সিন্ধু সভ্যতার সমাজ, সংস্কৃতি, কীর্তি ও অবদান

সিন্ধু সভ্যতা এ উপমহাদেশের সবচেয়ে প্রাচীন সভ্যতা। সিন্ধু সভ্যতা ছিল একটি ব্রোঞ্জ যুগীয় সভ্যতা। সিন্ধু সভ্যতার ইতিহাস, সমাজ, সংস্কৃতি, কীর্তি ও অবদান এবং এই সভ্যতার প্রসার, প্রভাব ও পতন সম্পর্কে আজকের আলোচনা।

সিন্ধু সভ্যতার সমাজ, সংস্কৃতি, কীর্তি ও অবদান

এই সভ্যতার কেন্দ্র ছিল মূলত ভারতীয় উপমহাদেশের পশ্চিমাঞ্চলে অবস্থিত সিন্ধু নদ অববাহিকা। এই সভ্যতা প্রথম দিকে পাঞ্জাব অঞ্চলের সিন্ধু অববাহিকায় বিকাশ লাভ করে। বর্তমান পাকিস্থান রাষ্ট্রের প্রায় সম্পূর্ন অংশ, ভারতীয় প্রজাতন্ত্রের পশ্চিম দিকের রাজ্যগুলি, দক্ষিণ-পূর্ব আফগানিস্থান এবং বালোচিস্থান প্রদেশের পূর্ব অংশ এই সভ্যতার অন্তর্গত।

পূর্ণবর্ধিত সময়কালে এই সভ্যতা হরপ্পা সভ্যতা নামে পরিচিত। হরপ্পা ছিল এই সভ্যতার প্রথম আবিস্কৃত নগরগুলির অন্যতম। ১৯২০ সাল থেকে সিন্ধু সভ্যতার প্রত্নস্থলগুলিতে খননকার্য চলছে। মহেনজোদাড়ো সিন্ধু সভ্যতার একটি অতি গুরুত্বপূর্ণ কেন্দ্র। সিন্ধু সভ্যতা মোটামুটিভাবে প্রাচীন বিশ্বের অন্যান্য নদীমাতৃক সভ্যতার সমসাময়িক ছিল যেমন-প্রাচীন মিশরীয়, মেসোপটেমিয়ান ও চৈনিক সভ্যতা। সিন্ধু সভ্যতার স্থায়ীত্বকাল খৃস্টপূর্ব চার হাজার থেকে আড়াই হাজার অব্দ। ইউনেস্কো বিশ্ব ঐতিহ্যবাহী স্থান হিসাবে বর্তমান সময়ে সিন্ধু সভ্যতা অন্তর্গত।

কোন মানব গোষ্ঠী এই সভ্যতা সৃস্টি করেছিল তা নিয়েও ঐতিহাসিকদের মধ্যে মতভেদ আছে। এই সভ্যতার স্রস্টা কি দ্রাবিড়, না অন্য কোনো মানব গোষ্ঠী? জন মার্শালসহ অনেক পন্ডিতের মতে দ্রাবিড় বলে কথিত জনগোষ্ঠীই সিন্ধু সভ্যতার স্রস্টা। এর অর্থ আর্য আগমনের অনেক পূর্বে এ সভ্যতার উন্মেষ, বিকাশ, বৃদ্ধি ও লয় ঘটে। খৃস্টপূর্ব ২৫০০ অব্দে এই সভ্যতা প্রাকৃতিক দুর্যোগে ধ্বংস প্রাপ্ত হয় বলে অনুমান করা হয়।

সভ্যতার নাম নিয়ে বিতর্ক 


হরপ্পা সভ্যতার প্রথম দিকে আবিস্কৃত মহেনজোদাড়ো ও হরপ্পা নগরটি সিন্ধু উপত্যকা অঞ্চলে গড়ে উঠেছিল। যার উপর ভিত্তি করে ঐতিহাসিকরা সিন্ধু নদীর নাম অনুযায়ী এই সংস্কৃতিকে সিন্ধু সভ্যতা নামকরণ করা হয়েছিল। কিন্তু পরে সিন্ধু উপত্যকার বাইরে নানাস্থান থেকেও এই সভ্যতার নিদর্শন আবিস্কৃত হতে থাকে। এই সভ্যতার ব্যাপক প্রসারের ফলে এখন আর একে সিন্ধু সভ্যতা বলা চলে না। ঐতিহাসিকরা প্রথম আবিস্কৃত প্রত্নক্ষেত্র হরপ্পার নাম অনুসারে এই সভ্যতাকে হরপ্পা সভ্যতা নামকরণ করেছেন।

সিন্ধু নগর সভ্যতার ধ্বংসাবশেষ 


পাকিস্থানের লারকানা জেলায় অবস্থিত মহেনজোদাড়ো এবং মন্টোগামারী জেলায় হরপ্পা নগরাঞ্চল হল সিন্ধু সভ্যতার লীলাভূমি। নদী বিধৌত উর্বরা পলিতে কৃষি অর্থনীতি ছিল এ সভ্যতার জীবনী শক্তি। উদ্বৃত্ত উৎপাদনের ফলে সমাজে অবসর জীবন যাপনকারী শ্রেণী দেখা দেয়। সংস্কৃতি, শিল্প চর্চা, তথা উন্নত নগর জীবন বোধের উন্মেষ ঘটে।

ফলে গড়ে উঠে একটি পরিকল্পিত উন্নত নগর জীবন। সিন্ধু সভ্যতার নগর গুলো সঠিক পরিকল্পনা নির্ভর এবং তাতে দূরদর্শিতার পরিচয় পাওয়া যায়। নগরের রাস্তাগুলো বেশ প্রশস্ত এবং প্রশস্ত রাস্তা ছাড়াও ছিল ছোট ছোট গলি-রাস্তা। নগরের ভবনগুলো পোড়ানো শক্ত ইটের তৈরি। একটি স্বাস্থ্যকর নাগরিক পরিবেশ সৃস্টি করতে প্রয়োজনীয় সংখ্যক গোসলখানা, পয়প্রণালি তথা নর্দমার সুযোগ সুবিধা ছিল। রাস্তায় ল্যাস্প পোস্টের ব্যবস্থা ছিল। একটি উন্নত মানের প্রশাসন, রুচিবোধ, সংস্কৃতি তথা নগর সমাজ জীবনের ইঙ্গিত বহন করে।

বড় বড় প্রাসাদ, মাঝারী ও ছোট আকারের আবাসিক ভবনগুলোর ধ্বংসাবশেষ থেকে সিন্ধু সভ্যতার সামাজিক স্তরের একটি সুস্পষ্ট পরিচয় পাওয়া যায়। প্রত্যেকটি বাড়িতে প্রশস্ত বারান্দা, দরজা, জানালা, কূপ, নর্দমা ও গোসলখানার অপূর্ব সমাবেশ ঘটেছিল। নগরের আকর্ষণীয় বস্তু হচ্ছে ১৮০ বর্গফুট আয়তনের সুবৃহৎ স্নানাগার।

এর অভ্যন্তরে সুপরিকল্পিতভাবে নির্মিত সুইমিং পুলটির চারিদিকে প্রশস্ত বারান্দা ও গ্যারারি এর সৌন্দর্য বৃদ্ধি করেছিল। গ্রেট বাথের নিকটেই ছিল ১৫০×৭০ ফুট আয়তনের এক বিশাল শস্যাগার। বহু স্তম্ভ বিশিষ্ট ৮০ বর্গফুট আয়তনের একটি ভবনের ধ্বংসাবশেষকে প্রত্নতাত্ত্বিকেরা সভাকক্ষ নামে চিহ্নিত করেছেন। হরপ্পার সর্ববৃহৎ ভবনকে (১৬৯×১৩৫ ফুট) বিখ্যাত শস্যাগার বলে আখ্যা দেওয়া হয়েছে। পরিমাপ ও ওজনের নির্দিষ্ট মানদণ্ড এবং খাজনা আদায় প্রথা চালু ছিল। আর তার প্রমাণ যে সিন্ধু সভ্যতার শক্তিশালী কেন্দ্রীয় সরকার প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল।

সিন্ধু সভ্যতার সমাজ, সংস্কৃতি, কীর্তি ও অবদান 


অর্থনৈতিক জীবন : সিন্ধু সভ্যতা শক্তিশালী আর্থিক বুনিয়াদের ওপর প্রতিষ্ঠিত ছিল। খাজনা প্রদানের শর্তে এবং সমাজের সম্মতি সাপেক্ষে এক ধরনের ব্যক্তি মালিকানা লক্ষ করা যায়। কৃষি এবং ব্যবসা ছিল এ সভ্যতার ভিত। কৃষি নির্ভর সিন্ধু সভ্যতার জনগোষ্ঠী গম, বার্লি, ধান, খেজুর ইত্যাদি উৎপাদন করত।

তাছাড়া সবজি, দুধ, মাছ, গরু, মহিষ, হাঁস, মুরগী, ছাগল ও শুকুরের মাংস আহার হিসাবে ব্যবহার করত। ব্যবসা-বাণিজ্যেও সিন্ধু সভ্যতা ছিল বেশ উন্নত। এ সময় তাঁত শিল্পের বিকাশ ঘটায়। লেন-দেনের ক্ষেত্রে তখনও মুদ্রার ব্যবহার শুরু হয়নি। সেখানে তখন বিনিময় ব্যবস্থা ছিল বলে ঐতিহাসিকরা অনুমান করেন।

সামাজিক শ্রেণী : সিন্ধু সভ্যতায় নগরের বিকাশ ঘটেছিল। নগর পরিকল্পনার আবাসিক এলাকাগুলোর ধ্বংসাবশেষ থেকে অনুমান করা যায় যে, সিন্ধু সমাজে ধনী, মধ্যবিত্ত এবং দরিদ্র শ্রেণীর অস্তিত্ব ছিল। কেননা সেখানে ছোট-বড় ও ভিন্ন ভিন্ন মডেলের আবাসিক ভবন ছিল। ঐতিহাসিকদের মতে পুরোহিত, চিকিৎসক, জোতির্বিদ ইত্যাদি মিলে সেখানে একটি শিক্ষিত বুদ্ধিজীবি গোষ্ঠীর অস্তিত্ব ছিল।

বিভিন্ন পেশাদার কারিগর শ্রেণী যেমন-রাজমিস্ত্রি, কামার, কুমার, সুতার, স্বর্ণকার ইত্যাদি ছিল। সমাজে অন্যতম শ্রেণীগুলো হল, যোদ্ধা, বণিক-ব্যবসায়ী এবং কৃষক। গৃহদাসদেরকে সমাজের নিচু তলায় আরেকটি শ্রেণী হিসাবে চিহ্নিত করা হয়েছে। অতএব সিন্ধু সমাজে বুদ্ধিজীবি, পেশাদার, কারিগর, যোদ্ধা, বণিক-ব্যবসায়ী, কৃষক, গৃহদাস প্রভৃতি সামাজিক শ্রেণীর অস্তিত্ব ছিল।

ধর্মীয় জীবন : সিন্ধু সমাজে ধর্মীয় জীবন সম্পর্কে নিশ্চিত হওয়া যায় না। তবে ঐতিহাসিকরা প্রাপ্ত তথ্যের আলোকে এ সম্পর্কে কিছু আন্দাজ করেছেন। বাঘ, মহিষ, হরিণ ও গন্ডার পরিবেষ্টিত হয়ে উলঙ্গ ত্রি-মুখী, শিংধারী ধ্যানরত যে মূর্তির পরিচয় পাওয়া গেছে তাকে শিব দেবতা বলে চিহ্নিত করা হয়েছে। তাছাড়া দূর্গার মূর্তিরও সন্ধান মিলেছে। গাছ, পাথর, নদী, পশু ও লিঙ্গ পূজাও তারা করত অর্থাৎ প্রকৃতি পূজা করার নজীর পাওয়া গেছে।

রাজনৈতিক অবস্থা : প্রত্নতাত্ত্বিক খনন কাজ থেকে উদ্ধারকৃত সব তথ্যের পাঠ উদ্ধার না হওয়ায় সিন্ধু সমাজের রাজনৈতিক অবস্থা সঠিকভাবে বলা চলে না। তবে হরপ্পা ও মহেনজোদাড়োর বিভিন্ন ঘরবাড়ি ও অট্টালিকা নির্মাণ কৌশলের মধ্যে মিল খুঁজে পাওয়া যায় তাই হয়তো উভয় এলাকাই এক শক্তিশালী কেন্দ্রীয় প্রশাসনের অধীনে ছিল। অনেক ঐতিহাসিকের মতে সিন্ধু সভ্যতার প্রশাসনের শীর্ষে ছিলেন পুরোহিত রাজা যিনি ছিলেন একাধারে ধর্মীয় এবং রাজনৈতিক নেতা। খাজনা আদায় ছিল প্রশাসনের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ কাজ।

শিল্পকলা : সিন্ধু সভ্যতার শিল্প ও চিত্র অঙ্কন প্রণালিতে পশুর ছবি এক বিশেষ স্থান দখল করে আছে। সেখানে ষাঁড়, হাতি, বাঘ, গন্ডার, গরিয়াল, কুমির, হরিণ ইত্যাদির ছবি সম্বলিত অনেক সীলমোহর আবিস্কৃত হয়েছে। সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য বিষয় হল সিন্ধু সভ্যতার সুরম্য ও কারুকার্য খচিত অট্টালিকা। সুন্দর ডিজাইনের মৃতপাত্র, হাতির দাঁতের দ্রব্য-সামগ্রী, স্বর্ণ, রৌপ্য, তামা ও ঝিনুকের অলংকার তৈরি এ কথাই প্রমাণ করে যে সিন্ধু সভ্যতার মানুষ শিল্পকলায় ও কারুশিল্পে বেশ উন্নতি সাধন করেছিল।

দৈনন্দিন ব্যবহার্য দ্রব্য সামগ্রী : দৈনন্দিন জীবনে তারা যেসব দ্রব্য ব্যবহার করত তার মধ্যে সুচ, কাচি, চাকু, আয়না, চিরুনি ইত্যাদির নাম উল্লেখযোগ্য। সিন্ধু সমাজের মানুষ যুদ্ধবিদ্যায় বেশ পারদর্শী ছিল। যুদ্ধে তারা কুঠার, ছুরি, তীর-ধনুক, ফিঙ্গা, তরবারী, ঢাল, বর্শা ইত্যাদি ব্যবহার করত। এগুলি ছিল পিতল, তামা ও ব্রোঞ্জ নির্মিত। সম্ভবত তখনো তারা লৌহের ব্যবহার জানত না।

সিন্ধু সভ্যতার প্রসার ও প্রভাব


সিন্ধু সভ্যতা যে শুধু মহেনজোদাড়ো ও হরপ্পাতে সীমাবদ্ধ ছিল তা নয়। প্রত্নতাত্ত্বিক খনন কাজে লক্ষ করা যায় যে, সিন্ধুর বিভিন্ন অঞ্চল, বর্তমান হায়দ্রাবাদ থেকে জ্যাককাবাদ পর্যন্ত এই সভ্যতার বিস্তার ঘটে। তাছাড়া পশ্চিম ভারতসহ বেলুচিস্থানের উত্তর ও দক্ষিণ অঞ্চল জুড়ে এই সভ্যতা প্রভাব রেখেছিল।ইউপি, বিহার, পাটনা ইত্যাদি অঞ্চলে প্রাপ্ত পুঁথির মালা ও চিত্র লেখন পদ্ধতির ধ্বংসাবশেষ থেকে মনে হয় সিন্ধু সভ্যতার প্রভাব ছিল ব্যাপক অঞ্চল জুড়ে।

উত্তর ভারতেও এর প্রভাব উপেক্ষা করা যায় না। সিন্ধু সভ্যতার মানুষ তথা দ্রাবিড়দের সামাজিক প্রথা ও ধ্যান ধারণা আর্যরা অনুসরণ করেছিল। দ্রাবিড়দের ভূমি-ব্যবস্থা, রাজস্ব ও গ্রাম সম্প্রদায় ব্যবস্থার রীতিনীতির কাছে আর্যরা অনেকাংশে ঋণী। হিন্দু ধর্মের মৌলিক ধারণার কিছু সিন্ধু সভ্যতা থেকে গৃহীত। ভারতীয় শিল্প, সাহিত্য, সংস্কৃতি ইত্যাদিতে এ সভ্যতার প্রভাব অনস্বীকার্য।

এটা আজ পরিস্কার হয়ে উঠেছে যে, উপমহাদেশের সভ্যতা আর্য সভ্যতার উন্নতির ফলশ্রুতিই কেবল নয়, এতে নানা সংস্কৃতির জটিল সংমিশ্রণ ঘটেছে এবং সে ক্ষেত্রে সিন্ধু সভ্যতার একটি গুরুত্বপূর্ণ ও সূদূর প্রসারী প্রভাব রয়েছে।

সিন্ধু সভ্যতার পতন


সিন্ধু সভ্যতার ধ্বংস ও পতন সম্পর্কে সংক্ষেপে বলা যায় যে, এই সভ্যতা প্রাকৃতিক দুর্যোগ যেমন- বন্যা, মহামারী বা ভূমিকম্পে ধ্বংস প্রাপ্ত হয়েছে বলে অনুমান করা হয়েছে। এ ধরনের অনুমানের কারণ হল এই যে, খনন কাজ থেকে সিন্ধু সভ্যতার বিভিন্ন স্থানে বিপুল পরিমাণ মৃতের কঙ্কাল আবিস্কৃত হয়েছে। সাধারণত প্রাকৃতিক দুর্যোগেই এভাবে এক সঙ্গে অনেক মানুষের মৃত্যু হয়ে থাকে বলে প্রত্নতাত্ত্বিক ও ঐতিহাসিকরা মনে করে থাকেন।

এই পোস্টটি পরিচিতদের সাথে শেয়ার করুন

পূর্বের পোস্ট দেখুন পরবর্তী পোস্ট দেখুন
এই পোস্টে এখনো কেউ মন্তব্য করে নি
মন্তব্য করতে এখানে ক্লিক করুন

অর্ডিনারি আইটির নীতিমালা মেনে কমেন্ট করুন। প্রতিটি কমেন্ট রিভিউ করা হয়।

comment url