সাংস্কৃতিক জীবনের উপর বিভিন্ন ধর্মের প্রভাব

সংস্কৃতি শব্দটির আভিধানিক অর্থ মানবীয় বৈশিষ্ট্যের উৎকর্ষ সাধন। কোন স্থানের মানুষের আচার-ব্যবহার, জীবিকার উপায়, সঙ্গীত, নৃত্য, সাহিত্য, নাট্যশালা, সামাজিক সম্পর্ক, ধর্মীয় রীতি-নীতি, শিক্ষা-দীক্ষা ইত্যাদির মাধ্যমে যে অভিব্যক্তি প্রকাশ করা হয়, তাই সংস্কৃতি।


ইংরেজি Culture- এর প্রতিশব্দ হিসাবে সংস্কৃতি শব্দটি ১৯৯২ সালে বাংলায় প্রথম ব্যবহার শুরু হয়। সংস্কৃতি হল টিকে থাকার এবং পৃথিবীতে মানুষই একমাত্র সংস্কৃতিবান প্রাণী। মানুষের এই কৌশলগুলি ভৌগলিক, সামাজিক, জৈবিকসহ নানা বৈশিষ্ট্যের উপর নির্ভর করে। সময় ও যুগের প্রেক্ষিতে তারা কিছু কৌশল সৃষ্টি করে থাকে। তাই বলা যায় সংস্কৃতি একদিকে যেমন আরোপিত অর্থাৎ উত্তরাধিকারসূত্রে প্রাপ্ত তেমনি তা অর্জিতও বটে।

পৃথিবীতে আবির্ভাবের পর মানুষকে বিভিন্ন সময়ে অনেক প্রতিকুল অবস্থা তথা নানাবিধ চ্যালেঞ্জ মোকাবেলা করতে গিয়ে মানুষ যে সব চিন্তা-ভাবনা করেছে এবং যা কিছু সে উদ্ভাবন করেছে তার সবটাকেই একত্রে বলা হয় সংস্কৃতি। বস্তুত মানুষ তার সব ধরনের দৈহিক ও মানসিক চাহিদা পূরণে যেসব বিষয় এবং বস্তু উদ্ভাবন করেছে তার সবটাই সংস্কৃতির অন্তর্ভূক্ত।

বৃটিশ নৃবিজ্ঞানী টেইলর বলেন, সমাজের সদস্য হিসাবে অর্জিত আচার-আচরণ, ব্যবহার, জ্ঞান, বিশ্বাস, শিল্প-কলা, নীতি-প্রথা, আইন ইত্যাদির জটিল সমাবেশই হল সংস্কৃতি। সমাজবিজ্ঞানী গিলিন ও গিলিন এর মতে সংস্কৃতি বলতে এক দিকে যেমন বস্তুগত আবিস্কারকে বোঝায় তেমনি অন্যদিকে ঐ বস্তুগত আবিস্কারের পেছনে ক্রিয়াশীল চিন্তা-ভাবনা, কৌশল বা জ্ঞানকে বোঝায়।

বস্তুগত সংস্কৃতি ও অবস্তুগত সংস্কৃতি

বস্তুগত সংস্কৃতি : বাস্তব বস্তু যেমন ঘর-বাড়ি, কাপড়-চোপড়, বাসন বা তৈজসপত্র, হাতিয়ার, যন্ত্রপাতি ইত্যাদিকে বোঝায়। কেবল তাই নয়, জ্ঞান ও ধ্যান-ধারণা প্রকাশের জন্য যেসব বস্তু ব্যবহার করা হয় সেটাও বস্তুগত সংস্কৃতির পর্যায়ে পড়ে। যেমন একটি বাড়ি বস্তুগত সংস্কৃতি, কিন্তু বাড়িটি তৈরির প্রাক্কালে যে চিন্তা-ভাবনা এবং পরিকল্পনা করা হয় সেটা অবস্তুগত সংস্কৃতি।

অবস্তুগত সংস্কৃতি : মানুষের ধ্যান ধারণা, চিন্তা-ভাবনা, চলন-বলন-কথন, রীতি-নীতি, তথা মূল্যবোধ, আবেগ-উচ্ছাস ইত্যাদিকে অবস্তুগত সংস্কৃতি বলে। মানুষের সব বিমূর্ত সৃষ্টি যেমন- ভাষা ও সাহিত্য, বিজ্ঞান, আইন, নীতি, আদর্শ ইত্যাদি অবস্তুগত সংস্কৃতির মধ্যে পড়ে। বস্তুগত সংস্কৃতির পেছনে ক্রিয়াশীল চিন্তা-ভাবনা, জ্ঞান এবং কলাকৌশলকেও অবস্তুগত সংস্কৃতি বলে।

মানুষের আবেগ উচ্ছাস, প্রেম ভালবাসা, স্নেহ-আদর, শ্রদ্ধা ইত্যাদির অভিব্যক্তিও অবস্তুগত সংস্কৃতির মধ্যে পড়ে। কোন দেশের সামাজিক, রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ইত্যাদি বিষয়াবলিও অবস্তুগত সংস্কৃতির মধ্যেই পড়ে। সহজ কথায় মানুষের সব ধরনের বস্তুগত আবিস্কার হচ্ছে তার বস্তুগত সংস্কৃতি এবং সবধরনের অবস্তুগত আবিস্কার হচ্ছে তার অবস্তুগত সংস্কৃতি।

বস্তুগত ও অবস্তুগত সংস্কৃতির সাদৃশ্য ও বৈসাদৃশ্য

  • বস্তুগত ও অবস্তুগত উভয় ধরনের সংস্কৃতি মূলত মানবীয় সৃষ্টি ।
  • মানুষের প্রয়োজনের তাগিদে সৃষ্টি হয়।
  • উভয় সংস্কৃতি পরিবর্তনশীল।
  • সমাজবিজ্ঞানী নিমকফের মতে, অবস্তুগত সংস্কৃতির তুলনায় বস্তুগত সংস্কৃতি দ্রুত গতিতে এগিয়ে চলে। এই অসম অগ্রগতির ফলে সমাজে ভারসাম্যহীনতার সৃষ্টি হয়।
  • বস্তুগত সংস্কৃতি যে কেউ গ্রহণ করতে পারে কিন্তু অবস্তুগত সংস্কৃতি সবার কাছে গৃহীত হয় না।
  • বস্তুগত সংস্কৃতির অগ্রগতিকে সহসা পরিমাপ করা যায়। পক্ষান্তরে অবস্তুগত সংস্কৃতি পরিমাপ করা যায় না।

সংস্কৃতি ও সভ্যতার মধ্যে তুলনা

  • সংস্কৃতি হচ্ছে প্রধানত মানুষের অবস্তুগত সৃষ্টি আর সভ্যতা হচ্ছে বস্তুগত সৃষ্টি।
  • সমাজবিজ্ঞানী ম্যাকাইভারের মতে, `Culture is what we are and civilization is what we use or have.' অর্থাৎ আমরা যা সেটাই সংস্কৃতি আর আমাদের যা আছে বা আমরা যা ব্যবহার করি সেটাই সভ্যতা।
  • দার্শনিক কান্ট বলেন সভ্যতা হল মানুষের বাহ্যিক আচরণ আর সংস্কৃতি হচ্ছে মানুষের ভেতরের দিক।
  • সভ্যতা বাহ্যিক বলেই তা যান্ত্রিক। আর সংস্কৃতি মনোজগতের বা ধ্যান-ধারণার বিষয়।
  • ম্যাথিউ আরনল্ডের মতে, সংস্কৃতি হচ্ছে খাঁটি হওয়া বা মার্জিত হওয়া আর সভ্যতা হচ্ছে কোন কিছু থাকা বা অর্জন করা।
  • সভ্যতার ক্ষেত্রে একজন আর একজনের কাজ করে দিতে পারে আর সংস্কৃতির ক্ষেত্রে তা সম্ভব নয়।
  • সংস্কৃতিকে পরাজিত করা যায় না কিন্তু সভ্যতাকে ধ্বংস করা যায়।

বাংলাদেশের মানুষের সংস্কৃতি

ব্যপক অর্থে সংস্কৃতি হল জীবন ধারণের পদ্ধতি ( Way of life) । তাই বাংলাদেশের মানুষের সংস্কৃতি জানতে হলে প্রথমেই জানা দরকার এদেশের মানুষের জীবন ধারণের পদ্ধতি। বংলাদেশের প্রায় ৮৫ ভাগ মানুষ গ্রামে বাস করে। প্রায় সকল গ্রামবাসী প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে কৃষির সাথে জড়িত। কৃষিই তাদের জীবিকার প্রধান উৎস। নগরে সরকারি-বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে চাকরি এবং ব্যবসা-বাণিজ্যেই অধিকাংশ লোক কাজ করে।

বাংলাদেশের অধিকাংশ অঞ্চলের মানুষ লুঙ্গি, পাজামা-পাঞ্জাবী ও ফতুয়া পরিধান করে এবং গামছা ব্যবহার করেন। বিশেষ বিশেষ অনুষ্ঠানে লুঙ্গির সাথে পাঞ্জাবী, গেনজী এবং পূজা পার্বনে হিন্দুদেরকে ধুতি পরতে দেখা যায়। নগরে শার্ট-প্যান্ট এর ব্যবহারই বেশি।

অঞ্চলভেদে ঘর-বাড়ির ভিন্নতা থাকলেও সাধারণত বাঁশ, বেত ও ছন ইত্যাদি ঘর তৈরির কাজে ব্যবহৃত হয়। অবস্থাপন্ন পরিবার টিনের ছাউনিতে বা টিনের ঘরে বা ইটের পাকা বাড়িতে বসবাস করে। দেশের উত্তরাঞ্চলে মাটির দেয়ালের দোতলা বাড়ি ও দেখা যায়। সময়ের ব্যবধানে টিন ও ইটের তৈরি বাড়ি ও বড় বড় পাকা বাড়ির সংখ্যা বেড়েছে।

ভাত, ডাল, শাক-সবজি বাংলাদেশের মানুষের প্রধান খাদ্য। সম্ভব হলে তিন বেলাই ভাত খেতে পছন্দ করে এ দেশের মানুষ। উৎসবে-অনুষ্ঠানে পিঠা পোলাও, মাংস ও পায়েসের আয়োজন করে থাকে। নবান্ন অনুষ্ঠান এখনও পালন করা হয় এবং চিড়া, মুড়ি ও মুড়কির প্রচলন আজও আছে। মাটির চুলায় কাঠ ও খড় দিয়ে রান্না করে মেঝেতে সবাইমিলে বসে খাওয়ার চিরাচরিত দৃশ্য এখনো বিদ্যমান।

শহর অঞ্চলে রুটি/পরোটা, সবজি, ডিম বা জেলির সাথে পাউরুটি দিয়ে নাস্তা করে। উৎসবে পোলাও, রোস্ট, বিরানী, মাংশ ও জর্দার প্রচলন রয়েছে। গ্রাম কি শহর চা পান একটি সাধারণ দৃশ্য।বর্তমানে শহর অঞ্চলে ফাস্ট ফুড ও চাইনিজ রেস্টুরেন্টের সংখ্যা অনেক বৃদ্ধি পেয়েছে।

বাংলাদেশের প্রায় শতকরা ৮০ ভাগ লোক ইসলাম ধর্মের অনুসারী। বাকী প্রায় ১৫ ভাগ হিন্দু এবং অন্যরা বৌদ্ধ ও খ্রিস্টান ধর্মের অনুসারী। মুসলমানরা মসজিদে, হিন্দুরা মন্দিরে, খ্রিস্টনগণ চার্চ এবং বৌদ্ধরা প্যাগোডাতে উপাসনা করেন। মুসলিম প্রধান এ দেশে ধর্মীয় প্রতিষ্ঠান মসজিদ প্রায় সর্বত্রই দেখা যায়। ভিন্ন ধর্মের লোকেরা শান্তিতে ধর্মপালনের পাশাপাশি শান্তিতে বসবাস করে।

বাংলাদেশের অধিকাংশ মানুষের ভাষা বাংলা। তারা এই ভাষায় কথা বলে মনের ভাব প্রকাশ করেন। বাংলা ভাষা সাহিত্য ও সংগীতের রয়েছে এক দীর্ঘ ঐতিহ্য। ১৯৫২ সালে বাংলা ভাষার জন্য এ দেশের তরুণরা প্রাণ দিয়েছিল।অবশেষে বাংলা ভাষা রাষ্ট্র ভাষার মর্যাদা লাভ করে। ভাষা আন্দোলনের শহীদ দিবস ২১ ফেব্রুয়ারি এখন আন্তর্জাতিক ভাষা দিবস হিসাবে পালিত হচ্ছে।

এই দেশের অধিকাংশ লোক বাংলা ভাষাভাষী হলেও অঞ্চলভেদে নিজ নিজ আঞ্চলিক ভাষায় কথা বলে, গান গায়। বিভিন্ন ধরনের পল্লীগীতি, লালন গীতি, ভাটিয়ালী, মুর্শিদি, রবীন্দ্র ও নজরুল গীতি এ দেশের সংস্কৃতির বৈশিষ্ট্য। এছাড়াও বিভিন্ন ধরনের লোকগীতি, লোকনৃত্য, জারি, সারি গানের দেশ এই বাংলাদেশ। বিভিন্ন নৃগোষ্টীর সনাতন গান ও নৃত্য আমাদের সংস্কৃতিকে সমৃদ্ধ করেছে। তাছাড়া পৌষপার্বন, নবান্নের উৎসব, বৈশাখী মেলা গ্রামীন মানুষের জনজীবনে অপার আনন্দ বয়ে আনে। ইদানিং নগর জীবনেও এসব উৎসব ও মেলার আয়োজন সহ পিঠা উৎসব, বৈশাখী মেলা দেখা যাচ্ছে।

বাংলাদেশের সমাজে শিশুরা পারিবারিক, সামাজিক ও ধর্মীয় মূল্যবোধ অনুযায়ী আনুষ্ঠানিক শিক্ষা লাভ করে। গ্রামীন জীবনে মসজিদে-মক্তবে ধর্মীয় শিক্ষা গ্রহণ করে। এরপর পাঁচ বছর হলে স্কুল ও মাদ্রাসায় লেখাপড়ার জন্য যায়। শহর অঞ্চলে সরকারি স্কুলের পাশাপাশি কিন্ডারগার্টেন এবং বেসরকারি অন্যান্য ইংরেজি মাধ্যমের শিক্ষা প্রতিষ্ঠান আছে। কারিগরী ও বৃত্তিমূলক শিক্ষা-প্রতিষ্ঠানে পড়াশুনা করে। শিক্ষার বিভিন্ন পদ্ধতি ও ব্যবস্থাসমূহ পরবর্তীতে শিক্ষার্থীদের জীবনে ভিন্ন ভিন্ন প্রভাব রাখে এবং সামাজিক জীবনে বৈচিত্র আনে।

রোগব্যথি হলে আধুনিক চিকিৎসার পাশাপাশি ঝাঁড়, ফুক, তাবিজ, দোয়া, গাছ-গাছড়া, কবিরাজী চিকিৎসা এবং হোমিও চিকিৎসা গ্রহণ করেন। বিশ্বাস, অর্থ, শিক্ষা ও সচেতনতা দ্বারা নির্ধারিত হয় কে কোন পদ্ধতিতে চিকিৎসা নেন। অনেকেই একাধিক পদ্ধতিরও সাহায্য নেন।

গ্রামাঞ্চলে নানা ধরনের দেশীয় খেলাধুলা যেমন- কাবাডি, বৌচা, দাড়িয়াবান্ধা, গোল্লাছুট এবং বিদেশী খেলার মধ্যে ফুটবল এবং ক্রিকেট সর্বাধিক জনপ্রিয়।

আমাদের রাজনৈতিক সংস্কৃতিতে পরিবর্তন এসেছে। গ্রামীণ ক্ষমতা কাঠামো ও নেতৃত্বের ধরনের মধ্যে পরিবর্তন সূচিত হয়েছে। ঐতিহ্যবাহী পুরানো ক্ষমতা কাঠামো ভেঙ্গে পড়েছে। জমির মালিকানা, ধনসম্পদ, গোষ্ঠী সাহায্য ও সমর্থন, রাজনৈতিক দলের সমর্থন ইত্যাদি এখনও গ্রাম সমাজে ক্ষমতার প্রধান উৎস।

সামাজিক শ্রেণীভেদে জীবন প্রণালিতে পার্থক্য বিদ্যমান। খাদ্য, পোষাক, ঘরবাড়ি, রুচি, আচার-অনুষ্ঠানে এই পার্থক্য সুস্পষ্ট। এ সমাজে উচ্চ বিত্ত, মধ্যত্তি, নিম্ন বিত্ত ইত্যাদি শ্রেণীর মানুষ বাস করে। এই শ্রেণী বিভাজন গ্রাম ও শহরে সর্বত্রই লক্ষ করা যায়। বংশ মর্যাদা কিছুটা হ্রাস পেয়েছে তবে গুরুত্ব একেবারে লোপ পায়নি। বর্তমানে শিক্ষা, অর্থ ও পেশা সামাজিক স্তরবিন্যাসে বিশেষ ভূমিকা রাখছে।

বাংলাদেশের গ্রাম ও শহর জীবনের মধ্যে জীবনযাত্রা প্রণালিতে পার্থক্য রয়েছে। তবে গ্রামীন ঐতিহ্য তথা জীবনপ্রণালির ওপর নগর জীবনের প্রভাব পড়েছে। ফলে গ্রামেও সামাজিক গতিশীলতা বৃদ্ধি পাচ্ছে। গ্রামে বিদ্যুৎ পৌঁছার ফলে টেলিভিশন, রেডিও, টেলিফোন বা মোবাইল এবং ইন্টারনেট সুবিধা বৃদ্ধি পাচ্ছে। ফলে গ্রামের ঐতিহ্যবাহী সংস্কৃতি আজ বিলুপ্তির পথে। বর্তমানে শহর ও গ্রামের পার্থক্য ক্রমশ কমে আসছে। তারপরও গ্রাম ও শহরের সমাজ ও সংস্কৃতিতে একটি ভিন্নতা রয়েছে।

সাংস্কৃতিক জীবনের উপর বিভিন্ন ধর্মের প্রভাব

ধর্ম সংস্কৃতির একটি অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ উপাদান। বাংলার মানুষের সাংস্কৃতিক জীবন ধারায় নানা ধর্ম ও ধর্মীয় বিশ্বাস, আচার-অনুষ্ঠান, প্রতীক-প্রথা এবং নিয়ম-বিধির অনুপ্রবেশ ঘটেছে এবং পরিবর্তিত হয়েছে জীবনাচরণ। একটি স্বতন্ত্র জাতি হিসাবে আত্মপ্রকাশের পর্যায় থেকে আজ পর্যন্ত বাঙ্গালি জনজীবনে মূলত হিন্দু, বৌদ্ধ, ইসলাম ও খৃস্টধর্মের প্রভাব দেখা যায়।

বাংলাদেশের জনগোষ্ঠীর একটি উল্লেখযোগ্য অংশের আদি ধর্ম হচ্ছে হিন্দু ধর্ম। এই ধর্ম বাংলার মানুষের মধ্যে ব্যাপক আকারে বিস্তৃতি লাভ করে আর্যদের আগমনের পর থেকে। আর্যরাই পেশাভিত্তিক হিন্দু বর্ণ প্রথার আবির্ভাব ঘটায়, আর প্রাত্যহিক জীবনে বিভিন্ন আচার ও আচরণ বিধির প্রচলন করে। শাস্ত্রীয় অপবিত্রতা এবং পবিত্রতার ধারণাই ছিল বর্ণপ্রথার ভিত্তি।

বর্ণপ্রথার কঠোরতা উচ্চবর্ণের হিন্দুদের সাথে নিম্নবর্ণের হিন্দুদের দূরত্ব ও বৈষম্য অনেক বাড়িয়ে দিয়েছে। এমনি পর্যায়ে অহিংসা, পরম প্রেম, পরম আত্মত্যাগ, সংযম, নিষ্ঠা ইত্যাদি মর্মবাণী নিয়ে গৌতমবুদ্ধের অনুসারীদের এ অঞ্চলে আগমন ঘটলে দলে দলে নিম্নবর্ণের হিন্দুরা বৌদ্ধ ধর্ম গ্রহণ করে। আর সে সাথে বাংলায় প্রচলিত হিন্দু জীবনাচরণে বৌদ্ধ সংস্কৃতির অনুপ্রবেশ ঘটে। কিন্তু এ অবস্থা দীর্ঘদিন টিকেনি। সামাজিক অত্যাচার ও নিগ্রহের শিকার হয়ে বৌদ্ধ সন্যাসীরা এদেশ ছেড়ে চলে যেতে বাধ্য হন। ফলশ্রুতিতে বৌদ্ধদের আগমনের পূর্বাবস্থা আবার ফিরে আসে।

এমনি এক পর্যায়ে তথা খৃস্টিয় ত্রয়োদশ শতাব্দীর প্রথম দশকের প্রথম দিকে তরুণ মুসলিম সমর নায়ক ইখতিয়ার উদ্দীন মুহাম্মদ বখতিয়ার খলজী বাংলার শেষ হিন্দু রাজা লক্ষণসেনকে পরাজিত করেন এবং এরই পথ ধরে পরবর্তীতে এদেশে বিভিন্ন সুফী-সাধক মানুষে মানুষে সাম্য, ভ্রাতৃত্ববোধ এবং একেশ্বরবাদের বাণী নিয়ে আসেন। বখতিয়ার খলজীর বাংলা বিজয়ের পর হতে জল ও স্থল পথে বিভিন্ন সুফী-সাধক, অলি-আউলিয়া এদেশে ইসলাম প্রচারের উদ্দেশে আসতে থাকেন এবং স্থায়ীভাবে বসবাস করতে থাকেন।

এ সময়ে এখানে বসবাসকারী জনসংখার একটি বিরাট অংশ ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করে। এবং ইসলামী জীবন ব্যবস্থায় অভ্যস্থ হয়ে পড়ে। এদেশের মানুষের অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক আচরণ, শিল্প, সাহিত্য, সংগীত, চিত্রকলার ক্ষেত্রেও ইসলামী ভাবধারার ব্যাপক প্রভাব পড়তে দেখা যায়। ব্যাপক জনগোষ্ঠী তাতে সাড়া দেয়। দীর্ঘকাল ধরে নিম্নবর্ণের উপর চরম বৈষম্যমূলক আচরণ থেকে মুক্তির প্রত্যাশায় দলে দলে এদের অনেকেই ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করতে থাকে। ধীরে ধীরে বাংলা ভাষা, সাহিত্য, চিত্রকলা, স্থাপত্য এবং প্রাত্যহিক কর্মকাণ্ডে ইসলামী মূল্যবোধ ও ভাবধারার সন্নিবেশ ঘটে।

বাংলার মানুষের সাস্কৃতিক জীবনে খৃস্টধর্মের অনুপ্রবেশ ঘটে ষোড়শ সপ্তদশ শতকে জলপথে বাণিজ্য করতে আসা ইউরোপীয় বণিক, ধর্মযাজক ও মিশনারীগণ কর্তৃক। ইংরেজগণ বাংলায় উপনিবেশ বিস্তারের সাথে সাথে খৃস্টধর্ম প্রচারে ব্যাপক উদ্যোগ গ্রহণ করে। তারা সতীদাহ প্রথার উচ্ছেদ ঘটায়, ইংরেজি শিক্ষার পাশাপাশি নারী শিক্ষার প্রচলন করে। স্বয়ংসম্পূর্ণ গ্রাম ব্যবস্থায় ভাঙ্গন এবং বাঙ্গালীর সনাতন গোষ্ঠীবদ্ধ জীবন ধারায় বিভাজনের সৃষ্টি করে।

পরিশেষে বলা যায় ধর্মের বিচারে আমরা কেউ হিন্দু, কেউ মুসলমান, বৌদ্ধ কিংবা খৃস্টান কিন্তু জাতিসত্তার বিচারে আমরা সকলে একই পরিচয়ে পরিচিত। বিভিন্ন ধর্মের মানুষদের মধ্যে ধর্মীয় সম্প্রীতি বিরাজমান। আমরা সবাই একই দেশ এবং বাংলাদেশের নাগরিক, রাষ্ট্রীয়ভাবে আমাদের জাতীয়তাও এক। এদেশের কল্যাণে আমরা সবাই কাজ করে যাব।

এই পোস্টটি পরিচিতদের সাথে শেয়ার করুন

পূর্বের পোস্ট দেখুন পরবর্তী পোস্ট দেখুন
এই পোস্টে এখনো কেউ মন্তব্য করে নি
মন্তব্য করতে এখানে ক্লিক করুন

অর্ডিনারি আইটির নীতিমালা মেনে কমেন্ট করুন। প্রতিটি কমেন্ট রিভিউ করা হয়।

comment url