দারিদ্র্যের কারণ ও প্রতিকারের কয়েকটি উপায়
দারিদ্র্য হল একটি বিশেষ আর্থ-সামাজিক অবস্থার নাম। মৌলিক ব্যক্তিগত চাহিদা খাদ্য, বস্ত্র ও আশ্রয় ইত্যাদি মেটানোর জন্য প্রয়োজনীয় অর্থনৈতিক বা অন্য কোনও উপায়ের অনুপস্থিতিকে দারিদ্র্য বোঝায়। দারিদ্র্যের কারণ ও প্রতিকারের কয়েকটি উপায় আলোচনা করা হল।
দারিদ্র্য ব্যাপারটি আপেক্ষিক। কেননা কেউ অন্য কারো তুলনায় দরিদ্র্য বা ধনী হতে পারে। দেশ ও সমাজভেদে দারিদ্র্যের ধারণা ভিন্নতর। উন্নত সমাজের একজন দরিদ্র্য ব্যক্তির জীবনযাত্রা, দারিদ্র্য কবলিত যে কোন সমাজের দরিদ্র্য ব্যক্তির জীবনধারা থেকে কিছুটা উন্নত বলা যায়। বাংলাদেশের পেক্ষাপটে দরিদ্র্য হল সেই ব্যক্তি যে তার আর্থিক সামর্থের অভাবে প্রয়োজনীয় খাদ্য, বস্ত্র, বাসস্থান ও চিকিৎসার অন্তত নিম্নতম মানও যারা বজায় রাখতে পারে না তাদেরকে দরিদ্র্য বলা চলে।
দারিদ্র্য কীভাবে অন্যান্য সমস্যার জন্য দায়ী
- দারিদ্র্য নানা ধরনের অসামাজিক কার্যকলাপ এবং অপরাধের অন্যতম কারণ।
- দারিদ্র্য পুষ্টিহীনতাসহ অনেক রোগ ব্যাধির জন্য দায়ী।
- দারিদ্র্য অদক্ষতার জন্যও কম দায়ী নয়।
- আমাদের সমাজে দারিদ্র্য কবলিত পরিবারে বিবাহবিচ্ছেদ বৃদ্ধি পেয়েছে। অর্থাৎ দারিদ্র্য পারিবারিক ভাঙ্গনের জন্যও দায়ী।
- দারিদ্র্য মানুষকে এমন মানবেতর জীবন যাপনে বাধ্য করে যে সে হীনমন্যতা ও হতাশায় ভূগে। দারিদ্র্য মানুষকে মানুষের কাছে কৃপা-প্রার্থী হতে বাধ্য করে- বাধ্য করে ভিক্ষা ও অন্যান্য সাহায্য গ্রহণে।
- দারিদ্র্য মানুষকে তার অন্ন-বস্ত্রের জন্য এতই ব্যস্ত রাখে যে তার পক্ষে জীবনের অন্যান্য প্রয়োজন মেটানো বা মানুষ হিসাবে তার সুকুমার প্রবৃত্তির বিকাশ ঘটানো সম্ভব হয় না।
বস্তুুত দারিদ্র্য কবলিত সমাজ একটি গোলকধাঁধাঁয় আবর্তিত হতে থাকে। দারিদ্র্যের এই ধাঁধাঁ চক্র হতে সমাজ সহজে মুক্তি পায় না। কেননা দারিদ্র্য প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে অনেক সমস্যার জন্যই যেমন দায়ী-আবার দারিদ্র্য অনেক কারণের ফলও বটে। অর্থাৎ দারিদ্র্য একাধারে সামাজিক অনেক সমস্যার যেমন কারণ অন্যদিকে দারিদ্র্য বিভিন্ন সামাজিক সমস্যার ফলও বটে।
১৮ কোটি জনসংখ্যা নিয়ে বাংলাদেশ হচ্ছে বিশ্বের সবচেয়ে ঘনবসতিপূর্ণ দেশগুলোর মধ্যে একটি। বিশ্ব ব্যাংকের মতে, বাংলাদেশের চরম দারিদ্র্যের হার ২০১৬ সালে ১২.৯ শতাংশে নেমে এসেছে। যেখানে ১৯৯১ সালে ৪৪.২ শতাংশ থেকে দারিদ্র্যের এই হার ২০১০ সালে ১৮.৫ শতাংশে নেমে এসেছে। বাংলাদেশের জনসংখ্যার ৮০ ভাগ গ্রামীণ এলাকায় বসবাস করে।
গ্রামীণ জনসংখ্যার প্রায় ৩৫ শতাংশ মানুষ দারিদ্র্য সীমার নিচে বসবাস করে। স্বাস্থ্য সমস্যা বা প্রাকৃতিক বিপর্যয়ের ফলে তারা আরও গভীর দারিদ্র্যের মধ্যে প্রবেশ করার ঝুঁকিতে থাকে। গ্রামীণ দারিদ্র্যের মধ্যে মহিলারা সবচেয়ে বৈষম্যের স্বীকার হয়।
বাংলাদেশে দারিদ্র্যের কারণ
ঐতিহাসিক কারণ : এ দেশ বিভিন্ন সময়ে বিদেশী দ্বারা শাসিত ও শোষিত হয়ে আসছে। বহিরাগতরা এখানে এসে কেবল নিজেদের ভাগ্য গড়েছে। এখানকার সাধারণ মানুষের অভাব মোচনে বা উন্নয়নমূলক কাজে তারা তেমন কিছু করেনি।
অনুন্নত কৃষি : বৈজ্ঞানিক পদ্ধতিতে যান্ত্রিক চাষাবাদ অত্যন্ত সীমিত। আমাদের কৃষিতে এমন সব সমস্যা আছে যা উন্নতির পরিপন্থী। ভূমিহীনদের সংখ্যা বৃদ্ধি, জমির খন্ড-বিখন্ডতা, জনসংখ্যা বৃদ্ধি, ঘরবাড়ি নির্মাণ, রাস্তাঘাট ও হাটবাজারের জন্য জমির ব্যবহার ইত্যাদির ফলে আবাদী জমির পরিমান কমে আসার ফলে প্রয়োজনীয় খাদ্য উৎপাদন বৃদ্ধি পাচ্ছে না।
প্রাকৃতিক দুর্যোগ : আমাদের কৃষি মূলত প্রকৃতির ওপর নির্ভরশীল। খরা, বন্যা, ঘূর্ণিঝড়, জলোচ্ছাস, কীট-পতঙ্গের উপদ্রব আমাদের ফসলহানির জন্য দায়ী। কৃষক তার ফসল পরিমান মত পায় না। বারংবার প্রাকৃতিক দুর্যোগের আঘাতে কৃষককূল সর্বশান্ত হয়ে পড়ে। দরিদ্র্য দশা আর দুর হয় না।
শিল্পায়নের অভাব : দেশে আশানুরূপভাবে কুটির শিল্পসহ ভারী শিল্প প্রতিষ্ঠান গড়ে উঠেনি। দারিদ্র্য মোচনে যে ধরনের শিল্পায়ন প্রয়োজন ছিল তা হয়নি। ফলে দারিদ্র্য থেকে দেশ মুক্তি পাচ্ছে না।
ক্রমবর্ধমান জনসংখ্যা : উন্নয়নের যতটুকু ফল অর্জিত হচ্ছে ক্রমবর্ধমান জনসংখ্যা তা নিমিষেই নিঃশেষ করে ফেলছে। ফলে সীমিত উন্নতির সুফল পাওয়া যাচ্ছে না। জনসংখ্যা বৃদ্ধির ফলে অভাব অনটন বৃদ্ধি পাচ্ছে।
কর্মসংস্থানের অভাব : কর্মসংস্থানের অভাবও দারিদ্র্যের অন্যতম কারণ। বেকার জনগোষ্ঠী সীমিত সম্পদের ওপরই নির্ভর করে মানবেতর জীবন যাপনে বাধ্য হচ্ছে। দেশে আজ কৃষিতে শ্রম থাকছে উদ্বৃত্ত। শিক্ষিত বেকারও আশঙ্কাজনকহারে বৃদ্ধি পাচ্ছে।
ব্যয়বহুল সামাজিক অনুষ্ঠান : ঐতিহ্যগতভাবে এ দেশের মানুষ বিভিন্ন সামাজিক অনুষ্ঠানে অনেক পরিমানে খরচ করে থাকে। ধার করে বা জমি বিক্রি করে হলেও ঘটা করে কিছু কিছু অনুষ্ঠান করে থাকে। গ্রামীন সমাজের অনেকের দারিদ্রের এটাই কারণ। নগর জীবনে নিম্ন মধ্যবিত্ত ও মধ্যবিত্তের একটি অংশও সামাজিকতা রক্ষার নামে সামাজিক অনুষ্ঠানে বেশ খরচ করে থাকে। এসব বাড়তি খরচে আর্থিক টান-পোড়ন বৃদ্ধিই করে।
অলসতা : দরিদ্র্য দশায় জীবন যাপনের একটি কারণ হচ্ছে তাদের পূর্ব-পুরুষদের অলস জীবন। মান সম্মানের ভয়ে কিছু কাজ থেকে বিরত থেকে জমি বিক্রি করে অলস জীবন যাপন করা। একটি পরিবারের ২/১ জন কাজ করছে- বাকিরা অলসভাবে সময় কাটাতে পছন্দ করে। এ ধরনের অলসতা দারিদ্র্য আনয়নের জন্য কম দায়ী নয়।
সম্পদের সীমাবদ্ধতা ও ত্রুটিপূর্ণ বন্টন ব্যবস্থা : জনসংখ্যা অনুপাতে আমাদের প্রাকৃতিক সম্পদ ও জাতীয় সম্পদ-সুযোগ খুবই সীমিত। যতটুকু আছে সেটার বন্টন ব্যবস্থাও ত্রুটিপূর্ণ। ফলে কেউ বেশি পাচ্ছে কেউ কম পাচ্ছে।
রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতা : রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতার অভাব হেতু এবং রাজনৈতিক অস্থিরতা হেতু উন্নয়নমূলক কাজকর্ম ব্যাহত হয়। উৎপাদন না বাড়ার ফলে সামগ্রিকভাবে দেশে দারিদ্র্যের লক্ষণ প্রকাশ পায় যার প্রভাব গিয়ে পড়ে সাধারণ জনমানুষের ওপর।
আচার-বিশ্বাস, রক্ষনশীলতা এবং বৈজ্ঞানিক চিন্তার অভাব : আমাদের সমাজে ঐতিহ্যগতভাবে মেয়েদের শিক্ষা গ্রহণ ও চাকরি করা ছিল নিষেধ। বর্তমানে অবশ্য এ ক্ষেত্রে পরিবর্তন এসেছে এবং বেকারত্ব ও দারিদ্র্য মানুষকে ইতিবাচক করে তুলেছে। হিন্দু সমাজে জাতিবর্ণ প্রথা স্বাধীনভাবে পেশা গ্রহণে বরাবরই অন্তরায় হয়ে দাঁড়িয়েছে। দারিদ্র্য ঘুচবার পথে এসব সামাজিক প্রথা অন্তরায় হিসাবে কাজ করে।
প্রযুক্তি জ্ঞানের অভাব : আমাদের দারিদ্রের অন্যতম কারণ হল প্রযুক্তিজ্ঞানের অভাব। আধুনিক বিশ্বের চাহিদানুযায়ী শিক্ষা ও প্রযুক্তি জ্ঞানের অভাবের কারণে আমাদের সমাজের মানুষ কাজ পাচ্ছে না। দারিদ্র্যের জন্য এ অবস্থাটি কম দায়ী নয়।
সমাজ কাঠামোগত কারণ : আধা-সামন্ততান্ত্রিক, আধা-পুঁজিবাদী, আধা-সমাজতান্ত্রিক নীতি ও আদর্শই হয়ত আমাদের দারিদ্র্যের কারণ।
বিশেষ ধরনের আচার-ব্যবহার : ক্লারেন্স মেলোনী দীর্ঘদিন যাবৎ বাংলাদেশে উন্নয়নমূলক কর্মসূচি তথা উন্নয়ন সম্পর্কিত গবেষণা কাজের সঙ্গে জড়িত ছিলেন। তিনি বলতে চেয়েছেন যে, এ দেশের মানুষের আচার-ব্যবহার দারিদ্র্যের অন্যতম কারণ। আমাদের স্বভাব, খাসলত, ধ্যান-ধারণা, রেওয়াজ-প্রথা ও মন-মানষিকতাকেই তিনি দারিদ্র্যের জন্য দায়ী করেছেন।
দারিদ্র্য প্রতিকারের কয়েকটি উপায়
দারিদ্র্য একটি আপেক্ষিক ব্যাপার। অতএব কোনো দেশের দারিদ্র্য পুরোপুরি দুর করা সম্ভব নাও হতে পারে। তবে দারিদ্র্য বিমোচনে বাস্তবমুখী কর্মসূচি নেওয়া গেলে কিছুটা সফলতা অর্জন করা হয়ত সম্ভব। নিম্নে দারিদ্র্য বিমোচনে কতিপয় সুপারিশ পেশ করা হচ্ছে।
এক. দারিদ্র্যের একটি মোটামুটি গ্রহণযোগ্য সংজ্ঞা নির্ধারণ করত সামাজিক জরিপ পরিচালনা করে বাংলাদেশে দরিদ্র্য জনসংখ্যার পরিমাণ নির্ণয় করাই হল আমাদের প্রাথমিক কর্তব্য। জানতে হবে কেন এই জনগোষ্ঠী দারিদ্র্যের অভিশাপে অভিশপ্ত। দরিদ্র্য জনগোষ্ঠীর জন্য সরকারি ও বেসরকারি উদ্যোগে উপযুক্ত কর্ম সংস্থানের ব্যবস্থা করতে পারলে দারিদ্র্য লাঘবে প্রথম পর্যায়ে বেশ সফলতা অর্জিত হতে পারে।
দুই . আমাদের দেশের বর্তমান জনসংখ্যা মূলত সম্পদ না হয়ে আপদ হয়ে দাঁড়িয়েছে। অতএব দারিদ্র্য দুর করতে জনসংখ্যা নিয়ন্ত্রণ করা অতীব জরুরি। জনসংখ্যা বৃদ্ধি প্রায় শূন্যের কোঠায় নামিয়ে না আনা পর্যন্ত দারিদ্র্য বিমোচন যেমন সম্ভব নয়- উন্নতি অর্জনও থাকবে সুদূর পরাহত।
তিন. কৃষি ও শিল্পের উন্নতি ঘটিয়ে এবং সরকারি ও বেসরকারী পর্যায়ে বিভিন্ন কর্মক্ষেত্র সৃষ্টি করে দেশের বেকার সমস্যার সমাধান আশু প্রয়োজন। বেকার জনগোষ্ঠী যদি কাজ পায় এবং কাজ করে যদি নিম্নতম প্রয়োজন মেটানোর বেতন পায় তাহলে দারিদ্র্য মোচনে সেটা বিশেষ সহায়ক ভূমিকা পালন করবে।
চার : প্রচলিত শিক্ষা ব্যবস্থায় আমূল পরিবর্তন এনে দেশের ও বহির্বিশ্বের চাহিদা অনুযায়ী ব্যবহারিক তথা প্রযুক্তিগত শিক্ষাদানের ওপর গুরুত্ব দিতে হবে। তা না হলে বাংলাদেশের সমাজ তত্ত্বীয় শিক্ষায় শিক্ষিত বেকার জনগোষ্ঠীতে পরিপূর্ণ হয়ে যাবে।
পাঁচ : প্রাকৃতিক দুর্যোগে যেহেতু প্রায়ই ফসলহানী হচ্ছে সেজন্য শুকনা মৌসুমে কীভাবে আরো বেশী ফসল উৎপাদন করা যায় সে বিষয়ে নতুন চিন্তা-ভাবনা ও গবেষণা করতে হবে। কৃষির পাশাপাশি বা প্রয়োজনে বিকল্প হিসাবে ব্যাপক শিল্প কারখানা গড়ে তুলতে হবে। যে সব প্রাকৃতিক ও পরিবেশগত কারণে বন্যা হচ্ছে সেটা দুর করার চেষ্টা চালিয়ে যেতে হবে।
ছয় : আমাদের সমাজে দারিদ্র্য মোচন তথা উন্নয়ন তরান্বিত করতে হলে রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা বজায় রাখা প্রয়োজন। তা না হলে কোনো কর্মসূচি গ্রহণ করা গেলেও বাস্তবায়নের সম্ভাবনা কমে যাবে। এজন্য গণতন্ত্রের প্রতি সকলকে শ্রদ্ধাশীল থাকতে হবে কথায়, কাজে ও বিশ্বাসে। উন্নয়নের কাজে সকলের অংশগ্রহণ সুনিশ্চিত করতে হবে।
সাত : দেশের জনসংখ্যাকে একটি সীমিত সংখ্যায় নামিয়ে এনে তাদের মৌল চাহিদার সঙ্গে সংগতি রেখে উন্নয়নমূলক কাজ কর্মের নিশ্চয়তা প্রদান করতে হবে।
আট : আমাদের আচরণের যে দিকগুলো দারিদ্র্যের জন্য দায়ী এবং উন্নতির প্রতিকূল কাজ করে সেগুলো সম্পর্কে গবেষণা করা এবং জনগণকে অবহিত করা। এত জনসাধারণের মধ্যে ব্যবহার- আচরণের ক্ষেত্রে ইতিবাচক পরিবর্তন হবে বলে আশা করা যায়।
বাংলাদেশের বহুবিধ সমস্যার মধ্যে দারিদ্র্যতা অন্যতম। দারিদ্র্যের কারণ ও প্রতিকারের কয়েকটি উপায় এখানে তুলে ধরা হয়েছে। দারিদ্র্যতাকে সমাজের অনেক মানুষই অনাকাঙ্খিত মনে করে। যে অবস্থা অনেকের ওপর অবাঞ্ছিত প্রভাব রাখে এবং সমাধানের লক্ষ্যে অনেকেই যৌথ প্রয়াস চালানোর প্রয়োজন অনুভব করে।
অর্ডিনারি আইটির নীতিমালা মেনে কমেন্ট করুন। প্রতিটি কমেন্ট রিভিউ করা হয়।
comment url