বাংলাদেশের গারো, চাকমা ও সাঁওতাল সম্প্রদায়
একটি সাধারণ সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য বা বৈশিষ্ট্যের ভিত্তিতে একটি স্বতন্ত্র গোষ্ঠীই হল এথনিক সম্প্রদায়। যাদের একটি নিজস্ব পরিচিতিসহ বৃহৎ কোনো সমাজের উপ-গোষ্ঠী হিসাবে বসবাস করে। বাংলাদেশের গারো, চাকমা ও সাঁওতাল সম্প্রদায় সম্পর্কে আলোচনা করা হল।
বাংলাদেশ দক্ষিণ এশিয়ার একটি ছোট জনবহুল রাষ্ট্র। এ দেশের জনসংখ্যার অধিকাংশ হচ্ছে বাঙ্গালী। এছাড়া অনেকগুলো ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠী আছে। ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীর সংখ্যা প্রায় ১৫ লক্ষাধিক। সমগ্র জনসংখ্যার প্রায় এক শতাংশের মতো। অধিকাংশ নৃগোষ্ঠীদের বসবাস পার্বত্য চট্টগ্রাম, ময়মনসিংহ, সিলেট ও রাজশাহীতে। বাংলাদেশের সর্ব বৃহৎ নৃগোষ্ঠী হল চাকমা।
এছাড়া রয়েছে গারো, মারমা, ম্রো, খেয়াং, চাক, বম, লুসাই, পাংখো, ত্রিপুরা, সাঁওতাল, মনিপুরী ইত্যাদি। বাংলাদেশের অধিকাংশ এথনিক সম্প্রদায় গুলো উপজাতি হিসাবে পরিচিত। তবে অনেকে উপজাতির বদলে এথনিক বা আদিবাসী প্রত্যয়টি ব্যবহার করে থাকেন। নৃগোষ্ঠীর সাথে সম্পর্কিত কিন্তু স্বতন্ত্র আরেকটি ধারণা হল নরগোষ্ঠী (Race), যাতে সাস্কৃতিক অনুসঙ্গের চেয়ে শারীরিক বৈশিষ্ট্যগুলির উপরে বেশী জোর দেয়া হয়।
বাংলাদেশের এই ভূখন্ডে বাঙ্গালী নৃগোষ্ঠীর উদ্ভবের আগে এই অঞ্চলে বিভিন্ন নরগোষ্ঠীর বসবাস ছিল। এই বাংলায় আর্যদের আগমনের পূর্বে অনার্য বা আর্যপূর্ব জনগোষ্টীর বসবাস ছিল। যেমন- নেগ্রিটো, অস্ট্রিক, দ্রাবিড়, মঙ্গোলীয় নরগোষ্ঠী। বাংলা অঞ্চলে প্রথম মানবগোষ্ঠীর আগমন ঘটেছিল নেগ্রিটোদের। এরপর অস্ট্রিকরা এসে নেগ্রিটোদের পরাজিত করে এখানে বসতি স্থাপন করে।
এরপর আগমন ঘটে দ্রাবিড় জনগোষ্ঠীর। দ্রাবিড়দের আগমনের পর মঙ্গোলীয়দের আগমন ঘটে। অষ্ট্রিক ও দ্রাবিড়দের কাছে টিকতে না পেরে মঙ্গোলীয়রা এই অঞ্চল পরিত্যাগ করে। এর পরই পুরা ভারতবর্ষ সহ এই বাংলা অঞ্চলে অর্যদের আগমন ঘটে। পরবর্তীতে আর্য, অস্ট্রিক, দ্রাবিড় এসব নরগোষ্ঠীর সংমিশ্রণে বাঙ্গালী নৃগোষ্ঠীর উদ্ভব হয়। বাংলাদেশের প্রথম আদিবাসী হলো এই অস্ট্রালয়েড বা অস্ট্রিক নরগোষ্ঠীর মানুষেরা।
বর্তমানে সাঁওতাল, কোল, ভিল, ভূমিজ, মুন্ডা, বাঁশফোড়, মালপাহাড়ি, পুলিন্দ, শবর ইত্যাদি নৃগোষ্ঠীর পূর্বপুরুষ হলো এই অস্ট্রিক নরগোষ্ঠী। অর্থাৎ এরাই অস্ট্রিক নরগোষ্ঠীভূক্ত এই বাংলা অঞ্চলের প্রাচীনতম আদিবাসী। নৃগোষ্ঠীর প্রকৃতি নিয়ে এখনও বিশেষজ্ঞ পণ্ডিতদের মধ্যে বিতর্ক চলমান। আদীমবাদীরা নৃগোষ্ঠীগুলিকে একটি বাস্তব ঘটনা হিসাবে গণ্য করেন, যাদের বিভিন্ন বৈশিষ্ট্য প্রাচীনকাল থেকে বর্তমান পর্যন্ত টিকে আছে।
এর বিপরীতে অন্য অনেক পণ্ডিত নৃগোষ্ঠীগুলিকে এক ধরনের সামাজিক নির্মিতি হিসাবে গণ্য করেন, তাদের মতে সমাজের প্রচলিত নিয়ম মেনে ব্যক্তির গায়ে এক ধরনের নৃগোষ্ঠীগত পরিচয় এঁটে দেওয়া হয়। বর্তমানে বাংলাদেশে ২০ টির ও বেশী এথনিক সম্প্রদায় আছে। নিম্নে আমরা গারো, চাকমা ও সাঁওতাল সমাজ সম্পর্কে আলোচনা করব।
বাংলাদেশের গারো সমাজ
নামকরণ : গারো পাহাড়ের নামানুসারে গারো নাম নাকি-গারোদের নামানুসারে গারো পাহাড়ের নাম সেটা নিয়ে বিতর্ক আছে। বোনার্জি‘র তথ্যানুযায়ী গারো জনগোষ্ঠীর নামানুসারে আসামের পাহাড় শ্রেণীর নাম গারো পাহাড়। বাংলাদেশী নৃবিজ্ঞানী খালেক বোনার্জির তথ্য সমর্থন করে বলেন যে, গারো জনগোষ্ঠীর নামানুসারে গারো পাহাড়ের নাম।
গারোরা বন-জঙ্গলে আর পাহাড়ী এলাকায় বসবাস করে বিধায় সমতলবাসী বাঙালীরা তাদেরকে প্রথম থেকে গারো নামে ডাকতে শুরু করে। গারোরা অবশ্য নিজেদেরকে প্রায়ই মান্দি বা মানুষ বলে পরিচয় দেয়। তবে বাঙালি কর্তৃক দেওয়া গারো নামটিই তারা গ্রহণ করে নিয়েছে।
বাসস্থান : গারো সমাজের অধিকাংশই ভারতের আসাম জেলায় এবং বাংলাদেশের ময়মনসিংহ ও টাঙ্গাইল জেলায় বসবাস করে। এছাড়া ঢাকা জেলার উত্তর, রংপুর জেলার উত্তর-পূর্বাঞ্চলে এবং সিলেট চা বাগানে সামান্য কিছু গারো দেখতে পাওয়া যায়।
জনসংখ্যা : ভারতের আসাম জেলার গারো পাহাড়ী এলাকায় প্রায় ২৩৭৮৪২ জন গারো বসবাস করে। আর বাংলাদেশে গারোর সংখ্যা ৮০০০০ এর মত। এর মধ্যে ময়মনসিংহে ৫০০০০ এবং টাঙ্গাইলের মধুপুর গড়ে ২০০০০ গারো বসবাস করে। অন্যান্য অঞ্চলে প্রায় ১০০০০ এর মত গারো বাস করে। ভারত ও বাংলাদেশ মিলে মোট গারোর সংখ্যা প্রায় ৩১৭৮৪২ জন।
গারোদের ভাষা : এদের ভাষার স্থানীয় নাম মান্দি ভাষা বা গারো ভাষা। গারোদের কোন লিপি বা অক্ষর নাই। তবে বর্তমানে ভারতের গারোরা আসাম অঞ্চলে গারো ভাষা লিখছে।
গারোদের নৃগোষ্ঠীগত পরিচয় : নৃগোষ্ঠীগতভাবে গারোদের মঙ্গোলয়েড-ই বলা চলে। কেননা তাদের মধ্যে মঙ্গোলয়েড নৃগোষ্ঠীর অনেক মিল লক্ষ করা যায়। যেমন গারোদের মুখমন্ডল গোলাকার এবং সমতল। নাক প্রসস্থ এবং চ্যাপ্টা। পুরুষের মুখে দাড়ির পরিমান কম। এদের গড় উচ্চতা প্রায় পাঁচ ফুট। গারো মেয়ে পুরুষের গড়ন হালকা পাতলা। তবে তারা অনেক শক্তিশালী ও কর্মঠ হয়।
গারোদের ধর্ম : বর্তমানে গারোরা ৯০% ধর্মান্তরিত খ্রিস্টান। প্রায় ২% মুসলমান ও হিন্দু। বাকি ৮% এর মতো গারোরা নিজ ধর্মই ধরে রেখেছে। গারোদের ধর্মের নাম সংসারেক। সম্ভবত বাংলা সংসার থেকে সংসারেক শব্দটি এসেছে। এখানে সংসার বলতে জগৎ সংসারকেই বোঝানো হয়েছে। অর্থাৎ সংসার, পরিবার-খানা বা জাগতিক বিষয়ই তাদের ধর্ম। ঐতিহ্যগতভাবে তারা সর্বপ্রাণবাদে বিশ্বাসী।
তারা যে অতিপ্রাকৃতে বিশ্বাস করে তার নাম মাইতে। মাইতে বলতে দেব-দেবী এবং প্রেতাত্মা উভয়কে বোঝাতে ব্যবহৃত হয়। গারোরা বিশ্বাস করে কিছু মাইতে দয়ালু এবং কিছু মাইতে নির্দয় প্রকৃতির হয়ে থাকে। উভয় ধরণের মাইতেকেই পূজা অর্চনার দ্বারা খুশী করতে চায়।
গারোদের সামাজিক সংগঠন : গারো সমাজ মুলত মাতৃসূত্রীয়। তাদের সবচেয়ে বৃহৎ মাতৃসূত্রীয় দল বা গোত্রের নাম চাটচী যার অর্থ আত্মীয় বা জ্ঞাতি। পাঁচ ধরনের চাটচী গোত্র রয়েছে। প্রতিটি চাটচী গোত্রই বহির্বিবাহ রীতি মেনে চলে। প্রতিটি চাটচী গোত্র আবার ছোট ছোট কয়েকটি ক্ষুদ্র গোত্রে বিভক্ত যার নাম মাচং। প্রতিটি মাচং এর অধীনে কয়েকটি করে ক্ষুদ্র গোত্র রয়েছে যার নাম মাহারী। উল্লেখ্য যে মাহারী, চাটচী এবং মাচং সবই মাতৃসূত্রীয় গোত্র এবং প্রতিটাই বহির্বিবাহ ভিত্তিক গোত্র।
গারোদের পরিবার ও বিবাহ : গারো পরিবার মাতৃসূত্রীয় অর্থাৎ সম্পত্তি এবং বংশ নাম মাতৃধারায় মাতা থেকে মেয়েতে বর্তায়। গারো দম্পত্তি স্ত্রীর বাবার গৃহে বসবাস করে। তবে বর্তমানে কিছু শিক্ষিক যুবকরা বিয়ের পর নিজ পিতার গৃহেই বসবাস করে। পরিবারের ক্ষমতা স্ত্রীর হাতেই ন্যস্ত থাকে। পরিবারের সম্পত্তির মালিক স্ত্রী। তবে ব্যবস্থাপনার মালিক স্বামী। তাই কোন বিষয়ে সিদ্ধান্ত নিতে হলে উভয়কেই সিদ্ধান্ত নিতে হয়।
গারো সমাজে মনোগামী বা যুগল বিবাহ রীতিই বেশী লক্ষ করা যায়। তবে বহু স্ত্রী বিবাহের প্রচলন ও আছে। একজন গারো পুরুষ তার চাচাত বা খালাত বোন বিবাহ করতে পারে না। তাকে তার মামাতো বা ফুপাতো বোনকে বিবাহ করতে হয়। একটি গারো পরিবারে মাতা থেকে মেয়েই সম্পত্তি অর্জন করে। অর্থাৎ গারো পুরুষেরা সম্পত্তির মালিক নয়। তাদের সম্পত্তি উত্তরাধিকার সূত্রে মায়ের মেয়েরা পেয়ে থাকে।
গারো বিয়েতে কন্যাকে কোন পণ দিতে হয়না। স্বামীও যৌতুক পায় না । তাদের বিয়ে ঐতিহ্যবাহী নিয়মে অনুষ্ঠিত হয়। গারোদের মধ্যে বিবাহবিচ্ছেদ খুবই কম হয়। তবে জরিমানা দেয়ার শর্তে সালিসের মাধ্যমে বিবাহ বিচ্ছেদ হয়ে থাকে।
গারো অর্থনীতি : বাংলাদেশের গারোরা আগে জুম বা পালাক্রমে চাষ করত। তারা প্রধানত ধান এবং নানা জাতের সবজি উৎপাদন করত। গারোরা সরকারি সংরক্ষিত বনাঞ্চলে বসবাস করে। জমিদার অমলে জমিদার কাছ থেকে তারা কৃষি জমি বন্দোবস্ত নেয় । গারো সমাজে ।ভূ-সম্পত্তির মালিক স্ত্রী, স্বামী নয়।
গারো নেতৃত্ব ও রাজনীতি : গারো সমাজে গ্রাম নেতৃত্ব সবসময়ই ছিল। কোন সময় কেন্দ্রীয় নেতৃত্ব গড়ে উঠেনি। বর্ত মানে গারো সমাজে বাংলাদেশের স্থানীয় সরকার ব্যবস্থার নেতৃত্বই জনপ্রিয় হয়ে উঠেছে।
গারোদের শিক্ষা : গারো অঞ্চলে খৃষ্টান মিশনারী স্কুল গুলোতে গারোরা বিনা মূল্যে শিক্ষালাভ করছে। তাদের নিজস্ব লিপি না থাকায় বাংলা হরফে গারো ভাষা শিখছে। বর্তমানে ২০% এরও অধিক শিক্ষিত বলা চলে।
অন্ত্যেষ্টিক্রিয়া : গারোদের বিশ্বাস দেহ থেকে আত্মা বিদায় নিলেই মৃত্যু ঘটে। আত্মা অমর। তাদের বিশ্বাস মৃত্যুর পর আত্মা চিকমাং নামক মৃতের দেশে চলে যায়। মৃতদেহ গোসল দিয়ে মেঝেতে রেখে দেয়। মরদেহের মাথার কাছে খাবার রেখে দেয়। একদিন একরাত রাখার পর পোড়ানো হয়।
গারো সমাজ এখন আর বিচ্ছিন্ন জনপদ নয়। এখন তারা বাংলাদেশের কেন্দ্রীয় শাসনাধীন। ফলে ঐতিহ্যবাহী গারো গ্রামে প্রধানের গুরুত্ব কমে গিয়েছে। শিক্ষার প্রসারের ফলে গারো সমাজে গতিশীলতা বৃদ্ধি পেয়েছে।। অনেকে চাকরি করছে।
বাংলাদেশের চাকমা সমাজ
নামকরণ : বয়স্ক শিক্ষিত চাকমারা নিজেদের জন্য চাকমা নামটিই ব্যবহার করেন। তবে চাকমা সমাজের বৃহত্তর গ্রামীন জনগোষ্ঠী চাঙমা নামেই নিজেদের পরিচয় দেয়। এ নামের উৎপত্তি সম্পর্কে চাকমারা তেমন কিছুই জানে না। তবে কেউ কেউ বলেন, চাকমারা চম্পক নগর থেকে আগত বলে চম্পক থেকে চাকমা বা চাঙমা নামটি গ্রহণ করা হয়েছে।
উৎপত্তি ও ইতিহাস : অনেক চাকমাই মনে করেন তারা এককালে চম্পক নগরের বাসিন্দা ছিলেন। কেউ বলেন চম্পক নগর উত্তর পশ্চিম ভারতে, কেউ বলেন উত্তর-পূর্ব ভারতে, কেউ বলেন হিমালয়ের পাদদেশে, এমন কি কেউবা বলেন চম্পকনগর মালয়েশিয়ায়। চাকমা কাহিনীতে ব্যক্ত হয়েছে যে, চম্পক নগর থেকে এক চাকমা রাজপুত দেশ জয়ের উদ্দেশ্যে বার্মার আরাকানে গমন করেন এবং সেখানে আরাকানের বেশ কিছু অঞ্চল চাকমারা সম্ভবত নবব শতক থেকে চতুর্দশ শতক পর্যন্ত শাসন করেন।
চাকমারা পরে স্থানীয় আরাকানিদের দ্বারা বিতাড়িত হয়ে প্রথমে বর্তমানে চট্টগ্রাম জেলায় পরে ধীরে ধীরে পার্বত্য এলাকায় গিয়ে বসবাস শুরু করে। আরাকান থেকে চাকমাদের এখানে আগমন ঘটে আনুমানিক পঞ্চদশ শতাব্দীতে। তখনো বাংলাদেশ বৃটিশ শাসনে আসেনি। চাকমারা মুঘল সরকার এবং পরবর্তীতে বৃটিশ সরকারের সঙ্গে বাণিজ্যিক চুক্তিতে আসে। ১৯০০ সালে বৃটিশ সরকার চাকমাদের জন্য হিলট্রাকস ম্যানুয়াল প্রণয়ন করেন। এই ম্যানুয়াল অনুযায়ী পার্বত্য ট্রাইবাল সমাজের প্রশাসন কার্যক্রম চলতে থাকে।
চাকমা বাসস্থান : বাংলাদেশের তিন পার্বত্য অঞ্চলে চাকমাদের বসবাস। এর মধ্যে রাঙ্গামাটি জেলায়ই সবচেয়ে বেশী চাকমার বাস। ভারতেও বেশ কিছু চাকমা বসবাস করে।
জনসংখ্যা : জনসংখ্যার দিক থেকে চাকমারা সবচেয়ে বেশী। ১৯৮৩ সালে প্রকাশিত হিসাবে সর্বমোট প্রায় ২১২৫৭৭ জন। বিগত কয়েক বছরে চাকমা জনসংখ্যা আরো অনেক বৃদ্ধি পেয়েছে। তুলনা করলে দেখা যায় চাকমারা পার্বত্য এলাকায় মোট ট্রাইবাল জনসংখ্যার প্রায় অর্ধেক।
চাকমাদের ভাষা : বর্তমানে চাকমারা বাংলা একটি উপভাষায় কথা বলে। তারা বাংলা অক্ষরে ঐ বাংলা উপভাষা লেখে। চাকমারা আগে টিবে-টো-বার্মান ভাষা পরিবারভূক্ত আরাকানি ভাষায় কথা বলতো। সেখানে তারা প্রায় ৫০০ বছর থাকা কালীন চাকমারা আরাকানি ভাষায় কথা বলত। পরবর্তীতে চট্টগ্রাম অঞ্চলের স্থানীয় বাংলা ভাষা-ই অনেকটা গ্রহণ করেছে। চাকমাদের লিপি থাকলেও লিখার কাজে ব্যবহৃত হয় না। লেখার কাজে বাংলা হরফ ব্যবহার করে।
নৃগোষ্ঠীগত পরিচয় : চাকমাদের মধ্যে মঙ্গোলীয় নৃগোষ্ঠীর প্রবাব সমতলবাসী বাঙ্গালীদের তুলনায় অনেক বেশী। চাকমাদের সঙ্গে চীনা মঙ্গোলয়েডের যথেষ্ট মিল। উচ্চতায় মাঝারি থেকে বেঁটে। দৈহিক গড়নেও এরা বেশ শক্তিশালী। পাহাড়ী অঞ্চলে চলাফেরায় চাকমারা বেশ সুঠাম দেহের অধিকারী।
চাকমাদের ধর্ম : চাকমারা প্রধানত বৌদ্ধ ধর্মালম্বী। তারা বৌদ্ধদের বিভিন্ন অনুষ্ঠান পালন করে। গ্রাম এলাকায় মাঝে মধ্যে বৌদ্ধ মন্দির ক্যাং দেখতে পাওয়া যায়। প্রতিটা ক্যাং এ বৌদ্ধ ভিক্ষু থাকেন যিনি বৌদ্ধ ধর্মের বিভিন্ন অনুষ্ঠানে নেতৃত্ব দেন। বুদ্ধ মূর্তীকে তারা প্রদীপ জ্বেলে, ফুল দিয়ে এবং খাদ্য দিয়ে পূজা করে। চাকমাদের মধ্যে বিভিন্ন শুভ-অশুভ দেব-দেবীর নামও বর্তমান। তারা গোজেন নামক ঈশ্বরকে খুবই ভক্তি শ্রদ্ধা করে।
চাকমা সমাজের গড়ন : চাকমা সমাজের ক্ষুদ্র সংগঠন হল পরিবার। এরপর রয়েছে গোত্তি বা গোজা। এর চেয়ে বড় সামাজিক একক হল আদাম বা পাড়া। তার চেয়ে অধিক আয়তন হল গ্রাম বা মৌজার। মৌজার পরে বৃহত্তম সংগঠন হল চাকমা সার্কেল বা চাকমা ট্রাইবাল সংগঠন।
চাকমা পরিবার : চাকমা পরিবার পিতৃতান্ত্রিক। অর্থাৎ চাকমা পরিবারে ক্ষমতা স্বামীর হাতে অথবা বয়স্ক পুরুষের হাতে ন্যস্ত থাকে।সম্পত্তি বা বংশ পরিচয় পিতা থেকে পুত্রে বর্তায়।
চাকমা বিবাহ : চাকমাদের মধ্যে নিজ বংশে সাত পুরুষের মধ্যে বিবাহ নিষিদ্ধ। চাকমা সমাজে ক্রস-কাজিন বিবাহ প্রচলিত আছে। অর্থাৎ মামাত বাই বোন বা ফুপাত ভাই বোনের মধ্যে বিয়ে হয়ে থাকে। খালাত ভাই বোনদের মধ্যে বিবাহ প্রচলিত আছে। তবে আপন চাচাত ভাই বোনের মধ্যে বিয়ে অনুষ্ঠানে সামাজিক বাধা রয়েছে। এদের মধ্যে বহুস্ত্রী বিবাহ অনুমোদিত।
চাকমা সমাজে অন্তর্বিবাহ এবং বহির্বিবাহ উভয়ই প্রচলিত। সাধারণত একজন চাকমা যুবক চাকমা সমাজেই বিবাহ করেন। চাকমা বিবাহিত দম্পতি বিয়ের পর স্বামীর পিতার গৃহে অথবা স্বামীর নিজগৃহে বসবাস করে।
বিবাহ বিচ্ছেদ : চাকমা সমাজে খুব কমই বিবাহ বিচ্ছেদ ঘটে। স্ত্রী দোষী হলে স্বামী স্ত্রীকে দেওয়া পোষাক ও গহনাপত্র দাবি করতে পারে। স্বামী দোষী হলে তাকে জরিমানা দিতে হয়। এভাবে সালিসের মাধ্যমে বিবাহ বিচ্ছেদ ঘটে।
আদাম বা পাড়া : চাকমাদের বৃহৎ সংগঠন হল পাড়া বা আদাম। কতগুলো চাকমা পরিবার গুচ্ছ নিয়েই গঠিত হয় আদাম। আদামের প্রধানকে বলা হয় কারবারী। কারবারী নিয়োগ করেন চাকমা রাজা। কারবারীর কাজ হল আদামের শান্তি-শৃঙ্খলা রক্ষা করা এবং বিচার কাজে মৌজা প্রধানকে সাহায্য করা।
গ্রাম বা মৌজা : কতগুলো চাকমা আদাম মিলে গঠিত হয় চাকমা গ্রাম বা মৌজা। মৌজার প্রধানকে বলা হয় হেডম্যান। হেডম্যানের কাজ হল শান্তি-শৃঙ্খলা রক্ষা করা। হেডম্যানের অন্যতম কাজ হল খাজনা আদায় করা। খাজনা আদায় করে ডেপুটি কমিশনার অফিসে জমা দিয়ে একটা কমিশন লাভ করেন।
চাকমা সার্কেল : চাকমা সমাজের কয়েকশত মৌজা বা গ্রাম মিলে চাকমা সার্কেল গঠিত হয়। সার্কেলের প্রধান হল চাকমা রাজা। চাকমা রাজা বংশ পরম্পরায় নিযুক্ত হন। চাকমা রীতি অনুযায়ী তিনি সামাজিক বিচার-আচার পরিচালনা করেন। হেডম্যানদের কাছ থেকে প্রাপ্ত খাজনার একটি অংশ সরকারকে প্রদান করেন। চাকমা রাজা চাকমা সমাজের প্রতীক।
চাকমা অর্থনীতি : চাকমারা পর্যায়ক্রমে চাষ বা জুম চাষের উপর নির্ভরশীল। পাহাড়ের গাছ কেটে, পুড়িয়ে দিয়ে সেখানে ধান, তিল ও অন্যান্য ফসলের মিশ্রিত বীজ একত্রে বপন করে পরবর্তীতে যেটা যখন পাকে সেটা তখন ঘরে তোলার কৃষি পদ্ধতির নামই জুম চাষ। চাকমা সমাজে পাহাড়ী জুম জমিতে এখনো পুরোপুরি ব্যক্তি মালিকানা নাই। হাল কৃষি জমির অধিকাংশই ব্যক্তি মালিকানায়। চাকমারা অনেকেই মুরগি ও শুকর পালন করে, কুটির শিল্পজাত দ্রব্য এবং নিজস্ব তাঁতে কাপড় বুনে ও বাজারে বিক্রি করে। সাধারনত চাকমা পুত্ররাই কেবল জমির উত্তরাধিকারী কন্যারা নয়।
শিক্ষা : চাকমারা অন্যান্য এথনিক সমাজের তুলনায় বেশী শিক্ষিত। ট্রাইবাল কোটা পদ্ধতিতে তাদের শিক্ষার্থীদের সংখ্যা বৃদ্ধি পাচ্ছে। চাকমারা বর্তমানে সরকারী ও বেসরকারী বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে চাকরি করছে।
অন্তেষ্টিক্রিয়া : চাকমা সমাজে মৃতদেহ পোড়ানো হয়। তবে সাত বছরের কম বয়সীদের কবর দেয়া হয়। এই অনুষ্ঠানে মৃতের আত্মার জন্য খাদ্য, মদ, অর্থ, কাপড় ইত্যাতি উৎসর্গ করা হয়।
বর্তমানে চাকমা সমাজে ক্রমশ পরিবর্তন ঘটছে। উৎপাদন কৌশলে এসেছে পরিবর্তন। এ ছাড়া ব্যবসা-বাণিজ্য, যোগাযোগ ব্যবস্থা, পোষাক, খাদ্যাভাস এবং ঘর বাড়ীর ধরণে অনেক পরিবর্তন এসেছে। সামাজিক সচেতনতা বৃদ্ধির ফলে চাকমারা ক্রমশ বহির্মুখী ব্যক্তিত্বের অধিকারী হচ্ছে এবং সামাজিক গতিশীলতা বৃদ্ধি পাচ্ছে।
বাংলাদেশের সাঁওতাল সমাজ
বাসস্থান : বাংলাদেশের উত্তরাঞ্চলে তথা বৃহত্তর রাজশাহী, দিনাজপুর, এবং বর্তমান জয়পুরহাট জেলায় সাঁওতাল এথনিক সম্প্রদায় বসবাস করে। ধারণা করা হয় যে, বর্তমান সাঁওতালদের পূর্বপুরুষ ভারতের পশ্চিমবঙ্গ, বিহার রাজ্য ও অন্যান্য পার্বত্য অঞ্চল থেকে বাংলাদেশের এসব জেলায় পাড়ি জমায়। সাঁতালরা এদেশে আসে মূলত কৃষি মজুর হয়ে। আজও তারা অনেকেই ভূমিহীন এবং মজুরী করেই জীবিকা নির্বাহ করে। সাধারণভাবে মনে করা হয় সুতাঁর কথাটি থেকে সাঁতাল শব্দের উদ্ভব।
জনসংখ্যা : সাঁতালদের লোক সংখ্যা কত সে সম্পর্কে সঠিক তথ্য পাওয়া যায় না। তবে অনুমান করা হয় যে,প্রায় লক্ষাধিক সাঁতাল এদশে বসবাস করে। এর অধিকাংশ রাজশাহীর বরেন্দ্র অঞ্চলে বসবাস করে। সিলেটের চা বাগানে শ্রমিকদের একটা বড় অংশ সাঁওতাল।
জাতিগত পরিচয় : দেহ কাঠামোর বৈশিষ্ঠ্যগত দিক থেকে সাঁওতালদেরকে বিশুদ্ধ প্রাক-দ্রাবিড়ীয় গোষ্ঠীর প্রতিনিধি মনে করা হয়। তবে অষ্ট্রেলীয় কৌমগুলোর সাথে সাঁতালদের বেশ মিল লক্ষ করা যায় বলে অনেক সময় আদি অস্ট্রেলীয় বলা হয়। সাঁতালদের নিজস্ব ভাষা আছে। তাদের ভাষা অস্ট্রো-এশিয় ভাষাগ্রুপের অন্তর্গত।
দৈহিক বৈশিষ্ট্য : সাঁওতালদের গায়ের রং গাঢ় কালো ও নাকের গড়ন নিগ্রোদের মত চ্যাপ্টা। মাতার খুলি গোলাকার। মুখমন্ডল বড়, ঠোট মোটা ধরনের, চুলের রং বেশ কালো ও কোকড়া। দেহের উচ্চতা মাঝারি ধরনের।
ধর্ম : সাঁওতাল জনগোষ্ঠী সাধারণত দুইটি ধর্মের অনুসারী। তাদের এক অংশ সনাতন হিন্দু ধর্মে বিশ্বাস করে। এবং অপর অংশ কালক্রমে খ্রিষ্টধর্ম গ্রহণ করেছে। ধর্মীয় আচার-অনুষ্ঠান ছাড়াও তাদের জন্ম, বিবাহ, পূজা ইত্যাদির সাথে নানা ধরনের আচার-অনুষ্ঠান জড়িত আছে।
বিবাহ ও পরিবার : সাঁতালদের মধ্যে একক বিবাহ প্রথা প্রচলিত আছে। তবে ক্ষেত্র বিশেষে বহুস্ত্রী বিবাহ স্বীকৃতি দেয়া হয়। এদের মধ্যে বহির্বিবাহের প্রচলন আছে। নিজ গোত্রের বাইরে বিয়ে করতে হয়। সাঁতালদের মধ্যে যৌতুক প্রথা প্রচলিত আছে। বিধবা বিবাহ ও তালাক প্রাপ্তদের বিয়েও এদের মধ্যে প্রচলিত। বড়ভাই মারা গেলে ছোট ভাই বিধবা ভাবিকে বিয়ে করতে পারে। সাঁওতালদের মধ্যে পিতৃতান্ত্রিক ব্যবস্থাই দেখা যায়। পূর্বে যৌথ পরিবার থাকলেও বর্তমানে অণু পরিবারের প্রাধান্য দেখা যায়।
অর্থনীতি : সাঁওতালদের জীবিকার প্রধান উপায় কৃষি। তারা মুলত কৃষি শ্রমিক। প্রায় শতকরা ৯০ ভাগ সাঁওতাল ভূমিহীন। যাদের জমি আছে তাদের দুই বা তিন বিঘার বেশী নয়। এদের মধ্যে কিছু গোচাষী রয়েছে। শুধুমাত্র তাদের শ্রম বিক্রি করে কোনো উপায়ে জীবন ধারণ করে।
খাদ্য : সাঁওতালদের প্রধান খাদ্য ভাত। খুবই গরীব যারা তারা আলু সিদ্ধ করে খায়। চাউল থেকে এক ধরনের হারিয়া নামক মদ তৈরী করে। পুরুষ ও মহিলা সবাই মিলে মদ পান করে। উৎসবের সময় মদ খেয়ে নৃত্য করে।
পেষাক ও অলংকার : সাঁওতাল মেয়েরা কাঁধের উপর জড়িয়ে শাড়ি পড়ে। পুরুষরা লুঙ্গি পরে। তারা কখনো মাথায় কাপড় দেয় না। মেয়েরা হাত-পা ও গলায় পিতলের বা নিরেট কাঁসার গয়না পরে। পুরুষরা কেউ কেউ গলায় মালা ও হাতে বালা পরে।
বাড়িঘর : বরেন্দ্র অঞ্চলের সাঁওতালরা মাটির ঘরে বসবাস করে। মাটির ঘরের উপরে খড়ের ছাউনী থাকে। বিত্তবানরা টিনের ছাউনী দেয়। তাদের বাড়ি ঘর এবং নিজেরা খুব পরিস্কার -পরিচ্ছন্ন থাকে।
উৎসব ও উপাসনা : সাঁওতালরা ভূত-প্রেতের উপাসনা করে থাকে। তাদের দেবতার নাম বোঙা, যিনি পাহাড়ে থাকেন বলে বিশ্বাস করে। সাঁওতালদের শ্রেষ্ট দেবতা হল ‘চান্দো’। এই দেবতার জন্য তারা মুরগী ছানা উৎসর্গ করে। প্রতিটি সাঁওতাল পরিবারে দুইটি করে বোঙা থাকে। শুধুমাত্র গৃহকর্তাই এগুলোর নাম জানেন। বছরে মোট পাঁচটি পর্ব দেখা যায়। সাঁওতাল সমাজে ঝুমুর গান বেশ প্রচলিত।
শিক্ষা-দীক্ষা : সাঁওতালদের মধ্যে শিক্ষিতের হার খুবই কম। বর্তমানে তাদের ছেলে- মেয়েরা শিক্ষার প্রতি আকৃষ্ট হচ্ছে। কোথাও কোথাও তাদের ভাষায় শিক্ষা দানের ব্যবস্থা আছে।
রাজনৈতিক কার্যক্রম : সাঁওতাল গ্রাম কয়েকটি বৃত্তে বিভক্ত থাকে। প্রতিটি বৃত্তের তত্ত্বাবধান করেন একজন পঞ্চায়েত যার অধিকারে কয়েক একর নিস্কর ভূমি থাকে। মাঝি হল গ্রাম প্রধান। গ্রাম প্রধানের নেতৃত্যে তারা তাদের দৈনন্দিন নানা ধর্মীয় কর্মকাণ্ড করে থাকে। এরা একটি পশ্চাদ পদ জনগোষ্ঠী হলেও এই অঞ্চলে বিশ শতকের প্রথম ভাগে সংঘটিত সাঁওতাল বিদ্রোহ বেশ আলোচিত রাজনৈতিক ঘটনা।
বাংলাদেশের কতিপয় এথনিক সম্প্রদায় যেমন- গারো, চাকমা ও সাঁওতাল সম্পর্কে একটি ধারণা দেয়ার চেষ্টা করা হয়েছে। আশা করি এই তিন সম্প্রদায় সম্পর্কে মোটামুটি একটা স্বচ্ছ ধারণা পাওয়া যাবে।
অর্ডিনারি আইটির নীতিমালা মেনে কমেন্ট করুন। প্রতিটি কমেন্ট রিভিউ করা হয়।
comment url