বাংলাদেশে পরিবারের ধরন, প্রকৃতি, বৈশিষ্ট্য ও গুরুত্ব

পরিবার এক সর্বজনীন, অকৃত্রিম এবং মৌলিক সামাজিক একক। বর্তমান বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে পরিবারের গড়ন কাঠামো, পরিবারের ভবিষ্যত, পরিবারের ধরন-প্রকৃতি তথা এর বৈশিষ্ট্য ও গুরুত্ব বা কার্যাবলি এবং পরিবারের ভাঙ্গন ইত্যাদি সম্পর্কে আজকের আলোচনা।

বাংলাদেশে পরিবারের ধরন, প্রকৃতি, বৈশিষ্ট্য ও গুরুত্ব

পরিবারের গড়ন বা কাঠামো


পরবার হল সমাজের সবচেয়ে ক্ষুদ্রতম সামাজিক সংগঠন। পরিবারের সদস্যরা রক্ত সম্পর্কীয় এবং বৈবাহিক সূত্রে আবদ্ধ। পরিবার পিতা মাতা ও তাদের সন্তান-সন্ততিদের কেন্দ্র করে হতে পারে, একসঙ্গে বসবাসরত আত্মীয়-স্বজনদের প্রসারিত পরিবারও হতে পারে এবং পরিবার হলো একটি বৃহৎ সংসার, যেখানে অন্যান্য আত্মীয় ও ছেলেমেয়েদের সঙ্গে কিংবা তাদের ছাড়া অনাত্মীয়রাও যুক্ত হয়।

পরিবারের মধ্যেই মানব শিশুর জন্ম, তার লালন-পালন, প্রাথমিক শিক্ষা, ব্যক্তিত্বের গড়ন এবং সামাজিক ক্রিয়াকর্মের অধিকাংশই পরিবারকে কেন্দ্র করে পরিচালিত হয়। পরিবারের সঙ্গে ব্যক্তির সম্পর্ক অকৃত্তিম, অন্তরিক এবং অবিচ্ছেদ্য। সমাজবিজ্ঞানী ডেভিড পোপেনো বলেন, পরিবার হলো এমন একটি জ্ঞাতি ভিত্তিক গোষ্ঠী যার সদস্যরা একত্রে বসবাস করে এবং অর্থনৈতিক এবং অন্যান্য উদ্দেশ্য অর্জনের একক হিসাবে সহযোগিতামূলক দৃষ্টিভঙ্গিতে কাজ করে।

বিশ্বের যে কোন পরিবারের অধিকাংশই স্বামী-স্ত্রী ও তাদের অবিবাহিত ছেলেমেয়েদের নিয়ে গঠিত। পরিবারের সদস্যরা একে অপরের ওপর নির্ভরশীল এবং সম্পদ, শ্রম ও আবেগ-অনুভূতিতে অংশগ্রহণের মাধ্যমে তারা জীবনের সামাজিক, আর্থিক ও রাজনৈতিক দিকগুলি পরিচালনা করে। নির্দিষ্ট বংশধারায় সাধারণত একজন নারী বিভিন্ন বংশের কোন একজন পুরুষের সঙ্গে বিবাহসূত্রে আবদ্ধ হয়। সমাজবিজ্ঞানী নিমকফ বলেন, পরিবার হল স্বামী-স্ত্রীর এমন একটি সংস্থা যা কমবেশি স্থায়ী এবং সেখানে সন্তান-সন্ততি থাকতেও পারে আবার নাও পারে।

যে সব প্রয়োজনে পরিবারের উদ্ভব ঘটে 


  • জৈবিক কাজ।
  • সন্তান লাভ বা সন্তানের প্রতি স্নেহ ও আবেগ।
  • পরবর্তী বংশে নিজের নাম, বংশ ও সম্পত্তি রেখে যাবার তাড়না।
  • অর্থনৈতিক নিরাপত্তা ও সহযোগিতা।
  • বার্ধক্যে সহযেগিতার চিন্তা ভাবনা।
  • নিজের দুঃখ-বেদনা ও হাসি আনন্দ ভাগাভাগি করে নেয়ার মনোবৃত্তি।

বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে পরিবারের গড়ন কাঠামো 


ধর্ম, এলাকা, সমতলবাসী, পাহাড়বাসী, এথনিক গোষ্ঠী এবং অর্থনৈতিক শ্রেণীভেদে বাংলাদেশের পরিবারের গড়ন-কাঠামো বা বৈশিষ্ট্যের মধ্যে কম বেশি পার্থক্য আছে। স্বামী-স্ত্রী এবং তাদের অবিবাহিত সন্তান নিয়েই গড়ে উঠে আমাদের পরিবার। কোনো কোনো পরিবারে দাদা-দাদী, নাতি-নাতনীও থাকেন। কোনো পরিবার হয়ত সন্তান বিহীন, কোনো পরিবারে রয়েছে চাচা-চাচী তথা ভাই-ভাতিজা ইত্যাদি। আমাদের সমাজে পরিবার বলতে অনেক সময় House hold বা খানা-পরিবারকেও নির্দেশ করে। অর্থাৎ যারা একত্রে আহার করে।

বাংলাদেশের পরিবারের ধরন-প্রকৃতি ও বৈশিষ্ট্য 


বাংলাদেশের শহরাঞ্চলের পরিবারগুলো মূলত অণুপরিবার। গ্রামের পরিবারগুলো ঐতিহ্যগতভাবে যৌথ পরিবার। তবে আর্থিক দুরাবস্থা, পেশাগত পরিবর্তন, সম্পত্তি সিলিং নীতি, মেজাজ ও ব্যক্তিত্বের সংঘাত ইত্যাতি কারণে যৌথ পরিবারের দ্রুত ভাঙ্গন দেখা দিয়েছে। উল্লেখ্য যে গ্রামের মুসলিম পরিবারের তুলনায় হিন্দু পরিবারগুলো ছিল বেশি যৌথভিত্তিক। শহরেও দুই চারটি এমন পরিবার দেখা যায়।

বাংলাদেশের যৌথ পরিবার এবং তা ভাঙ্গনের কারণ 


ঐতিহ্যগতভাবেই বাংলাদেশের পরিবার ছিল যৌথ। বিশেষ করে যৌথ পরিবার বাংলাদেশ ও ভারতের সুপ্রাচীন এক ঐতিহ্য। বাবা-মা, দাদা-দাদী এমনকি চাচা-চাচী এবং তাদের সন্তানাদিসহ নাতি-নাতনীদের নিয়ে গঠিত হতো বৃহদাকার যৌথ পরিবার। এসব যৌথ পরিবারে সন্তানদের সংখ্যাও ছিল অনেক। বয়স্ক পুরুষ সদস্যই যৌথ পরিবারে নেতৃত্ব দিতেন।

যৌথ পরিবারের সদস্যদের মধ্যে জ্ঞাতিসম্পর্ক ছাড়াও দায়িত্ব-কর্তব্যে ছিল বাঁধা। পারিবারিক বন্ধন ছিল খুবই মজবুত। নিজেরা সহমর্মিতা, সহযোগিতা ও কর্তব্যনিষ্ঠায় ছিল আন্তরিক। প্রতিটি যৌথ পরিবার বংশ মর্যাদা ও আত্মসম্মান নিয়ে ধনে-জনে তৃপ্তি সহকারে বসবাস করত। রোগ-ব্যাধি হলে একে অপরের সেবা-যত্নে এগিয়ে আসত।

পরিবারের সুখ-দুঃখ ভাগাভাগি করে নেয়াই ছিল রীতি এবং সামাজিক মূল্যবোধের এক উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত। নানা করণে বাংলাদেশের ঔতিহ্যবাহী যৌথ পরিবারে যে সব কারণে ভাঙ্গন দেখা দিয়েছে সেগুলি হল- আর্থিক অনটন, নগরায়ন ও শিল্পায়ন, শ্রম বিভাজন, ব্যক্তি স্বাতন্ত্রবাদী দৃষ্টিভঙ্গি, শিক্ষা ও সচেতনতা, পারিবারিক কলহ ও দ্বন্দ্ব-সংঘাত, ব্যক্তিগত পর্যায়ে উন্নয়ন-ভাবনা।

উভয় ধরনের পরিবারেই কিছু সুবিধা এবং অসুবিধা আছে। তবে মনে রাখতে হবে যে একক পরিবারের মধ্যে শান্তি খঁজতে গিয়ে যেন আমরা আমাদের বৃদ্ধ পিতা-মাতা বা অন্যান্যদের প্রতি দায়িত্ব পালনে কোনো রকম অবহেলা না করি।

পরিবারের প্রকারভেদ 


১. ক্ষমতার মাত্রার ভিত্তিতে পরিবারকে দুইটি ভাগে ভাগ করা হয়। যেমন-

পিতৃপ্রধান পরিবার : পরিবারের সামগ্রিক ব্যবস্থাপনা ও নেতৃত্ব দেয়ার ক্ষমতা যখন পরিবারের বয়স্ক পুরুষের ওপর ন্যস্ত করা হয় তখন তাকে পিতৃপ্রধান পরিবার বলা হয়। আমাদের সমাজে পিতৃপ্রধান পরিবারই দেখা যায়। পরিবার জীবনে এমন কতগুলো উল্লেখযোগ্য বিষয় থাকে যেখানে পরিবার প্রধানকে যথা সময়ে সঠিক সিদ্ধান্ত গ্রহণ করতে হয়।

মাতৃপ্রধান পরিবার : যে পরিবারে নেতৃত্বদানের ক্ষমতা পরিবারের বয়স্ক মহিলা যেমন স্ত্রী বা মাতার উপর ন্যস্ত থাকে তাকে মাতৃপ্রধান পরিবার বলে। গারো উপজাতিদের মধ্যে মাতৃপ্রধান পরিবার দেখা যায়। মাতৃপধান পরিবারের সংখ্যা সামগ্রিকভাবে মূলত কম। তবে শিক্ষার প্রসারের ফেলে মেয়েরা বিভিন্ন পেশায় নিয়োজিত হচ্ছে এবং পরিবারে সিদ্ধান্ত গ্রহণের ক্ষেত্রে উল্লেখযোগ্য ভূমিকা রাখছেে। তাই সমাজবিজ্ঞানীরা এ ধরনের পরিবারকে সমতা ভিত্তিক পরিবার বলে আখ্যায়িত করেছেন। এসব পরিবার মূলত গণতান্ত্রিক মূল্যবোধের উপর নির্ভরশীল।

২. বিবাহোত্তর বসবাসের ভিত্তিতে পরিবার মূলত তিন প্রকার। যেমন-

পিতৃবাস পরিবার : এই পরিবারে বিবাহিত নব দম্পতি প্রথা অনুযায়ী স্বামীর পিতৃগৃহে বসবাস করে। বাংলাদেশের পরিবার ব্যবস্থায় পিতৃবাস রীতিই বেশি পরিলক্ষিত হয়।

মাতৃবাস পরিবার : মাতৃবাস পরিবারে বিবাহিত নব দম্পতি স্ত্রীর পিতৃগৃহে বসবাস করে। গারো উপজাতি সমাজে মাতৃবাস রীতি প্রচলিত। বিশেষ বিশেষ অবস্থার পেক্ষাপটে মাতৃবাস রীতিও পরিলক্ষিত হয়।

নয়াবাস পরিবার : এই পরিবারে বিবাহিত নব দম্পতি তাদের কারও পিতৃগৃহে বাস না করে সম্পূর্ণভাবে তাদের নতুন বাড়িতে বসবাস করে। এ ধরনের পরিবারে নববিবাহিত দম্পতি অধিকতর স্বাধীন জীবনযাপন করার সুযোগ লাভ করে। শিক্ষার প্রসার, নগরায়ন, শিল্পায়ন এবং পেশায় বৈচিত্র আসার ফলে নয়াবাস রীতিই ব্যাপকভাবে দেখা যাচ্ছে।

৩. বংশমর্যাদা এবং সম্পত্তির উত্তরাধিকারের ভিত্তিতে পরিবার দুই প্রকার। যেমন-

পিতৃসূত্রীয় পরিবার : এই ধরনের পরিবারে সন্তান-সন্ততি পিতার ধারায় সম্পত্তি এবং বংশ নাম বা মর্যাদা উত্তরাধিকার সূত্রে অর্জন করে।

মাতৃসূত্রীয় পরিবার : মাতৃসূত্রীয় পরিবারে সন্তান-সন্ততি মাতৃধারায় সম্পত্তি এবং বংশ নাম বা মর্যাদা উত্তরাধিকার সূত্রে অর্জন করে।

৪. আকারের ভিত্তিতে পরিবারের তিনটি শ্রেণীভাগ লক্ষ করা যায়। যেমন-

অণু পরিবার : স্বামী-স্ত্রী দুইজন মিলে গঠিত পরিবার অথবা তাদের সঙ্গে তাদের অবিবাহিত সন্তানদের নিয়ে গঠিত পরিবারকে অণুপরিবার বলা হয়।

বর্ধিত পরিবার : তিন পুরুষের পরিবারই বর্ধিত পরিবার। এখানে স্বামী-স্ত্রী, সন্তান-সন্ততি ও নাতি-নাতনী একসঙ্গে বসবাস করে। এটা মূলত অণুপরিবারের বর্ধিত রূপ।

যৌথ পরিবার : কোন পরিবারের কর্তার সঙ্গে যদি তার পিতা-মাতা, এক বা একাধিক ভাই ও তাদের সন্তান-সন্ততি বা নিকট আত্মীয়-স্বজন বসবাস করে তবে তাকে যৌথ পরিবার বলা হয়। এ ধরনের যৌথ পরিবারের সদস্যরা পারস্পরিক সহযোগিতা এবং সহমর্মিতার মন নিয়ে যাবতীয় কাজ করে থাকে।

৫. স্বামী-স্ত্রীর সংখ্যার ওপর ভিত্তি করে পরিবারকে চার ভাগে ভাগ করা হয়।

এক বিবাহভিত্তিক পরিবার : একজন পুরুষ এবং একজন স্ত্রীলোকের মধ্যে বিবাহের ভিত্তিতে যে পরিবার গড়ে ওঠে তার নাম এক বিবাহভিত্তিক পরিবার। আধুনিক বিশ্বের অধিকাংশ সমাজে এক বিবাহভিত্তিক পরিবারই দেখা যায়।

বহু স্ত্রী বিবাহভিত্তিক পরিবার : একজন পুরুষের সাথে একাধিক স্ত্রীলোকের বিয়ের ভিত্তিতে গঠিত পরিবারই বহু-স্ত্রী বিবাহ ভিত্তিক পরিবার। মুসলিম সমাজে সব স্ত্রীর প্রতি সম দৃষ্টির শর্তে বহু স্ত্রী গ্রহণ করার অনুমতি আছে। বিশ্বের বিভিন্ন অঞ্চলে এই ধরনের পরিবারের সংখ্যা পূর্বের তুলনায় অনেকটা কমে আসছে।

বহু স্বামী বিবাহভিত্তিক পরিবার : একজন স্ত্রীলোকের সাথে একাধিক পুরুষের বিয়ের মাধ্যমে যে পরিবার গড়ে ওঠে তার নাম বহু স্বামী বিবাহভিত্তিক পরিবার। দক্ষিণ ভারতের টোডাদের মধ্যে এই রীতি ছিল।
দলগত বিবাহভিত্তিক পরিবার : একাধিক স্ত্রীলোকের সঙ্গে একাধিক পুরুষের বিবাহের ভিত্তিতে যে পরিবার গড়ে ওঠে তাকে বলা হয় দলগত বিবাহভিত্তিক পরিবার। কিছু নৃবিজ্ঞানীর মতে অনেক প্রাচীন সমাজে এমনটি লক্ষ করা গেছে।

৬. পাত্র-পাত্রী নির্বাচনের ভিত্তিতে পরিবারকে দুইভাগে ভাগ করা হয়।

বহির্গোত্র বিবাহভিত্তিক পরিবার : এই ধরনের পরিবারে ব্যক্তিকে সামাজিক বিধি অনুসারে নিজ গোত্রের বাইরে বিয়ে করতে হয়। বহির্গোত্র বিবাহের অন্যতম কারণ হল অজাচার এর ওপর নিষেধাজ্ঞা আরোপ।

অন্তর্গোত্র বিবাহভিত্তিক পরিবারে : এই পরিবারে ব্যক্তিকে সামাজিক বিধি অনুযায়ী নিজস্ব গোত্রে বিয়ে করতে হয়। অন্তর্গোত্র বিবাহের কারণ হল নিজ গোত্রের মধ্যে রক্তের বিশুদ্ধতা এবং উত্তরাধিকারত্ব বজায় রাখা। সমাজবিজ্ঞানী ও নৃবিজ্ঞানীগণ আরেক ধরনের পরিবারের কথা বলেন যাকে সমতাভিত্তিক পরিবার বলে আখ্যায়িত করা হয়। এ ধরনের পরিবারে স্বামী-স্ত্রী উভয়ের ক্ষমতা প্রায় সমান সমান। বস্তুত আধুনিক শিক্ষিত পরিবারগুলো গণতান্ত্রিক মূল্যবোধ দ্বারা অনুপ্রাণিত হয়ে এ ধরনের পরিবার জীবন গঠন করছে।

পরিবারের কার্যাবলী 


পরিবারের জৈবিক কাজ : স্বমী-স্ত্রীর জৈবিক সম্পর্ক বজায় রাখা ও সন্তান জন্মদান করা জৈবিক কাজের মধ্যে পড়ে। মূলত আজ পর্যন্ত অধিকাংশ মানুষ পরিবারের গন্ডিতেই জৈবিক চাহিদা পূরণ করে। সন্তান জন্মদানের ক্ষেত্রে এমন সতর্কতামূলক ব্যবস্থা নিচ্ছে যাতে সীমিত সংখ্যক সন্তান জন্মগ্রহণ করে।

পরিবারের মনস্তাত্ত্বিক কাজ : সন্তানের লালন-পালন পরিবারের মনস্তাত্ত্বিক কাজের মধ্যে পড়ে। শিশুর গোসল করানো, খাওয়ানো, পরিচর্চা, আদর-যত্ন সর্বোপরি তাকে স্নেহের পরশে লালন-পালনের কাজটি মূলত মনস্তাত্ত্বিক।

পরিবারের রক্ষণাবেক্ষণমূলক কাজ : শিশুর রক্ষণাবেক্ষণ পরিবারের আর একটি কাজ। জন্মের পর শিশু খুবই অসহায় থাকে। পরিবার বিভিন্ন বিপদ-আপদ থেকে সন্তানদের রক্ষণাবেক্ষণ করে।

পরিবারের অর্থনৈতিক কাজ : পরিবারের নারী-পুরুষ সবাই মিলে কৃষি কাজ ও পশুপালন করে অর্থ উপার্জন করে। আধুনিক শিল্পায়িত সমাজে পরিবারের স্বামী-স্ত্রীরা ঘরে-বাইরে কাজ করে ছেলে-মেয়েদের ভরণপোষণের জন্য অর্থ উপার্জন করে।

পরিবারের শিক্ষামূলক কাজ : সন্তানদের শিক্ষাদান পরিবারের অন্যতম কাজ। পরিবার সন্তানদের নীতিবোধ শিক্ষা দেয়, স্কুলে ভর্তি করে,বাড়িতে নিয়মিত পড়ার উপর নজর রাখে। এভাবেই সন্তানরা প্রাথমিক শিক্ষা গ্রহণ করে থাকে তার নিজ পরিবারে।

পরিবারের ধর্মীয় শিক্ষাদান কাজ : ধর্মীয় এবং মূল্যবোধ ভিত্তিক শিক্ষা দান করা পরিবারের আর একটি গুরুত্বপূর্ণ কাজ। ব্যক্তিগত লোভ-লালসাকে নিয়ন্ত্রণ করতে এবং চরিত্র গঠনে ধর্ম বিশেষ ভূমিকা পালন করে। মূলত শিশুর ধর্মীয় শিক্ষাদান পারিবারিক ভাবেই হয়ে থাকে।

পরিবারের রাজনৈতিক কাজ : সন্তানদের উপযুক্ত নাগরিক হিসাবে গড়ে তোলা পরিবারের একটা অন্যতম কাজ। পরিবারের মধ্যেই নেতৃত্ব, দায়িত্ব কর্তব্য, নিয়ম-শৃংঙ্খলা ইত্যাদি বিষয়ে শিক্ষা লাভ করে।

পরিবারের সামাজিকীকরণ এবং সামাজিক নিয়ন্ত্রণমূলক কাজ : সামাজিকীকরণ এবং সামাজিক নিয়ন্ত্রণমূলক কাজও পরিবারের অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ কাজ। সন্তানদের পারিপার্শ্বিক পরিবেশের সঙ্গে খাপখাইয়ে নিতে শিক্ষা দেয় এবং বয়স্ক ব্যক্তিরা শিশুদের আচার আচরণ নিয়ন্ত্রণ করে থাকে যা সামাজিক নিয়ন্ত্রণে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে।

পরিবারের চিত্তবিনোদন মূলক কাজ : শিশুদের আনন্দ দান অর্থাৎ শিশুর চিত্তের বিকাশের জন্য পরিবারকেই অগ্রণী ভূমিকা পালন করতে হয়। এ জন্যই পরিবার ছেলেমেয়েদের খেলাধুলা , ভ্রমন ও বিভিন্ন সামাজিক সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের ব্যবস্থা করে থাকে।

পরিবার পরিকল্পনার কাজ : আধুনিক সচেতন দম্পতিরা পরিবারের আকারকে সীমিত রাখার জন্য পরিকল্পিত পরিবার গড়ে তোলার সিদ্ধান্ত নিয়ে থাকে। বর্তমানে সচেতন দম্পতিদের কাজের ক্ষেত্রে এই নতুন মাত্রাটি যুক্ত হয়েছে।

পরিবারের ভবিষ্যৎ 


ইউরোপ বা আমেরিকার কোন কোন সমাজবিজ্ঞানী পরিবারের ভবিষ্যৎ সম্পর্কে প্রশ্ন তুলেছেন। তারা মনে করেন পরিবারের কাজগুলো যদি বিকল্প কোন প্রতিষ্ঠান দ্বারা সুসম্পন্ন করা হয় তাহলে পরিবারের অস্তিত্ব বিলুপ্ত হওয়ার সম্ভাবনা দেখা দিতে পারে। 

ভিন্নমত পোষণ করেন যারা তারা বলেন, সমাজ পরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে পরিবারের গঠন, ভুমিকা ও কার্যাবলীতে পরিবর্তন আসতে পারে তবে তাতে পরিবার বিলুপ্ত হওয়ার সম্ভাবনা নাই। করন পরিবারের মনস্তাত্ত্বিক, সামাজিকীকরণ, ধর্মীয় ও সামাজিক নিয়ন্ত্রণমূলক কাজের বিকল্প খুঁজে পাওয়া যায় না। তাছাড়া পরিবারের সদস্যদের মধ্যে যে মানসিক বন্ধন তৈরি হয় তা অন্য কোন সংগঠন বা প্রতিষ্ঠান দ্বারা সম্ভব নয়। পারিবারিক ঐক্য, সংহতি ও সহমর্মিতা বোধ বৃহত্তর সমাজ জীবনের সংহতি ও ঐক্যের স্বার্থেই প্রয়োজন।

পরিবারের ভবিষ্যত সম্পর্কে তিন ধরনের তাত্ত্বিক দৃষ্টিভঙ্গি


রক্ষণশীল দৃষ্টিভঙ্গি : এই দৃষ্টিভঙ্গি অনুযায়ী বলা হয় যে, পরিবার একটি ঐতিহ্যবাহী গুরুত্বপূর্ণ সামাজিক প্রতিষ্ঠান। এই প্রতিষ্ঠানের বিলুপ্তি মানব সমাজের জন্য কোন শুভকর হবে না। এতে সমাজ জীবনে এক বিরাট ভারসাম্যহীনতা এবং সংকট তৈরি হবে। এই সংকট নিরসনের কোন বিকল্প ব্যবস্থা অদ্যবধি কারো জানা নাই।

চরমপন্থী দৃষ্টিভঙ্গি : একদল সমাজবিজ্ঞানীর মতে, পরিবারের অস্তিত্ব বিলুপ্ত হবে এবং সেটাই কাম্য। এরা পরিবারের গুরুত্বকে অস্বীকার করে থাকে। গ্রীক দার্শনিক, প্লেটো, দার্শনিক রাজা এবং সৈনিক শ্রেণীর জন্য পরিবারের প্রয়োজনীয়তা অস্বীকার করেন। কেননা এই শ্রেণীদের পরিবার ও ব্যক্তিগত সম্পত্তি থাকলে তারা নিজেরা স্বার্থপর হয়ে উঠবে এবং সমাজের কল্যাণে তেমন অবদান রাখতে পারবে না।

উদারনৈতিক দৃষ্টিভঙ্গি : উদারনৈতিক দৃষ্টিভঙ্গি অনুযায়ী পরিবার আর সব প্রতিষ্ঠানের মতই স্ব স্ব ভূমিকা পালন করার মাধ্যমে তার প্রয়োজনীয়তা বজায় রেখে চলেছে। এই দৃষ্টিভঙ্গীতে বলা হয় যে,পরিবারকে টিকিয়ে রাখা বা বিলোপ করার জন্য কোন প্রয়াসের প্রয়োজন নেই। পরিবারের বিকল্প অন্য কোন প্রতিষ্ঠান যদি পরিবারের কাজ গুলো সঠিকভাবে করে দিতে না পারে তবে পরিবার অবশ্যই টিকে থাকবে।

দীর্ঘ অভিজ্ঞতার কষ্টি পাথরে বিচার করে দেখা গেছে যে পরিবারের কোন বিকল্প নাই বা পরিবারের কাজ অন্য কোন প্রতিষ্ঠান দ্বারা সম্ভব নয়। পরিবার তার ভূমিকা ও দায়িত্ব পালনের মাধ্যমে অদ্যাবধি টিকে আছে। আগামীতে পরিবার তার কাঠামো বদলালেও অস্তিত্ব বজায় রাখবে ।

এই পোস্টটি পরিচিতদের সাথে শেয়ার করুন

পূর্বের পোস্ট দেখুন পরবর্তী পোস্ট দেখুন
এই পোস্টে এখনো কেউ মন্তব্য করে নি
মন্তব্য করতে এখানে ক্লিক করুন

অর্ডিনারি আইটির নীতিমালা মেনে কমেন্ট করুন। প্রতিটি কমেন্ট রিভিউ করা হয়।

comment url