প্রাচীন সভ্যতা মহাস্থানগড়, ময়নামতি ও পাহাড়পুর



বাংলাদেশের সমাজ ও সংস্কৃতির ইতিহাস বেশ প্রাচীন। সময়ের বিবর্তনে অনেক প্রাচীন জনপদ মানুষ ও সংস্কৃতি এ দেশের বিভিন্ন অঞ্চল থেকে বিলীন হয়ে গেছে। তবে ঐসব সমাজ ও সংস্কৃতির ধ্বংসাবশেষ সম্পর্কে জানতে আজও আমাদেরকে উদ্বুদ্ধ করে।


বর্তমান বাংলাদেশের বেশ কয়েকটি জায়গায় প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শনের কথা জানা যায়। তবে যে সব অঞ্চলে প্রাচীন সভ্যতার ধ্বংসাবশেষ আবিস্কৃত হয়েছে তার মধ্যে বগুড়ার মহাস্থানগড়, কুমিল্লার ময়নামতি এবং রাজশাহীর পহাড়পুুর অন্যতম। এসব ধ্বংসাবশেষের মূল্য অপরিসীম। বাংলাদেশের অতীত সমাজ ও সংস্কৃতি জানতে তথা বর্তমান সমাজকে জানতে ঐসব ধ্বংসাবশেষ গুলোর গুরুত্ব অপরিসীম।

প্রত্নতত্ত্বের অধ্যায়নের মূল বিষয়গুলো হলো- ভৌত ধ্বংসাবশেষ, পরিবেশগত তথ্য, জীবাশ্ম, প্রাকৃতিক- সাংস্কৃতিক ভূদৃশ্যাবলী ইত্যাদি। আর প্রত্নতত্ত্বের কাজ হল এইসব বিষয়কে বিশ্লেষণ করে প্রাচীনকালের মানুষ এবং পরিবেশ ও প্রকৃতির তৎকালীন চিত্র বোঝা এবং তার মাধ্যমে ভবিষ্যতের মানুষ এবং পরিবেশের রুপরেখা নির্মাণ করা। প্রত্নতত্ত্ব প্রধানত ইতিহাস ও পরিবেশ বিজ্ঞানের এক সহযোগী।

প্রাচীন কালের জিনিসপত্র, মূদ্রা, অট্টালিকা ইত্যাদি বিচার করে এবং ইতিহাস খুঁজে যা বের করা হয় বা যে ভাবে বের করা হয় তাকে বলে প্রত্নতাত্ত্বিক। খৃস্টপূর্ব ৫৫৬- ৫৩৯ অব্দে বেবিলনের সিপপুরে সামাথ নামক একটি ধ্বংসপ্রাপ্ত মন্দিরের খনন কাজই পৃথিবীর প্রথম বলে মনে করা হয়। খৃস্টপূর্ব ৪৬০-৩৮৬ অব্দে এথেন্সের প্রত্নতাত্ত্বিকরা দেলস এর ঈজিয়ান দ্বীপের প্রাচীন সমাধিগুলোতে খনন পরিচালনা করেন।

খৃস্টপূর্ব ৯৯-৫৫ অব্দে এবং চীনা দার্শনিক ইউয়ান কং খৃ্স্টিয় প্রথম শতাব্দীতে চীনাদের প্রত্ননিদর্শন সংরক্ষনের এই চর্চা এবং এই নিদর্শনগুলোর বিশ্লেষণ করে প্রাচীন চীনা সংস্কৃতির রুপরেখা উপস্থাপনের চেষ্টা করেন। ভারতে সুলতানী শাসনামলে প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শন সংগ্রহ ও এর ভিত্তিতে ইতিহাস চর্চার সূচনা হয়। মুহম্মদ বিন তুঘলক ব্যাপক প্রত্নতাত্ত্বিক অনুশীলন করেন।

চতুর্দশ শতক থেকে ইউরোপের রেনেসাঁ পর্বে অভিজাতদের মধ্যে প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শন সংগ্রহের প্রবণতা বৃদ্ধি পায়। ফলে প্রত্নতাত্ত্বিক ও প্রত্ন-লুটেরা উভয়েই মূলত যে কোনো উপায়ে প্রত্ন নিদর্শন সংগ্রহ করার জন্য উৎসাহী হয়ে উঠে। মিশরের পিরামিড ও ইউরোপের প্রাচীন সমাধিগুলোতে প্রত্নচর্চার নামে এক ধ্বংসযজ্ঞ পরিচালনা করা হয়।

এই প্রথায় প্রথম বিপরীতমুখী প্রয়াস চালান ইংরেজ গবেষক জন লিল্যান্ড। ১৫৩৩ থেকে ১৫৪৭ সাল পর্যন্ত তিনি প্রাচীন নথীপত্র সংগ্রহ, সংরক্ষণ ও গবেষণায় নিয়োজিত থাকেন। অপর ইংরেজ গবেষক ইউলিয়াম কার্ডেন ১৫৮৬ সাল থেকে ইংল্যান্ডের প্রাচীন নিদর্শনসমূহের এক বিস্তারিত তালিকা প্রণয়ন করেন যা ‘ব্রিটানিয়া’ নামে প্রকাশিত হয়। ১৮৬০ খৃস্টাব্দে ব্যাপক উৎসাহ ও উদ্দীপনা নিয়ে পম্পেই ও হারকুল্যুনেউম-এ প্রত্নতাত্ত্বিক খনন শুরু হয়। এবং এইবার প্রত্নতাত্ত্বিকরা উক্ত প্রত্নস্থলের মানুষের জীবনপ্রণালী ব্যাখ্যায় অগ্রগতি লাভ করেন। এই সাফল্য দেশ-বিদেশের প্রত্নতাত্ত্বিকদের মধ্যে উৎসাহের সূচনা করে।

বাংলাদেশের তিনটি প্রাচীন সভ্যতা মহাস্থানগড়, ময়নামতি ও পাহাড়পুর সম্পর্কে আলোচনা করা হল।

প্রাচীন সভ্যতার নিদর্শন মহাস্থানগড়

মহাস্থানগড় বাংলাদেশের একটি অন্যতম প্রাচীন পুরাকীর্তি। বৌদ্ধ ও হিন্দু সভ্যতার ধ্বংসাবশেষ। এই নগরী ইতিহাসে পুন্ড্রবর্ধন বা পুন্ড্রনগর নামেও পরিচিত ছিল। একসময় মহাস্থানগড় বাংলার রাজধানী ছিল। প্রায় আড়াই হাজার বছর পূর্বে এখানে সভ্য জনপদ গড়ে উঠে। ২০১৬ সালে এটিকে সার্কের সাংস্কৃতিক রাজধানী হিসাবে ঘোষণা করা হয়।

অবস্থান ও সময়কাল : বাংলাদেশের বগুড়া জেলা শহর থেকে ৮ মাইল উত্তরে মহাস্থানগড় অবস্থিত। অন্যতম প্রাচীন নগরী মহাস্থান গড়ের দৈর্ঘ ৫০০০ ফুট এবং প্রস্থ ৪৫০০ ফুট। চার পাশের সমতল ভূমি থেকে এ উচ্চতা প্রায় ১৫ ফুট। এই প্রাচীন নগরীর বাইরে ৫ মাইল পর্যন্ত শহরতলী এলাকা ছিল বলে অনুমান করা হয়েছে। খৃস্টপূর্ব তৃতীয় শতাব্দী থেকে খৃস্টিয় ১৫শ শতাব্দী পর্যন্ত এই নগরী প্রাণচাঞ্চল্যে ভরপুর ছিল।

বস্তুত এখানেই মৌর্য, গুপ্ত, পাল ছাড়াও আরো কতিপয় হিন্দু সামন্ত রাজবংশের প্রাদেশিক রাজধানী ছিলো। অনুমান করা হয়েছে যে, আর্য আগমনের পূর্বে এখানে পুণ্ড্র নামের আদিবাসীরা বাস করত। তবে এদের সম্পর্কে তেমন কিছু আজ আর জানা যায় না।

নামকরণ : মহাস্থান বলতে বিখ্যাত বা মহান জায়গা বোঝায়। মহাস্থানের নামকরণ সম্পর্কে কয়েকটি মত পাওয়া যায়। যেমন- কারো কারো মতে এর আসল নাম ‘মহাস্নান’ বা বিখ্যাত স্নানস্থান। অর্থাৎ মহাস্নান থেকে মহাস্থানগড়ের নামের উৎপত্তি। কেউ কেউ বলেন এর নাম মস্তান গড়। একটি কিংবদন্তী অনুযায়ী স্থানীয় ক্ষত্রীয় নরপতি পরশুরামকে পরাজিত করে শাহ সুলতান বলখী মাহীসওয়ার নামের এক আওলিয়া সেখানে ইসলামের বিজয় পতাকা উত্তোলন করেন।

এই আওলিয়ার মাজার মহাস্থানের দক্ষিণ-পূর্ব কোনে অবস্থিত। কেউ কেউ মনে করেন বাংলাদেশের ফকির সম্প্রদায়ের এক দলপতির উপাধির নামে মস্তান গড় রাখা হয়। বস্তুত নামকরণের সঠিক ইতিহাস এখনো অজানা।

মহাস্থানগড়ের প্রধান প্রধান প্রত্নতাত্ত্বিক ধ্বংসাবশেষ


বৈরাগীর ভিটা : মহাস্থানগড়ের এই ধ্বংসস্তুপের মধ্যে পাল আমলের দুটি মন্দির আবিস্কৃত হয়েছে। বৈরাগী ভিটা স্তুপটি ৩০০ ফুট দীর্ঘ এবং ২৬ ফুট প্রস্থ। চারদিকের সমতল ভূমি থেকে উচ্চতা ১০ ফুট। মন্দীরগুলো ছিল কারুকার্য খচিত ইট নির্মিত যা সহসাই অনেকের দৃষ্টি আকর্ষণে সক্ষম হয়।

গোবিন্দ ভিটা : গোবিন্দ ভিটা ছিলো মহাস্থান দূর্গপ্রাচীরের বহির্দেশে উত্তর পার্শ্বে অবস্থিত। এটা খৃস্টপূর্ব ৬ষ্ঠ বা ৭ম শতকে গুপ্তামলে গড়ে তোলা হয়। গোবিন্দ ভিটার মন্দিরের কেন্দ্রস্থলে ছিল বেদী। গোবিন্দ ভিটা প্রাচীন বাংলার অন্যতম কারুকার্য খচিত স্থাপত্যের নিদর্শন।

খোদাই পাথর ভিটা : এটার স্থানীয় নাম খোদার পাথর টিবি। তবে পুর্বে এর নকশা দেখে নামকরণ করা হয়েছিল খোদাই পাথর টিবি বলে। মূলত এটা হচ্ছে বৌদ্ধ মন্দিরের এক ধ্বংসাবশেষ যা ছিল পূর্বমুখী। গোটা মন্দিরটি অবশ্য ২৪ ফুট দৈর্ঘ এবং প্রস্থ ১৫ ফুট আয়তনের। এর মাঝে যে পাথরের আবিস্কার হয় তার আয়তন ৯ ফুট-৪ ইঞ্চি, ২ ফুট ৪ ইঞ্চি × ২ ফুট ৫ ইঞ্চি। খোদাই পাথর ভিটার বৌদ্ধ মন্দির দেখে অনুমান করা চলে যে, এখানে এককালে বৌদ্ধ সমাজ ও সংস্কৃতির প্রভাব ছিল।

পরশুরামের প্রাসাদ ও সভাবাটী : এই প্রাচীন প্রাসাদের আয়তন ২০০ ফুট × ১০০ ফুট। কথিত আছে যে এটা হচ্ছে মহাস্থানের সর্বশেষ হিন্দু নৃপতি পরশুরামের রাজ প্রাসাদের ধ্বংসাবশেষ। খোদাই পাথর ভিটা থেকে যে বিস্তৃত রাস্তাটি মথুরা গ্রাম ও বসুবিহার পর্যন্ত প্রসারিত তারই পার্শ্বে অবস্থিত পরশুরামের সভাবাটি। কথিত আছে এখানেই পরশুরাম তার রাজসভার কাজ পরিচালনা করতেন। পরশুরাম ছিলেন হিন্দু নৃপতি। তাই ঐ সময়ের মহাস্থানগড়ে হিন্দু সমাজ ও সাংকৃতিক প্রভাব থাকা অস্বাভাবিক নয়।

শীলাদেবীর ঘাট : কথিত আছে যে, মহাস্থানগড়ের সর্বশেষ হিন্দু নৃপতি পরশুরামের শীলাদেবী নামে পরমা সুন্দরী এক কন্যা ছিলেন। তথায় আগত মুসলমানগণ যখন সুলতান বলখী মাহীসওয়ারের নেতৃত্বে রাজা পরশু রামকে পরাজিত ও নিহত করে দূর্গ দখল করে তখন শীলাদেবী মুসলমানদের হাতে বন্দি হন। তবে তিনি নাকি বিজয়ী মুসলমান দরবেশকে ছুরিকাঘাতে হত্যা করে করতোয়া নদীতে আত্মবিসর্জন দেন।

যে স্থানে শীলাদেবী নদীতে ঝাপ দিয়ে আত্মহত্যা করেন সেটাই শীলাদেবীর ঘাট নামে পরিচিত। ঘাটটি মহাস্থানগড় থেকে ২০০ গজ পূর্বে টবেরাগী ভিটার বিপরীত দিকে অবস্থিত।

লক্ষীন্দরের মেধ : বাংলাদেশের অন্যতম চিত্তাকর্ষক লোক-কাহিনীর নায়ক-নায়িকা বেহুলা লক্ষীন্দরের নামে একটি ধ্বংসস্তুপের এমন নামকরণ করা হয়েছে। মূল মহাস্থানগড় থেকে এক মাইল দক্ষিণ-পশ্চিমে এবং গোকুল গ্রামের পশ্চিমে প্রায় ৪৩ ফুট উচুঁ এক টিবির ওপরই মেধ মন্দিরটি অবস্থিত। ধ্বংসাবশেষ দেখে অনুমান করা হয়েছে যে, এটা বৌদ্ধদের একটি কেন্দ্রীয় উপাসনালয় ছিল।

এর মধ্যে এক নরকঙ্কালও পাওয়া যায় যা কোন এক সন্যাসীর কঙ্কাল বলে অনুমান করা হয়েছে। এখানে একটি গর্তের মধ্যে ১ বর্গ ইঃ একটি স্বর্ণপাত পাওয়া গেছে যাতে ষাঁড়ের প্রতিকৃতি অঙ্কিত। এটা দেখে অনুমান করা হয়েছে যে মন্দিরটি সম্ভবত কোন সময়ে শিব মন্দির ছিল। মহাস্থানগড়ের ধ্বংসাবশেষ যে বাংলাদেশের সমাজ ইতিহাসের গুরুত্বপূর্ণ উৎস উপাদান হতে পারে এতে কোন সন্দেহ নাই।

তবে এলাকাটিতে পরিকল্পিতভাবে খনন কাজ পরিচালনা করা হয়নি। প্রায়ই অনুমান এবং লোক কাহিনীর সাহায্যে ঐসব ধ্বংসাবশেষের ব্যাখ্যা দেওয়ার চেষ্টা করা হয়েছে। এতদসত্ত্বেও মহাস্থানগড় সম্পর্কে যে সব বর্ণনা লিপিবদ্ধ হয়েছে তাতে মনে হয়- ঐ এলাকায় বৌদ্ধ ও হিন্দু সমাজ ও সংস্কৃতির প্রভাব ছিল। কেননা মহাস্থানগড়ের ধ্বংসাবশেষ দেখে অনেকেই সেখানে কতিপয় বৌদ্ধ ও হিন্দু মন্দিরের সন্ধান পেয়েছে।

পরবর্তীতে এ অঞ্চলটি আগত মুসলমানদের দখলে আসে এবং হিন্দু-বৌদ্ধ সংস্কৃতির স্থলে মুসলিম সংস্কৃতির গোড়া পত্তন হয়। এছাড়া মহাস্থানগড়ের লয়-প্রাপ্তির অন্য কোন কারণ আছে কিনা তা স্পষ্টভাবে বলা যায় না।

প্রাচীন সভ্যতার নিদর্শন ময়নামতি

বাংলাদেশের ময়নামতি কুমিল্লায় অবস্থিত একটি ঐতিহাসিক স্থান। ময়নামতির পূর্বনাম রোহিতগিরি। এযাবৎ আবিস্কৃত লালমাই অঞ্চলের প্রাচীনতম সভ্যতার নিদর্শন হল ময়নামতি প্রত্নস্থল। বর্তমানে ময়নামতি অঞ্চলে যে ধ্বংসস্তুপ দেখা যায় তা প্রকৃতপক্ষে একটি প্রাচীন নগরী ও বৌদ্ধ বিহারের অবশিষ্টাংশ।

অবস্থান ও সময়কাল : কুমিল্লা জেলা শহরের পাঁচ মাইল পশ্চিমে ময়নামতি অবস্থিত। সেখানে উত্তর-দক্ষিণ বরাবর প্রায় ১১ মাইল ব্যাপী ময়নামতি-লালমাই পাহাড়ি অঞ্চলে বাংলাদেশের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শন আবিস্কৃত হয়েছে। খৃস্টিয় অষ্টম থেকে দ্বাদশ শতাব্দী পর্যন্ত এ অঞ্চলটিতে প্রধানত বৌদ্ধ ধর্ম তথা বৌদ্ধ সংস্কৃতি ও সভ্যতার বিকাশ ঘটে। যদিও এখানকার পাহাড়গুলোর গড় উচ্চতা ৫০ ফুট তথাপি ১০০ ফুটেরও অধিক উচ্চ পাহাড়ও এখানে দেখা যায়।

নামকরণ : প্রায় ১১ মাইল পাহাড় শ্রেণীর সন্নিকটে ময়নামতি নামের এক গ্রামের নামানুসারে উত্তরাঞ্চলের নাম ময়নামতি। পাহাড়গুলোর দক্ষিণাংশের নাম লালমাই যার শব্দগত অর্থ লালমাটির পাহাড়। বস্তুত উত্তর-দক্ষিণে ১১ মাইল ব্যাপী পাহাড়ী এলাকাটি ময়নামতি গ্রামের নামানুসারেই নামকরণ করা হয়েছে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ চলা কালে এখানে বৃটিশ আর্মিরা দীর্ঘদিন বসবাস করেছিল। ময়নামতির ধ্বংসাবশেষটি সর্বপ্রথম বৃটিশ সামরিক ঠিকাদারের চোখে পড়ে। এবং ধ্বংসাবশেষের অনেক ইট অদুরে সামরিক কর্মকর্তাদের আবাস নির্মাণে ব্যবহৃত হয়।

ময়নামতির প্রধান প্রধান প্রত্নতাত্ত্বিক ধ্বংসাবশেষ

শালবন বিহার : কুমিল্লা শহর থেকে ৬ মাইল পশ্চিমে ময়নামতি লালমাই পাহাড় শ্রেণীর মাঝামাঝি এলাকায় শালবন ঘেরা যে প্রত্নতাত্ত্বিক ধ্বংসাবশেষ আবিস্কৃত হয়েছে তার নাম শালবন বিহার। অদুরেই শালবন পুর নামের এক গ্রামের নামানুসারে এই নাম। বস্তুত এটা এক বিরাটাকার বৌদ্ধ বিহার যার আয়তন ৫৫০ ফুট × ৫৫০ ফুট। বৌদ্ধ বিহারের ভিক্ষুদের বসবাসের জন্য ১১৫ টি কক্ষের ও ধ্বংসাবশেষ চিহ্নিত করা গেছে।

কক্ষগুলি মন্দিরকে চারদিক থেকে ঘিরে রেখেছে। আকারে ছোট হলেও শালবন বিহারটি রাজশাহীর পাহাড়পুর বিহারের সঙ্গে তুলনা করা চলে। বিহারটির উত্তর দিকে একটি প্রবেশ পথ আছে যেটি বাইরের সঙ্গে সংযুক্ত করেছে। ভিক্ষুদের ঘরগুলোর সামনে বেশ চওড়া বারান্দা এবং বিহারের অভ্যন্তরে এক বিরাটাকার হল ঘরে যেতে প্রকাণ্ড সিঁড়ি আছে। ভিক্ষুদের ঘরগুলো দৈর্ঘ-প্রস্থ ১২ ফুট স্কয়ার বিশিষ্ট। কক্ষগুলোর দেয়াল বেশ চওড়া।

কক্ষগুলিতে দেব-দেবীর মূর্তি, প্রদীপ এবং লেখাপড়ার জিনিস ইত্যাদি রাখা হত বলে অনুমান হরা হয়। বিহারর মধ্যস্থলে কারুকার্য খচিত ইটের তৈরি ক্রুশাকার প্রধান মন্দিরটি অবস্থিত। এর পরিকল্পনা এবং স্থাপত্য শিল্প অবলোকনে অনেকেই চমৎকৃত হন।

কোটিলা মুড়া : শালবন বিহার থেকে তিন মাইল উত্তরে ক্যান্টনমেন্ট এলাকায় আবিস্কৃত ধ্বংসাবশেষটির নাম কোটিলা মুড়া। এখানকার বিশেষ আকর্ষণ হচ্ছে পাশাপাশি অবস্থিত তিনটি প্রধান স্তুপের ভগ্নাংশ। এই তিনটি স্তুপকে বৌদ্ধ ধর্মের তিনটি মূল দার্শনিক ধারণার প্রতীকরূপে কল্পনা করা হয়েছে। যেমন- বুদ্ধ বা জ্ঞান, ধর্ম বা ন্যায় এবং সংঘ বা শৃঙ্খলা। স্তুপগুলোর এ ধরনের ধর্মীয় তাৎপর্য দেখে মনে হতে পারে যে, বাংলার এ অঞ্চলে বৌদ্ধ ধর্ম, দর্শন ও সংস্কৃতির বেশ প্রভাব ছিল।

আনন্দ বিহার : ময়নামতিতে যে সব বৌদ্ধ ধ্বংসস্তুপ আবিস্কৃত হয়েছে তার মধ্যে আনন্দ বিহারই সর্ববৃহৎ। এই বিহারটি যে টিবিতে অবস্থিত তাকে স্থানীয়ভাবে আনন্দ রাজার বাড়ি বলেই সবাই জানে। তবে অনুমান করা হয়েছে যে, অষ্টম শতকের দেব বংশীয় প্রভাবশালী রাজা আনন্দ দেবই শালবন বিহারের দুই মাইল উত্তরে এই আনন্দ বিহার নির্মাণ করেন। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় এখানে বৃটিশ সৈন্যরা অবস্থান করছিল।

শালবনের অনুকরণে আনন্দ বিহার তৈরির ঘটনা এটাই প্রমান করে যে, তখন বাংলার এই অঞ্চলে বৌদ্ধ ধর্মের শক্তিশালী পৃষ্টপোষক ছিল এবং বৌদ্ধ ধর্মের ব্যাপ্তি ও প্রসারের অনুকুলে সমাজপতিরা কাজ করেছিল।

আবিস্কৃত প্রাচীন নিদর্শনাবলী

ময়নামতিতে প্রত্নতাত্ত্বিক খনন কাজ হতে যে সব প্রাচীন সম্পদ আবিস্কৃত হয়েছে তা বাংলার সামাজিক, রাজনৈতিক অবস্থা এবং জনজীবনের একটি চিত্র ফুটে উঠে। ময়নামতিতে আবিস্কৃত প্রাচীন সম্পদের মধ্যে আটখানা তাম্রশাসন, স্বর্ণমূদ্রা ও অলংকার, বহু রৌপ্যমুদ্রা, ব্রোঞ্জ স্বারক, ব্রোঞ্জ নির্মিত বুদ্ধ মূর্তি, পোড়ামাটির ফলক চিত্র, কারুকার্যখচিত ইট, পাথর, তামার পাত্র এবং দৈনন্দিন জীবনের ব্যবহার্য দ্রব্য সামগ্রীর নাম উল্লেখযোগ্য।

তাম্র শাসনগুলোতে স্থানীয় রাজাদের ক্ষমতা ও মর্যাদার প্রতিকৃতি, ভূমিদানের বিবরণ ইত্যাদি উল্লেখ আছে। ময়নামতিতে স্বর্ণ ও রৌপ্য মিলে মোট ২২৭ টি মুদ্রা আবিস্কৃত হয়। কোন কোন মুদ্রার গায়ে ষাড়ের চিহ্ন, কোনটার গায়ে ধর্মবিজয়, ললিতাকর লেখা ছিল। মুদ্রার বিপরীত দিকে চদ্র ও সূর্যের প্রতীক অঙ্কিত ছিল। ১৫ টির ও বেশী বৌদ্ধ দেব-দেবীর ব্রোঞ্জমূর্তি আবিস্কৃত হয়েছে।

খৃস্টিয় অষ্টম থেকে দ্বাদশ শতাব্দীতে বাংলার এ অঞ্চলে বৌদ্ধ সভ্যতার উদ্ভব, বিকাশ ও পতন ঘটে তারই এক প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শন হচ্ছে ময়নামতি।

ময়নামতি বৌদ্ধ সভ্যতার পতন

বৌদ্ধ সভ্যতার প্রকৃত কারণ জানা যায় নি। তবে অনুমান করা হয়েছে যে, বাংলার ব্রাহ্মণ ধর্মের পুনর্জাগরণের সময় এই বৌদ্ধ সভ্যতা রাজকীয় পৃষ্ঠপোষকতা হারিয়ে ধীরে ধীরে ধ্বংসের মুখে এগিয়ে যায় এবং জনশূণ্য হয়ে পরিণামে এক বিরাট ধ্বংসস্তুপে পরিনত হয়। ইতোমধ্যে আবিস্কৃত তথ্য যদি সঠিক হয় তবে বৌদ্ধ সভ্যতার ইতিহাসে ময়নামতির ধ্বংসাবশেষ এক গুরুত্বপূর্ণ প্রামান্যচিত্র হিসাবে স্বীকৃত থাকবে।

ময়নামতির বৌদ্ধ সভ্যতার যুগে সমাজ ও সংস্কৃতি ছিল ধর্ম প্রভাবিত। কেননা ধ্বংসাবশেষ থেকে মন্দির ও বিহারই বেশি আবিস্কৃত হয়েছে এবং স্থানীয় নৃপতিরা মন্দির তৈরিতে অবদান রেখেছেন। মুদ্রা আবিস্কারের ফলে বুঝা যায় ক্রয়-বিক্রয়ে মুদ্রার ব্যবহার হত। অর্থাৎ মুদ্রা অর্থনীতির প্রচলন শুরু হয়েছিল। রাজার ভূমিদান ক্ষমতাতে বুঝা যায় ভূমিতে ব্যক্তি মালিকানা ছিল। তার মানে সমাজে অসমতা ও ছিল। এভাবেই প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শনাবলি সমাজ ইতিহাস সম্পর্কে আমাদের গুরুত্বপূর্ণ তথ্য প্রদান করতে সাহায্য করে।

প্রাচীন সভ্যতার নিদর্শন পাহাড়পুর

রাজশাহীর পাহাড়পুর বাংলাদেশের বৌদ্ধবিহার বা সোমপুর বিহার বা সোমপুর মহাবিহার বর্তমানে ধ্বংসপ্রাপ্ত একটি প্রাচীন বৌদ্ধ বিহার। বৌদ্ধ ও হিন্দু সংস্কৃতির এক আকর্ষণীয় নিদর্শন। ১৮৭৯ খৃস্টাব্দে স্যার আলেকজান্ডার কানিংহাম এই বিশাল স্থাপনা আবিস্কার করেন। ইউনেস্কোর মতে পাহাড়পুর বিহার বা সোমপুর বিহার দক্ষিণ হিমালয়ের বৃহত্তম বৌদ্ধ বিহার। এটি ৩০০ বছর ধরে বৌদ্ধদের অতি বিখ্যাত ধর্ম শিক্ষাদান কেন্দ্র ছিল।

শুধু উপমহাদেশ থেকে নয় বরং চীন, তিব্বত, মায়ানমার, মালয়েশিয়া, ইন্দোনেশিয়া প্রভৃতি দেশের বৌদ্ধরা এখানে ধর্মজ্ঞান অর্জন করতে আসতেন। ১৯৮৫ সালে ইউনেস্কো এটিকে বিশ্ব ঐতিহ্যবাহী স্থানের স্বীকৃতি প্রদান করেন।

অবস্থান ও সময়কাল : জালালগঞ্জ রেলস্টেশন থেকে তিন মাইল পশ্চিমে পাহাড়পুরের ধ্বংসাবশেষ। বগুড়ার মহাস্থানগড় থেকে ২৯ মাইল উত্তর-পশ্চিমে এই পাহাড়পুর অবস্থিত। পাল রাজত্বের প্রথম দিকে ৮ম শতাব্দীতে ধর্মপাল পিতৃভূমি বরেন্দ্রে এক বিশাল ও সুউচ্চ মন্দির স্থাপনের লক্ষ্যে পাহাড়পুরের সোমপুর বিহার নির্মাণ করেন বলে অনুমান করা হয়েছে।

সপ্তম শতাব্দীর মাঝামাঝিতে চীনা পর্যটক উয়ান চোয়াং বাংলার অন্যান্য প্রসিদ্ধ বৌদ্ধ, জৈন ও ব্রাহ্মণ ধর্মকেন্দ্রগুলোর বর্ণনা দিয়েছেন। অথচ সোমপুর বিহার উল্লেখ করেন নি। তাই বলা হয় ৮ম শতাব্দীতে ধর্মপাল কর্তৃক নির্মিত বলেই যুক্তি দেয়া হয়। পাহাড়পুরের বৌদ্ধ ও হিন্দু সংস্কৃতির এখানে মুসলিম আগমনকাল পর্যন্ত (১৩শ শতাব্দ) স্থায়ী বলে অনুমান করা হয়েছে।

নামকরণ : রাজশাহী পাহাড়পুর নামক এক গ্রামের নামেই এই ধ্বংসাবশেষের নামকরণ করা হয়েছে। সমতল পলিমাটির অঞ্চল রাজশাহী অথচ, এই এলাকার ব্যতিক্রম ধর্মী অসমতল এলাকাতে উঁচু পাহাড়ের অস্তিত্ব। তাই ব্যতিক্রম ধর্মী অসমতল এলাকার জন্য পহাড়পুর নামটি গৃহীত হয়েছে বলেই যুক্তি দেয়া হয়েছে।

পাহাড়পুরের প্রধান প্রধান প্রত্নতাত্ত্বিক ধ্বংসাবশেষ

সোমপুর বিহার : প্রত্নতাত্ত্বিক খনন কাজের ফলে পাক-ভারত বাংলা উপমহাদেশে যত বৌদ্ধ বিহার আবিস্কৃত হয়েছে তার মধ্যে পহাড়পুরের সোমপুর বিহারই সবচেয়ে বিশালায়তনের। বিহারটি উত্তর-দক্ষিণে প্রায় ৯২২ ফুট এবং পূর্ব-পশ্চিমে প্রায় ৯১১ ফুট। এর চার পার্শ্বে ১১৭ টি আবাসিক কক্ষ, বিহারে প্রবেশ পথ, ছোট খাট অনেক স্তুপ মন্দির আছে। উঁচু টিবিতে অবস্থিত সোমপুর বিহার মন্দিরটি দৈর্ঘ্যে উত্তর-দক্ষিণে ৩৫৬ ফুট ৬ ইঞ্চি এবং প্রস্থে পূর্ব-পশ্চিমে ৩১৪ ফুট ৩ ইঞ্চি। অনেকের মতে সোমপুর বিহার মন্দিরের পরিকল্পনা ও গঠনাকৃতি দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া বিশেষ করে ইন্দোনেশিয়ার জাভা এবং বার্মার অনেক বৌদ্ধ মন্দিরকে প্রভাবিত করেছে।

স্নানঘাট : সোমপুর বিহার থেকে ১৬০ ফুট দুরে দক্ষিণ-পূর্ব কোণে এই স্নানঘাট। ঘাটের উভয় দিকে দেয়ালে খাড়া ইট ব্যবহার করা হয়েছে যা খুব মজবুত তথা কনক্রীট অবস্থায় দেখা যায়। স্নানঘাটটি প্রায় ১২ পুট প্রশস্থ এবং তা ক্রমশ ঢালু হতে হতে ৪১ ফুট নিচে গিয়ে ঠেকেছে। ঘাটের সিঁড়ির সর্বনিম্ন ধাপটি চুনাপাথর দিয়ে বাঁধানো। খনন কাজের সময় ঘাটের সিঁড়িতে বালুর স্তর দেখে ঐখানে কোন কালে নদীর অস্তিত্ব ছিল বলে মনে করা হয়।

স্নানঘাট সম্পর্কে স্থানীয় রুপকথা হল যে, এই ঘাটে রাজা মহীদলনের কন্যা সন্ধ্যাবতী স্নান করত। এই কন্যা নাকি ঐশ্বরিক উপায়ে সত্যপীরকে গর্ভে ধারণ করে।

গন্ধেশ্বরীর মন্দির : উল্লিখিত স্নানঘাট থেকে ৪০ ফুট দুরে দক্ষিণ-পশ্চিমে অবস্থিত একটি ধ্বংসাবশেষ বা স্থানীয়ভাবে গন্ধেশ্বরীর মন্দির নামে পরিচিত। এতে ব্যবহৃত ইটের কিছু উপাদান দেখে অনুমান করা হয়েছে যে মন্দিরটি এদেশের মুসলমান যুগের প্রথম যুগে নির্মিত হয়েছিল। এর ভিতরে ২২ ফুট × ১২ফুট আয়তনের একটি হল ঘর এবং একদিকে ছোট কক্ষে পূজার স্থান নির্দিষ্ট। হল ঘরের চার পার্শ্বে মূর্তি স্থাপনের ব্যবস্থা ছিল বলেও জানা যায়।

সত্যপীর ভিটা : সোমপুর বিহারের পূর্ব দেয়াল থেকে প্রায় ৪০০ গজ পূর্বে একটি মন্দিরের ধ্বংসাবশেষ পাওয়া গেছে। সত্যপীরের কাহিনী নাকি সাম্প্রতিক কালের। ইতোপূর্বে উল্লিখিত সন্ধ্যাবতীর ঐশ্বরিক উপায়ে এই মুসলমান ফকিরের জন্ম কাহিনীর সত্যতা স্বীকার করা যায় না বলেই নাজিমুদ্দীন আহমেদ তাঁর গ্রন্থ মহাস্থানগড়, ময়নামতি ও পাহাড়পুরে উল্লেখ করেন। তাঁর মতে সত্যপীর ভিটা নামের উদ্ভব মাত্র ১৭শ - ১৮শ শতাব্দে।

প্রত্নতাত্ত্বিক খনন কাজে জানা গেছে এই ভিটা আদতে ছিল একটি বৌদ্ধ মন্দির। এর মধ্যে আট হাত বিশিষ্ট দেবী মূর্তি এবং বৌদ্ধবাণী খোদিত পোড়ামাটির গোল সীল আবিস্কৃত হয়েছে। এই মন্দিরটি আয়তনে ৮ ফুট × ৪৮ ফুট। এতে পূজার স্থান ছাড়াও ছিল একটি হলঘর।

উদ্ধারকৃত প্রাচীন সম্পদ

প্রস্তর মূর্তি : পাহাড়পুরে উদ্ধারকৃত প্রাচীন সম্পদের মধ্যে প্রস্তর মূর্তি অন্যতম। এখানে বৌদ্ধমূর্তি ছাড়াও অনেক হিন্দু দেব-দেবীর মূর্তি পাওয়া গেছে। এতে কি অনুমান করা যায় না যে, এ অঞ্চলে বৌদ্ধ এবং হিন্দু সমাজ ও সংস্কৃতির প্রভাব ছিল ?

পোড়া মাটির ফলক : প্রস্তর মূর্তি ছাড়াও পাহাড়পুরে প্রচুর সংখ্যক পেড়ামাটির ফলক পাওয়া গেছে। কিছু পোড়া মাটির ফলকে বৌদ্ধ ও ব্রাহ্মণ্য দেব-দেবীর চিহ্ন দেখা যায়। একদিকে যেমন বোধিসত্বা, পদ্মাপানি, মঞ্জুশ্রী, তারা ইত্যাদি মহাযানপন্থী বৌদ্ধ দেব-দেবীর মূর্তি পাওয়া গেছে, অন্যদিকে শিব, ব্রহ্ম, বিষ্ঞু গণেশ, সূর্য, প্রভৃতি ব্রাহ্ম দেবতার মূর্তিও মন্দিরে স্থান পেয়েছে।

মুদ্রা : পাহাড়পুরে অসংখ্য মুদ্রা আবিস্কৃত হয়েছে যার প্রায় মুদ্রাই নাকি মুসলিম আমলের। এখানে বাগদাদের প্রসিদ্ধ খলিফা হারুন-অর রশীদের একটি রৌপ্যমুদ্রাও পাওয়া গেছে। তাই অনুমান করা যেতে পারে যে পাহাড়পুর তথা বাংলার সঙ্গে বাগদাদের ব্যবসা ও বাণিজ্যিক সম্পর্ক ছিল। যাহোক, এখানে আবিস্কৃত বেশির ভাগ মুদ্রাই ষোড়শ শতাব্দীর।

তাম্র শিলালিপি : পাহাড়পুরে বেশ কিছু তাম্র ও শিলালিপি আবিস্কৃত হয়েছে। সবচেয়ে প্রাচীন তাম্র লিপিটি ১৫৯ গুপ্তাব্দ বা ৪৭১ খৃস্টাব্দের। লিপিটি পাঠে মনে হয় যে কোন এক ব্রাহ্মণ দম্পতি পূজা ও বিশ্রামাগারের জন্য কিছু ভূমি ক্রয় ও দান করেছেন। অন্তত ৪টি শিলালিপি স্তম্ভ পাওয়া গেছে যা বুদ্ধকে উৎসর্গ করা হয়েছে।

পাহাড়পুরের সমাজ ঐতিহাসিক গুরুত্ব

পাহাড়পুরের প্রত্নতাত্ত্বিক ধ্বংসাবশেষ বাংলার সমাজ ইতিহাসে এক তাৎপর্যপূর্ণ অবদান রাখতে পারে। মহাস্থানগড়ের মতই বৌদ্ধ ও হিন্দু সমাজ ও সংস্কৃতির প্রভাব ছিল। পাহাড়পুরের সভ্যতা কতদিন স্থায়ী হয় তা স্পষ্ট করে বলা যায় না। তবে অনুমান করা হয়েছে যে, খৃস্টিয় ১৩শ শতাব্দীর প্রারম্ভে ইখতিয়ার উদ্ধিন মুহাম্মদ বিন বখতিয়ার খলজির নেতৃত্বে মুসলমানেরা বাংলাদেশ আক্রমন করে এবং তারা তখন সমগ্র উত্তর বঙ্গ দখল করে নেয়।

তখনই হয়ত পাহাড়পুরের প্রাচীন সমাজ ও সভ্যতা ধ্বংসপ্রাপ্ত হয় এবং সে স্থলে হয়ত পরবর্তীতে মুসলিম সমাজ ও সংস্কৃতির বিকাশ ঘটে। পাহাড়পুরের ধ্বংসাবশেষ দেখে মনে হয় যেন সমাজে ধর্মের বেশ প্রভাব ছিল। ধর্মীয় কাজে ব্যক্তি বা নৃপতিদের দানের হাত ছিল সম্প্রসারিত। পাহাড়পুরে প্রাচীন মুদ্রাও আবিস্কৃত হয়। অর্থাৎ মুদ্রা অর্থনীতির বিকাশ ঘটে ফলে সমাজে অসমতা বা স্তরবিন্যাসের সৃষ্টি হয়। তাম্রলিপি ও শিলা লিপিতে ভূমি ক্রয়-বিক্রয়, ভূমিদান ইত্যাদি থেকে মনে করা যেতে পারে যে ভূ-সম্পত্তিতে এক ধরনের ব্যক্তিগত মালিকানা ছিল।

এ কথা বলার অপেক্ষা রাখে না যে বাংলাদেশের সমাজ ইতিহাস রচনায় প্রাচীন সভ্যতা মহাস্থানগড়, ময়নামতি ও পাহাড়পুরের ধ্বংসাবশেষ এক গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে পারে। ঐসব প্রাচীন সভ্যতা থেকে প্রাপ্ত প্রত্নতাত্ত্বিক ধ্বংসাবশেষের সঠিক পাঠোদ্ধার ও বিস্তারিত তথ্য বিশ্লেষণ করে বাংলাদেশের সমাজ ইতিহাস রচনায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে।

এই পোস্টটি পরিচিতদের সাথে শেয়ার করুন

পূর্বের পোস্ট দেখুন পরবর্তী পোস্ট দেখুন
এই পোস্টে এখনো কেউ মন্তব্য করে নি
মন্তব্য করতে এখানে ক্লিক করুন

অর্ডিনারি আইটির নীতিমালা মেনে কমেন্ট করুন। প্রতিটি কমেন্ট রিভিউ করা হয়।

comment url