প্রত্নতাত্ত্বিক বিভিন্ন যুগের সমাজ ও সংস্কৃতি

প্রত্নতত্ত্ব হচ্ছে অতীতের ধ্বংসাবশেষ সম্পর্কিত পাঠ বা গবেষণা। এটি নৃবিজ্ঞানের এমন এক শাখা যা এমন সমাজ ও সংস্কৃতির ইতিহাস রচনা করে যে সমাজের অস্তিত্ব আর নাই। প্রত্নতাত্ত্বিক বিভিন্ন যুগের সমাজ ও সংস্কৃতির সংক্ষিপ্ত ইতিহাস তুলে ধরা হল।

প্রত্নতাত্ত্বিক বিভিন্ন যুগের সমাজ ও সংস্কৃতি

প্রত্নতত্ত্ব বর্তমানে মানুষের অতীত ইতিহাসের গ্রহবন্দী চর্চার বদলে পরিবেশ, ভূপ্রকৃতি এবং উদ্ভিদ ও প্রাণীজগতের অন্যান্য বিষয়ের অতীত অধ্যায়নের মধ্য দিয়ে ভবিষ্যত নির্মানের বিজ্ঞান হিসাবে চর্চা করে যাচ্ছে। প্রত্নতত্ত্বের অধ্যায়নের মূল বিষয়গুলো হলো- ভৌত ধ্বংসাবশেষ, পরিবেশগত তথ্য, জীবাশ্ম, প্রাকৃতিক- সাংস্কৃতিক ভূদৃশ্যাবলী ইত্যাদি।

আর প্রত্নতত্ত্বের কাজ হল এইসব বিষয়কে বিশ্লেষণ করে প্রাচীনকালের মানুষ এবং পরিবেশ ও প্রকৃতির তৎকালীন চিত্র বোঝা এবং তার মাধ্যমে ভবিষ্যতের মানুষ এবং পরিবেশের রুপরেখা নির্মাণ করা। চলিত ধারণায় বস্তুগত নিদর্শনের ভিত্তিতে অতীত পুনঃনির্মাণ করার বিজ্ঞানকে প্রত্নতত্ত্ব বলা হয়। প্রত্নতত্ত্ব প্রধানত ইতিহাস ও পরিবেশ বিজ্ঞানের এক সহযোগী।

প্রাচীন কালের জিনিসপত্র, মূদ্রা, অট্টালিকা ইত্যাদি বিচার করে এবং ইতিহাস খুঁজে যা বের করা হয় বা যে ভাবে বের করা হয় তাকে বলে প্রত্নতাত্ত্বিক। খৃস্টপূর্ব ৫৫৬- ৫৩৯ অব্দে বেবিলনের সিপপুরে সামাথ নামক একটি ধ্বংসপ্রাপ্ত মন্দিরের খনন কাজই পৃথিবীর প্রথম বলে মনে করা হয়। খৃস্টপূর্ব ৪৬০-৩৮৬ অব্দে এথেন্সের প্রত্নতাত্ত্বিকরা দেলস এর ঈজিয়ান দ্বীপের প্রাচীন সমাধিগুলোতে খনন পরিচালনা করেন।

খৃস্টপূর্ব ৯৯-৫৫ অব্দে এবং চীনা দার্শনিক ইউয়ান কং খৃ্স্টিয় প্রথম শতাব্দীতে চীনাদের প্রত্ননিদর্শন সংরক্ষনের এই চর্চা এবং এই নিদর্শনগুলোর বিশ্লেষণ করে প্রাচীন চীনা সংস্কৃতির রুপরেখা উপস্থাপনের চেষ্টা করেন। ভারতে সুলতানী শাসনামলে প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শন সংগ্রহ ও এর ভিত্তিতে ইতিহাস চর্চার সূচনা হয়। মুহম্মদ বিন তুঘলক ব্যাপক প্রত্নতাত্ত্বিক অনুশীলন করেন।

চতুর্দশ শতক থেকে ইউরোপের রেনেসাঁ পর্বে অভিজাতদের মধ্যে প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শন সংগ্রহের প্রবণতা বৃদ্ধি পায়। ফলে প্রত্নতাত্ত্বিক ও প্রত্ন-লুটেরা উভয়েই মূলত যে কোনো উপায়ে প্রত্ন নিদর্শন সংগ্রহ করার জন্য উৎসাহী হয়ে উঠে। মিশরের পিরামিড ও ইউরোপের প্রাচীন সমাধিগুলোতে প্রত্নচর্চার নামে এক ধ্বংসযজ্ঞ পরিচালনা করা হয়।

এই প্রথায় প্রথম বিপরীতমুখী প্রয়াস চালান ইংরেজ গবেষক জন লিল্যান্ড। ১৫৩৩ থেকে ১৫৪৭ সাল পর্যন্ত তিনি প্রাচীন নথীপত্র সংগ্রহ, সংরক্ষণ ও গবেষণায় নিয়োজিত থাকেন। অপর ইংরেজ গবেষক ইউলিয়াম কার্ডেন ১৫৮৬ সাল থেকে ইংল্যান্ডের প্রাচীন নিদর্শনসমূহের এক বিস্তারিত তালিকা প্রণয়ন করেন যা ‘ব্রিটানিয়া’ নামে প্রকাশিত হয়।

১৮৬০ খৃস্টাব্দে ব্যাপক উৎসাহ ও উদ্দীপনা নিয়ে পম্পেই ও হারকুল্যুনেউম-এ প্রত্নতাত্ত্বিক খনন শুরু হয়। এবং এইবার প্রত্নতাত্ত্বিকরা উক্ত প্রত্নস্থলের মানুষের জীবনপ্রণালী ব্যাখ্যায় অগ্রগতি লাভ করেন। এই সাফল্য দেশ-বিদেশের প্রত্নতাত্ত্বিকদের মধ্যে উৎসাহের সূচনা করে।

প্রত্নতত্ত্বের কাজের পদ্ধতি 


জরীপ : খনন কাজের বাস্তবতা যাচাই করার জন্যই জরিপ করা হয়। পদ্ধতিগতভাবে প্রত্নস্থান বা প্রত্ননিদর্শন শনাক্ত করা, খুঁজে বের করা, তা ভূ-পৃষ্ঠে চিহ্নিত করা, মানচিত্রে শনাক্ত করা এবং গবেষণার জন্য প্রয়োজনীয় তথ্য উপাত্ত সংগ্রহ করাকে প্রত্নতাত্ত্বিক জরিপ বলে।

অনুসন্ধান : কোন প্রত্নতাত্ত্বিক উৎখননের পূর্বে প্রাকখনন গবেষণা সম্পাদন করতে হয়। এর জন্য প্রথম কার্য সম্পর্কে ধারণা অর্জন এর পর কোন জায়গায় প্রত্ননিদর্শন আছে কিনা বা ঐ স্থানটি প্রত্নস্থান কিনা তা পায়ে হেটে জরিপ বা খুঁজে বের করার মাধ্যমকে অনুসন্ধান বলে।

উৎখনন : কোনো গবেষণার ক্ষেত্রে অনুসন্ধানের ঠিক পরের স্থানটি দখল করে আছে উৎখনন। এটি এমন একটি বিষয় যা কোনো প্রত্নতত্ত্ববিদও পুনঃপুন খনন কার্য সম্পাদনের মাধ্যমেও কোনো প্রত্নস্থান সম্পর্কে সঠিক তথ্য পাওয়ার বিশেষ প্রক্রিয়া।

সংরক্ষণ : আমরা যখন কোনো প্রত্নস্থান থেকে কোন প্রকার প্রত্নবস্তু পাই সেটাকে নানা প্রকার পদার্থ দ্বারা এটিকে তার সাথে মানানসই করে এটিকে কোন একটি জাদুঘর বা প্রত্নতাত্ত্বিক দর্শনীয় জায়গায় রাখি এটাই সংরক্ষণ। আবার যাতে বিলুপ্তির আশংক্ষা না থাকে সে পর্যায়ে রাখাকে সংরক্ষণ বলে।

নথিভূক্তকরণ : কোনো প্রত্নবস্তু কীভাবে পেলাম, সেটি কোন সময়ের, তার ওজন কত, তার উচ্চতা, তার রং, তার নাম, কতটুকু মাটির নিচে পেলাম, কোন অঞ্চলের, এ ভাবে খুঁটিনাটি সব লিখাকেই বলে নথিভূক্তকরণ।

প্রত্মতাত্ত্বিক জ্ঞান ছাড়া প্রাগৈতিহাসিক কালের মানব সমাজের জীবনযাত্রা প্রণালি জানার বিকল্প কোন পন্থা নাই। কেননা প্রত্নতত্ত্ব যে যুগের মানুষের কথা আলোচনা করে তা ইতিহাসে পাওয়া যায় না। অর্থাৎ প্রাগৈতিহাসিক যুগের মানুষের সমাজ ও সংস্কৃতি হচ্ছে প্রত্নতত্ত্বের বিষয়বস্তু। তাই তখনকার মানুষের জীবনযাত্রা প্রণালি জানতে মাটি খুঁড়ে পাওয়া ঐ সব বস্তুগত সংস্কৃতির ধ্বংসাবশেষ খুবই মূল্যবান। খনন কাজ থেকে প্রাপ্ত তথ্যের ভিত্তিতে প্রত্নতাত্ত্বিকেরা প্রাগৈতিহাসিক কালকে কয়েকটি যুগে ভাগ করেছেন।

প্রত্নতাত্ত্বিক বিভিন্ন যুগের সমাজ ও সংস্কৃতি 


১. প্রাচীন প্রস্তর যুগ

ইংরেজি প্যালিওলিথিক এজ (Palaeolithic Age) এবং ওল্ড স্টোন এজ (Old Stone Age) এর বাংলা পরিভাষা প্রাচীন প্রস্তর যুগ। যুগটিকে মানব ইতিহাসের সব থেকে দীর্ঘতম যুগ বলা হয়। এই যুগটাকে কয়েকটি সাংস্কৃতিক স্তরে ভাগ করা যায়। যেমন-

ক. নিম্ন প্রাচীন প্রস্তর যুগ : নিম্ন প্রাচীন প্রস্তর যুগকাল হচ্ছে ৬,০০,০০০ থেকে ১,০০,০০০ বছর আগে এটা শেষ হয়। প্রত্নতাত্ত্বিকদের মতে নিম্ন প্রাচীন প্রস্তর যুগের মানব প্রতিনিধি হচ্ছে জার্মানীতে প্রাপ্ত হেইডেলবার্গ মানব, ইন্দোনেশিয়ার জাভা মানব ও চীনের পিকিং মানব। এ যুগের মানুষরা মোটা ও ভোতা ধরনের হস্ত-কুঠার ব্যবহার করত। পাথরের গায়ে সে যুগের নদীর গতিপথ খোদাই করা থাকত।

খ. মধ্য প্রাচীন প্রস্তর যুগ : মধ্য প্রাচীন প্রস্তর যুগ ১,০০,০০০ বছর আগে শুরু হয়। জার্মানীতে প্রাপ্ত নিয়ানডারথাল মানব ছিল এ যুগের বাসিন্দা। পশ্চিম ইউরোপের অনেক দেশেই নিয়ানডারথালেরা বাস করত। এরা শিকারী জীবনে অভ্যস্ত ছিল। এই যুগের পাথর নির্মিত হাতিয়ার ছিল অধিকতর সরু ও ধারালো।

গ. উচ্চ প্রাচীন প্রস্তর যুগ : উচ্চ প্রাচীন প্রস্তর যুগ শুরু হয় ৩০,০০ বছর পূর্বে এবং তা খৃস্টপূর্ব ১০,০০০ বছর কাল পর্যন্ত স্থায়ী হয়। এ যুগের বাসিন্দারা হচ্ছে ক্রোম্যাগনন মানব। এরা ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র শিকারী সমাজে সংগঠিত ছিল। তারা তীর ধনুকের ব্যবহার শিখেচিল। পাথর নির্মিত হাতিয়ারের মানকে আরো উন্নত করে। এরা গুহার দেয়ালে ছবি আঁকত। এদের মধ্যে বয়স ও লিঙ্গভিত্তিক শ্রম বিভাগ ছিল বলে জানা যায়।

সাধারণভাবে বলা যায় যে, প্রাচীন প্রস্তর যুগের বাসিন্দারা খাদ্য সংগ্রহ অর্থনীতি নির্ভর ছিল। তারা ফলমুল সংগ্রহ, শিকার ও মাছ ধরে জীবন ধারণ করত এবং যাযাবর জীবন যাপন করত। তাদের মধ্যে ধর্মীয় চেতনা তথা অতিপ্রাকৃত শক্তিতে বিশ্বাস দানা বেধে ওঠে। ধারণা করা হয় এ যুগেই আগুনের আবিস্কার হয়।

২. নতুন প্রস্তর যুগ 

নতুন প্রস্তর যুগ খৃস্টপূর্ব ৭,০০০ অব্দের পূর্বে মধ্যপ্রাচ্যে এ যুগের সূচনা হয়। পরে ভূমধ্যসাগরীয় অঞ্চল এবং অবশেষে খৃস্টপূর্ব ২,৫০০ অব্দে বৃটেনে এ যুগের সূচনা হয়। প্রাচীন প্রস্তর যুগের সমাজ ও সংস্কৃতির তুলনায় নতুন প্রস্তর যুগের সমাজ ও সংস্কৃতি অধিকতর উন্নত। এ যুগে আর্থ-সামাজিক জীবনে আসে এক বৈপ্লবিক পরিবর্তন। গর্ডন চাইল্ড এ যুগের সমাজ পরিবর্তনকে নবপলীয় বিপ্লব নামে আখ্যা দিয়েছেন।

নবপলীয় বিপ্লবের ফলে অর্জিত আর্থ- সামাজিক সাফল্য


প্রথমত : নতুন প্রস্তর যুগের মানুষ খাদ্য সংগ্রহ অর্থনীতির স্থলে খাদ্য উৎপাদন অর্থনীতির প্রবর্তন করে। এর ফলে ফলমুল সংগ্রহ এবং শিকার অর্থনীতির গুরুত্ব কমে আসে।

দ্বিতীয়ত : নতুন প্রস্তর যুগের অধিবাসীরাই প্রথম মানুষ যারা বীজ বপন, গাছ লাগানো এবং ফসল কাটা ও তা প্রক্রিয়াজাত করার মাধ্যমে কৃষি কাজের শুভ সূচনা করে।

তৃতীয়ত : এ যুগের মানুষই পশুপালন অর্থনীতির উদ্ভাবক। এ যুগের পূর্বে প্রাচীন প্রস্তর যুগে পশু শিকার করলেও তখনও মানুষ পশুকে গৃহ পালিত করার কৌশল আয়ত্ব করেনি অথবা পশু পালনের কথা চিন্তা করেনি। পশু পালনের যুগে পশুর বংশ বৃদ্ধি ঘটে এবং খাদ্য যোগানে খানিকটা নিশ্চয়তা আসে।

চতুর্থত : কৃষি অর্থনীতি উদ্ভবের ফলে খাদ্যের নিশ্চয়তা আরো বৃদ্ধি পায়। কৃষিতে উৎপাদিত ফসল নিজেদের প্রয়োজন মেটানোর পরও অবশিষ্ট থাকে। ফলে অনেকেই হস্ত শিল্পের কাজ-কর্ম শুরু করে এবং ক্রমে বাজার ও শহর গড়ে উঠতে থাকে।

পঞ্চমত : নতুন প্রস্তর যুগেই সর্বপ্রথম যাযাবর জীবন ত্যাগ করে স্থায়ী বসবাসের জীবন শুরু করে। যেহেতু এ যুগে কৃষি কাজের সূচনা হয় এবং যেহেতু কৃষি কাজে বীজ বপন করে ফসল পাবার জন্য অপেক্ষা করতে হয় তাই, তারা স্থায়ীভাবে বসবাসের জন্য তৈরী হয় এবং এ যুগেই স্থায়ী বসবাসের জীবন শুরু হয়।

ষষ্ঠত : নতুন প্রস্তর যুগে যেহেতু কৃষি অর্থনীতি প্রবর্তিত হয়, তাই কৃষি ভুমিতে ব্যক্তিগত মালিকানার সৃষ্টি হয়। আর ব্যক্তিগত মালিকানার ফলে সমাজে শ্রেণী বৈষম্যের সূত্রপাত ঘটে। এতে সমাজে অসমতা বৃদ্ধি পায়। আয়ের পরিমান ও পেশার তারতম্য দেখা দেয়। ফলে সমাজে স্থায়ী স্তর বিন্যাসের আবির্ভাব ঘটে।

সপ্তমত : নতুন প্রস্তর যুগে কৃষি অর্থনীতি নির্ভর স্থায়ী গ্রাম সম্প্রদায় গড়ে উঠে। সৃষ্টি হয় গ্রামীন জীবন। এ ধরনের গ্রামীণ জীবনের ভিত্তি ছিল কৃষি অর্থনীতি।

অষ্টমত : এ কথা বলা যায় যে, সভ্যতা হল কৃষিজ ব্যাপার বা কৃষি আবিস্কার হলেই সভ্য জীবনের সূত্রপাত ঘটে। বস্তুত ফলমূল সংগ্রহ ও শিকারের স্থলে কৃষি অর্থনীতির উদ্ভব ঘটায় মানুষ যাযাবর জীবন ত্যাগ করে এবং নতুন প্রস্তর যুগে তারা স্থায়ী জীবনের সূত্রপাত ঘটায়। এটা মানব সমাজের ইতিহাসে একটা বৈপ্লবিক ঘটনা। এজন্য গর্ডন চাইল্ড এই সব পরিবর্তনকে নবপলীয় বিপ্লব বলে আখ্যা দিয়েছেন।

৩. তাম্রযুগ 

খৃস্টপূর্ব ৪০০০ অব্দে মিশর এবং ব্যবিলনিয়াতে তামার ব্যবহার সম্পর্কে জানা যায়। হাতুড়ি এবং অন্যান্য ধারালো অস্ত্র তৈরির ক্ষেত্রে তামার ব্যবহারের সূত্রপাত হয়। ইউরোপীয় সমাজে তামার অভাব ছিল বিধায় এর ব্যবহারের কথা তেমন জানা যায় না।

ভারতীয় সমাজে তামার প্রচলন ছিল। তামার মুদ্রা, তামার তৈজসপত্র এবং বিভিন্ন হাতিয়ার নির্মাণে এর ব্যবহারের কথা জানা যায়। তামার নানাবিধ ব্যবহারের ক্ষেত্রে আগুনের সাহায্য অপরিহার্য । কেননা এই ধাতব পদার্থটিকে গলিয়ে নানা ধরনের আকার দিতে আগুনের প্রয়োজন। তামা গলিয়ে বিভিন্ন দ্রব্য সামগ্রী তৈরি করার সুযোগ সৃষ্টিতে বস্তুগত সাংস্কৃতিক জীবনে সমৃদ্ধি আসে।

৪. ব্রোঞ্জ যুগ 

খৃস্টপূর্ব চার হাজার থেকে তিন হাজার অব্দের মধ্যে যুগটি মেসোপটোমিয়া, মিশর, ভারত এবং চীনে শুরু হয় এবং ধীরে ধীরে পৃথিবীর বিভিন্ন সময়ে এ যুগটির আবির্ভাব ঘটে। যেমন বলা যায় খৃস্টপূর্ব ১৯০০ অব্দে ব্রিটেনে ব্রোঞ্জ যুগের সূচনা হয় এবং ১৪০০ খৃস্টাব্দ পর্যন্ত তা স্থায়ী হয়।

ব্রোঞ্জ যুগের কয়েকটি সাংস্কৃতিক সাফল্য 


ব্যবসা-বাণিজ্য আন্তর্জািতিক রূপ লাভ করে। ব্যবসা-বাণিজ্যের ব্যাপক প্রসারের ফলে বিনিময় ব্যবস্থা পরিবর্তন হয় এবং বিনিময় ব্যবস্থায় মূদ্রা অর্থনীতির বিকাশ ঘটে।
এ যুগে চাকার আবিস্কার সম্ভব হয়। ফলে ষাড় চালিত গাড়ির প্রবর্তন হয়। এর ফলে যোগাযোগ ব্যবস্থার উন্নতি হয়।

অধিক জনসমষ্টি মিলে বড় বড় স্থায়ী মানব সমাজ গড়ে ওঠে। এই যুগে উৎপাদন ব্যবস্থার কিছু উন্নতি হওয়ায় মানুষ স্থায়ীভাবে একত্রে বসবাস করার কথা চিন্তা ভাবনা করে।

এই পর্যায়ে লেখা আবিস্কার হয়। লেখা আবিস্কার হওয়ায় শিক্ষা ও জ্ঞানের কিছুটা প্রসার ঘটে।
ব্রোঞ্জ যুগে ব্রোঞ্জের তৈরি অস্ত্র ও অলংকারের প্রবর্তন হয়। সামন্ত প্রভূরা যুদ্ধক্ষেত্রে ব্রোঞ্জ তৈরি অস্ত্র ব্যবহার করত বলে জানা যায়।

৫. লৌহ যুগ 

পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে বিভিন্ন সময়ে লৌহের ব্যবহার শুরু হয়। খৃস্টপূর্ব ১৫০০ অব্দে মধ্যপ্রাচ্যে লৌহের ব্যবহার শরু হয়। এশিয়া মাইনরে হিটটিটরা প্রথম লৌহ শিল্পের ব্যবহার শুরু করে। পরে আসিরীয়রা লৌহের ব্যাপক উৎপাদন শুরু করে। ব্রিটেনে খৃস্টপূর্ব ৫০০ অব্দে লৌহের ব্যবহার শুরু হয়। ভারতবর্ষে খৃস্টপূর্ব ১০০০ অব্দে শুরু হয়। এর পর ধীরে ধীরে দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ায় ইন্দোনেশিয়া পর্যন্ত ছড়িয়ে পড়ে।

লৌহ যুগের সাংস্কৃতিক অগ্রগতি ও তার বৈশিষ্ট্যাবলি 


  • লৌহের ব্যবহার সভ্যতার বিকাশে এক যুগান্তকারি অবদান রাখে। আধুনিক সভ্যতার ভিত্তি হচ্ছে লৌহ।বর্তমান যুগকে লৌহ সভ্যতার যুগ বলা হয়। ব্রোঞ্জের তুলনায় লৌহ সস্তা, মজবুত এবং লৌহের ব্যবহার সহজসাধ্য। তাই লৌহ যুগে মানব সভ্যতার অভাবনীয় উন্নতি হয়েছে।
  • লৌহ যুগে কৃষি যন্ত্রপাতিতে আসে এক নবতর বিপ্লব। কেননা লৌহের দ্বারা সহজে হরেক রকমের কৃষি যন্ত্রপাতি তৈরি সম্ভব হয়।
  • যানবাহন তৈরিতে লৌহের ব্যবহার বৃদ্ধি পায়। যানবাহন ও যাতায়াত ব্যবস্থার উন্নতির ফলে মানুষ বিভিন্ন স্থানে ব্যবসা বাণিজ্যের জন্য যায় এবং বিভিন্ন দেশের মানুষের মধ্যে সাংস্কৃতিক লেনদেন ও ভাবের আদান-প্রদান বৃদ্ধি পায়।
  • ঘরবাড়ি নির্মাণে এবং নানা ধরনের গৃহসামগ্রী, আসবাবপত্র, বৈজ্ঞানিক ও প্রযুক্তির কাজে লৌহের ব্যবহার বেড়ে যায়।
  • লৌহের আরেকটি উল্লেখযোগ্য অবদান হচ্ছে শিল্পকলা ও স্থাপত্যে এর ব্যাপক ব্যবহার বেড়ে যায়।
  • শিল্পায়ন ও নগরায়নে লৌহের ভূমিকা অনস্বীকার্য। কেননা কলকারখানা ও সেগুলোর খুচরা যন্ত্রপাতি নির্মাণে এবং নগর গড়ে তুলতে রাস্তাঘাট, পুল ও বিল্ডিং বাড়ি তৈরি করতে লৌহের ব্যাপক ব্যবহার শুরু হয়।
  • আধুনিক যুগে অস্ত্র শিল্পের প্রভূত উন্নতির মূলে লৌহের ব্যাপক ব্যবহারকেই দায়ী করা চলে। বস্তুত আধুনিক সভ্যতা বলতে লৌহ সভ্যতাকেই বোঝায়।
  • লৌহ যুগে কাল্পনিক ধ্যান ধারণার স্থলে অধিকতর যুক্তি নির্ভর চিন্তা-চেতনার বিকাশ ঘটে। অবৈজ্ঞানিক ও অযৌক্তিক বিশ্বাসের স্থলে বৈজ্ঞানিক ও যৌক্তিক বিচার বিশ্লেষণ শুরু হয়।
  • লৌহ যুগে বিভিন্ন পেশাভিত্তিক সামাজিক শ্রেণীর উদ্ভব ঘটে। ফলে সমাজে সামাজিক বৈষম্য ও শ্রেণী ভেদাভেদ ক্রমশ বেড়ে চলে।

প্রত্নতাত্ত্বিক বিভিন্ন যুগ সম্পর্কে আলোচনা করা হয়েছে। এরপর প্রত্নতাত্ত্বিক বিভিন্ন যুগ যেমন- প্রাচীন প্রস্তুর যুগ, নতুন প্রস্তর যুগ, তাম্র যুগ, ব্রোঞ্জ যুগ, লৌহ যুগ, এবং সেইসব যুগের সমাজ সংস্কৃতি সম্পর্কে একটি ধারণা দেয়ার চেষ্টা করা হয়েছে।

এই পোস্টটি পরিচিতদের সাথে শেয়ার করুন

পূর্বের পোস্ট দেখুন পরবর্তী পোস্ট দেখুন
এই পোস্টে এখনো কেউ মন্তব্য করে নি
মন্তব্য করতে এখানে ক্লিক করুন

অর্ডিনারি আইটির নীতিমালা মেনে কমেন্ট করুন। প্রতিটি কমেন্ট রিভিউ করা হয়।

comment url