিন্তু কেনো মজুরি পান না এমন মানুষের সংখ্যা এক কোটি ১১ লাখ। এছাড়া আছে আরও এক কোটি ছয় লাখ দিনমজুর, যাদের কাজের কোনো নিশ্চয়তা নাই।
বিশ্বব্যাংক মনে করে, সরকার কম দেখালেও প্রকৃতপক্ষে বাংলাদেশে বেকারত্বের হার ১৪.২%। এর ওপর এখন প্রতিবছর নতুন করে ১৩ লাখ মানুষ শ্রমবাজারে যোগ হচ্ছে। আন্তর্জাতিক শ্রম সংগঠনের (আই এলও) তথ্যমতে, বর্তমানে বাংলাদেশে বেকারের সংখ্যা প্রায় তিন কোটি। বেকারত্বের এই ধারা অব্যাহত থাকলে ২০১৫ সালে মোট বেকারের সংখ্যা দাঁড়াবে প্রায় ছয় কোটি। সংস্থাটির মতে বেকারত্ব বাড়ছে এমন ২০ টি দেশের তালিকায় বাংলাদেশের স্থান ১২ তম।
বাংলাদেশের বেকার সমস্যার ধরন ও কারণ
প্রথমত : বাংলাদেশে এক ধরনের বেকারত্ব আছে যাকে মৌসুমি বেকারত্ব বলা হয়। যেমন গ্রামীণ বাংলাদেশে ফসল বোনা ও কাটার পর কিছুদিন কাজ না থাকায় সাময়িক বেকারত্ব দেখা দেয়। শুধু গ্রাম নয়, শিল্প এলাকায়ও মাঝে মাঝে এমনটি দেখা যায়। যেমন চিনিকলে কেবল আখের ঋতুতেই আখ মাড়াই ও চিনি তৈরির কাজ চলে। ফলে অন্যান্য সময়ে চিনিকলের অনেক শ্রমিকই বেকার হয়ে পড়ে।
দ্বিতীয়ত : আমাদের গ্রামীণ সমাজে পরিবারে প্রচ্ছন্ন বেকারত্ব লক্ষ করা যায়। একটি পরিবারে কিছু লোক কাজ করে আর বাকিরা প্রচ্ছন্ন বেকার হিসাবেই অলস সময় কাটায়। অন্য কোথাও কাজ না পেয়ে বেকারই থেকে যাচ্ছে।
তৃতীয়ত : বিভিন্ন সময়ে বন্যায় বা কীট পতঙ্গে ফসলহানি ঘটলে বেশ কিছুদিন কাজ থাকে না। আবার শহরে মিল-কারখানায়ও অনেক সময় কাঁচামালের অভাব বা বাজার মন্দার ফলে আকষ্মিকভাবে কাজ বন্ধ হয়ে যায়। এ অবস্থায় আকষ্মিক বেকারত্ব দেখা দেয়।
চতুর্থত : উৎপাদন যন্ত্রে উন্নতি ঘটলে বা পরিবর্তন দেখা দিলে অনেক সময় সাময়িকভাবে বেকার সমস্যা সৃষ্টি হয়। এটাকে বলা হয় প্রযুক্তিগত বেকারত্ব। যেমন লাঙ্গলের পরিবর্তে ট্রাকটরের ব্যবহারের ফলে অনেক কৃষক বেকার হয়ে পড়ে।
পঞ্চমত : শিক্ষা ও প্রশিক্ষণ ব্যবস্থা যদি দেশের চাহিদা পূরণে ব্যর্থ হয় তবে বেকারত্বের সৃষ্টি হয়। বস্তুত আমাদের দেশের ত্রুটিপূর্ণ শিক্ষা ব্যবস্থাই শিক্ষিত বেকার সমস্যার অন্যতম কারণ।
ষষ্ঠত : ব্যাপক উন্নয়ন পরিকল্পনার অভাবেও আমাদের দেশের কর্মসংস্থান বৃদ্ধি পাচ্ছে না। কৃষি, শিল্প ও ব্যবসা-বাণিজ্যের যথেষ্ট উন্নতির অভাবে বেকার সমস্যা বেড়েই চলেছে।
সপ্তমত : শিক্ষার ক্ষেত্রে সেশন জটের ফলে অনেকের সরকারি চাকরির বয়স অতিক্রম করে যাচ্ছে। ফলে এরা বেকার হয়ে পড়ে।
অষ্টমত : আমাদের মোট জনসংখ্যার মোট অর্ধেকই মহিলা। দেশে মহিলা বেকারের সংখ্যা ক্রমেই বৃদ্ধি পাচ্ছে। বর্তমানে মহিলাদের কর্মসংস্থানের ওপর বেশ গুরুত্ব দেয়া হয়েছে।
নবমত : বেকার সমস্যার অন্যতম প্রধান কারণ হল অত্যাধিক জনসংখ্যার চাপ। জনসংখ্যা যে হারে বৃদ্ধি পাচ্ছে সে হারে উন্নয়নমূলক কর্মসূচির অভাবে বেকারত্ব বৃদ্ধি পাচ্ছে।
বেকার সমস্যা সমাধানের উপায়
এক : গ্রামীণ বেকার সংখ্যা কমানোর জন্য প্রয়োজন কুটির শিল্প স্থাপন। এতে বেকার সমস্যার অনেকটা লাঘব হবে।
দুই : কৃষিতে আধুনিক যান্ত্রিক চাষ পদ্ধতির ব্যাপক প্রচলন করা প্রয়োজন। এতে মৌসুমি বেকার সমস্যা লাঘব হবে।
তিন : ভারী শিল্প-কারখানা এবং বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠান ও অন্যান্য ক্ষেত্রে কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা নিলে শিক্ষিত বেকার সমস্যার সমাধান সহায়ক হবে।
চার : শিক্ষা ব্যবস্থায় পরিবর্তন এনে বৃত্তিমূলক শিক্ষার প্রসার ঘটানো অবশ্য জরুরি। সেশন জট দূরিকরণ করতে না পারলে অনেকেরই চাকরির বয়স পার হয়ে যাবে। তাই এ ব্যাপারে সংশ্লিষ্ট সবাইকে প্রয়োজনীয় উদ্যোগ নিতে হবে।
পাঁচ : আমাদের বেকার জনগোষ্ঠীর একটা অংশকে চাকরি দিয়ে বিদেশে প্রেরণের ব্যবস্থা আরো জোরদার করা প্রয়োজন। এদের উপার্জিত অর্থের একটা অংশ সরকার ইচ্ছা করলে সুদমুক্তভাবে ঋণ দিয়ে দেশে শিল্প কারখানা স্থাপন করতে পারে। এতে বেকারদের কর্মসংস্থান বৃদ্ধি পাবে।
ছয় : কেবল সরকারি ও বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে চাকরিই যথেষ্ট নয়। স্বনিয়োজিত পেশায় কাজ করার ব্যবস্থাও নিতে হবে। প্রয়োজনে ব্যাপকভাবে বৃত্তিমূলক শিক্ষা প্রদান করে প্রয়োজনীয় পুঁজি দিয়ে আত্মকর্মসংস্থান করতে হবে।
সাত : জনসংখ্যা বৃদ্ধির হার কমিয়ে আনা অতীব জরুরি। কেননা এবাবে দ্রুত হারে জনসংখ্যা বেড়ে চললে কর্মসংস্থান ব্যবস্থা বেকারত্ব ঘুচাতে পুরোপুরি সফল হবে না এবং উন্নয়নের কোনো সুফলই পাওয়া যাবে না।
আরও কিছু কার্যকর উপায়
১. নিজেকে নিয়ে ভাবুন। আপনি কি কাজ করতে ভালবাসেন সেই কাজ করে কি চাকরি পাওয়া যাবে বা টাকা আয় করা যাবে? এইসব তথ্যগুলো জানুন আর বেকারত্ব এর কারণ খুঁজুন। প্রতিটি কাজেরই চাহিদা আছে। কোন কাজকেই অবজ্ঞা করা যাবে না। জীবনের যে কোন জটিল পরিস্থিতিকে চ্যালেঞ্জ হিসাবে নিতে হবে।
২. যে কাজটা ভাল লাগে, সেই কাজে দক্ষতা অর্জন করতে হবে। সেই কাজে আপনি যেন সেরা হন, সেই দিকে বিশেষ নজর দিতে হবে। এই ধরনের কাজ করে যারা জীবিকা নির্বাহ করে তাদের জীবন কাহিনী জানতে হবে। তাদের মতো করে দক্ষ হওয়ার চেষ্টা করতে হবে।
৩. যুগের সাথে নিজেকে আপডেট করে রাখুন। বর্তমান যুগ কম্পিউটারের যুগ। তাই শীঘ্রই কম্পিউটার শিখে ফেলুন। কম্পিউটার না থাকলে স্মার্ট ফোনটাকে কাজে লাগান।
৪. আজই আপনি আপনার মোবাইল থেকে গুগল এ সার্চ করে দেখুন আপনার পছন্দের কাজ দিয়ে কি করে অনলাইনে কাজ করা যায়। যেমন- ট্রাভেল ব্লগ বা যে বিষয়ে জ্ঞান আছে সে বিষয়ে ব্লগ লেখা যায় কিংবা বিভিন্ন বিষয়ে ইউটিউবে ভিডিও আপলোড করুন। অনলাইনে খাবার বা প্রয়োজনীয় দ্রব্য সরবরাহ করা যায়।
৫. বসে বসে সময় নষ্ট না করে অনলাইন কাজে লেগে যান। অনলাইন কাজে তো কোন খরচ নাই। দিনের কিছুটা সময় অনলাইন কাজের জন্য দিন। বাকি সময় আরো অন্য কাজ করার চেষ্টা করুন।
৬. কোন কাজকে ছোট করে দেখা ঠিক না। বেকারত্ব যে কোন কাজের চেয়ে আরও ছোট। সব কাজই মহান। যে কাজ বেকারত্বের মতো কঠিন রোগ থেকে মুক্তি দিতে পারে, সেই কাজ কখনো ছোট হতে পারে না। অনলাইনে টাইপের কাজ, আমাজনে এফিলিয়েট লিঙ্কিং, মোবাইল রিচারজ ইত্যাদি কাজও করা যায়।
৭. আত্মবিশ্বাস বাড়াতে হবে। বেকারত্ব দুর করতে নতুন নতুন ভাবনাগুলো টাকা রোজগারের নানান পথ দেখাতে পারে। ভাবনাগুলো বেকারত্ব দুর না হওয়া পর্যন্ত ধারালো থাকতে হবে।
৮. বেকারত্ব একটি রোগ। বেকার মানুষদের মধ্যে বেশিরভাগ মানুষেরই ইচ্ছাশক্তির অভাব। এক পা এগোবার আগেই দুই পা পিছিয়ে যায়। কাজের জন্য নিজ বাসস্থান ছাড়ার প্রয়োজন হলে বাসস্থান ছাড়ার জন্য প্রস্তুত থাকতে হবে।
পরিশেষে বলা যায় যে, বাংলাদেশে বেকার সমস্যা ভয়াবহরূপ ধারণ করেছে। বাংলাদেশের বিরাজমান এসব বেকার সমস্যার সমাধান সময় সাপেক্ষ বিষয়। দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনার এবং ভবিষ্যৎ বেকারত্ব প্রতিরোধের জন্য প্রয়োজন মানব উন্নয়নের মাধ্যমে দারিদ্র্য নিরসন ও কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টি। অর্থনৈতিক তৎপরতা বৃদ্ধির পাশাপাশি দারিদ্র্য বিমোচনের জন্য প্রত্যক্ষভাবে লক্ষ্যমুখী কর্মসূচি গ্রহণ করতে হবে।
অর্ডিনারি আইটির নীতিমালা মেনে কমেন্ট করুন। প্রতিটি কমেন্ট রিভিউ করা হয়।
comment url