শিক্ষণ কলার কলাকৌশল

লেখক গিলবার্ট হায়েট এর The art of Teaching বা শিক্ষণ কলা নামক বইয়ে শিক্ষণ কলার কলাকৌশল গুলি যে ভাবে সুন্দর করে বর্ণনা করেছেন সে গুলি ছাত্র-শিক্ষক সবারই জানা খুবই জরুরী। আসুন কলাকৌশল গুলি জেনে নিই এবং নিজের জ্ঞানকে বিকশিত করি।

শিক্ষণ কলার কলাকৌশল

শিক্ষক জীবনের তিনটি শ্রেষ্ঠ পুরস্কারের মধ্যে অবসর যাপনের সুযোগ অন্যতম, দ্বিতীয়- শিক্ষকের মন প্রতিনিয়ত কোনো না কোনো মূল্যবান বিষয়ে নিবিষ্ঠ থাকে এবং তৃতীয়- কোনো কিছু সৃষ্টি করার আনন্দ। একজন ভালো শিক্ষকের মধ্যে থাকবে বিজ্ঞান সুলভ ব্যাপক মানসিক কৌতুহল এবং জ্ঞানের প্রতি অসাধারণ ও জীবন্ত অনুরাগ। একজন ভাল শিক্ষকের সবচেয়ে প্রয়োজনীয় গুণ হল যে, তিনি যা শেখাবেন সে বিষয়ে ভাল জ্ঞান থাকতে হবে।

শিক্ষক ও শিক্ষাদানের কলাকৌশল এবং জ্ঞান অর্জন অবিচ্ছেদ্য। শিক্ষণ প্রক্রিয়াতে শিক্ষক তাঁর নিজস্ব শৈলী ব্যবহার করেন। কোনো একটা গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ের উপরের স্তর সম্পর্কে জ্ঞান না থাকলে সে বিষয়ের প্রাথমিক স্তর ও মূলকে পরিপূর্ণভাবে বুঝতে পারেন না। বিশেষ করে শেখাবার ভাবভঙ্গি, স্বর ও উচ্চারণ অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। শিক্ষক শেখানোর বিষয়কে পছন্দ করবেন।

যে শিক্ষক শেখানোর বিষয়কে অপছন্দ করেন বা তার প্রতি উদাসিন হন তাঁকেও মুনাফিকের দলেই ফেলা হয়। ছাত্ররা শিক্ষকদের কোনো দিন সর্বজ্ঞ বলে মনে করে না। তারা সবচেয়ে বেশি কামনা করে শিক্ষকের সরলতা ও আন্তরিকতা। ছাত্রদেরকে ভালোবাসা সুশিক্ষকের অপরিহার্য গুণ। অজ্ঞতা, বুদ্ধির স্বল্পতা ও অনভিজ্ঞতা ছাড়া তাদের কোনো ত্রুটিই দেখা যায় না। এ ত্রুটিগুলো দুর করার জন্যই তারা শিক্ষকের সাহায্য প্রার্থী।

একজন ভালো শিক্ষকের বৈশিষ্ট্য

  • জরুরী বিষয়গুলি বেছে নিতে হবে এবং চিত্তাকর্ষক ও প্রদীপ্ত বিষয়গুলি বেছে নেয়া - এতে শিক্ষকের পূর্ণ জ্ঞানার্জনের অনুভূতি জাগ্রত হবে।
  • ছাত্রদের ভাল করে লক্ষ্য রাখতে হবে, কথাবার্তা বলা ছাড়া অবসরে মেলামেশা করা, তাদের কে খাওয়ানো এবং খেলাধুলায় যোগ দিতে। এভাবে বুঝে নিতে হবে ছাত্রদের মন ও আবেগ।
  • ছাত্রদের নাম ও চেহারা চিনে রাখতে হবে।
  • একজন ডাক্তারের চিকিৎসার সাফল্য নির্ভর করবে রোগীর বিশেষ লক্ষণগুলো বিচক্ষণভাবে দেখে তাকে একটা সাধারণ শ্রেণীভূক্ত করার উপর।
  • তেমনি ভাবে ছাত্রদের চিনে নেবার সবচেয়ে ভালো উপায় হলো তাদের বৈশিষ্ট অনুসারে আলাদা শ্রেণীতে ভাগ করে নেয়া। তারপর ও কতগুলো শ্রেণী বিহীন মানুষ থেকে যাবে, এরাই হলো শিক্ষক জীবনের সুখ, দুঃখ ও উদ্বেগের কারণ।
  • বেয়াড়া ছেলেদের সাথে কিভাবে ব্যবহার করতে হবে সে সম্পর্কে সর্বদাই মনে রাখতে হবে যে আপনার ছাত্রদের মধ্যে দু একটি এমন ছেলে থাকতেই পারে। তাদের মানসিকতা বুঝে সাবধানে ব্যবহার করতে হবে। কাজ ও কথাবার্তাকে ওজন করে নিতে হবে।
  • খামখেয়ালী ছাত্রদের দু ভাগে ভাগ করা যেতে পারে যেমন- এক. দুর্বল - যাদের কে উৎসাহ দেয়া প্রয়োজন। দুই. যাদের সঠিক পথে চালনা করা দরকার।
  • বখাটে ছাত্রদের সাথে সম্পর্কটাকে মোটেই ব্যক্তিগত হতে দেয়া ঠিক না।
  • প্রতিভাবান ছাত্রটিকে কখনো নিজের অবিকল প্রতিলিপি করে তুলবার চেষ্টা করবেন না। এ কাজটি অসম্ভব কারণ এক মানুষ থেকে অপর মানুষ আলাদা ধরনের। অপরদিকে তাকে আপনার কলা কৌশল ও অভিজ্ঞতা শেখাতে ইতস্তত: করবেন না।
  • এরপর তাকে প্রচুর কাজ ও চিন্তার খোরাক দিতে হবে। কোন ছাত্রের শক্তিকে অপচয়ের কিংবা ব্যর্থতার হাত থেকে রক্ষা করার শ্রেষ্ঠতম উপায় হল তার কাজের একটা পরিকল্পনা করে দেয়া। তবে একথা তাকে বুঝতে দেয়া ঠিক নয়। এতে তার উৎসাহ কমে যেতে পারে।
  • ছাত্রদের দিয়ে তাদের কাজের হিসাব রাখতে হবে। কিছুদিন পর তার কাজের খতিয়ান দেখে অভিনন্দন জানাতে হবে, এতে সে একটা অপ্রত্যাশিত শক্তি অনুভব করবে। মনে তার অঙ্কুরিত হবে বড় বড় ভাব ধারা।

দুটো বিশেষ কাজ অন্যান্য পেশাদার থেকে শিক্ষককে আলাদা করে রেখেছে-

  • স্কুল, কলেজ ও বাইরের জগতের মাঝখানে একটা সেতু বন্ধন তৈরী করা।
  • যৌবন ও পরিনত বয়সের মধ্যখানে সেতু রচনা করা।
  • ভালো শিক্ষক সত্যিকার একজন আকর্ষণীয় ব্যক্তি। এ কারনেই তিনি তাঁর শেখানোর বিষয়টি আকর্ষণীয় করে তুলতে পারেন।
  • শিক্ষা দানের একটি বড় অংশ হল বোঝানো, অজানাকে আমরা জানা জিনিস দিয়ে বোঝাই, আর অস্পষ্টতাকে বোঝাই স্পষ্ট জিনিস দিয়ে।
  • যিনি ভালো শিক্ষক তিনি তার মধ্যকার তরুণ ব্যক্তিত্ব থেকে বৈচিত্র ও জীবনী শক্তি টেনে বের করতে সমর্থ হন।
  • শিক্ষকের যতো ভালোগুণ থাকা দরকার তার মধ্যে একটি হলো রসিকতা। সুদক্ষ শিক্ষক ভালো করেই জানেন যে, ৫৫ মিনিটের কাজ আর ৫ মিনিটের হাসি মিলে যে কাজ হবে তা হবে ৬০ মিনিটের একটানা কাজের দ্বিগুণ।
  • দুরন্ত ক্লাসকে শান্ত রাখার হাতিয়ার রূপে হাস্য রসের ভূমিকা বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ। এতে ছাত্র শিক্ষকের মধ্যে যোগসূত্র স্থাপন হয়।
  • শিক্ষকের একটা প্রধান কাজ হল যৌবন কাল আর পরিণত বয়সের মধ্যে সেতু তৈরী করা। ছোটরা মনে করে বড়দের মনে রস নাই, বড়রা মনে করে ছোটরা কিছুই বোঝেনা। এটাই হলো বয়সের তারতম্যে ভূল বোঝাবুঝির মূল সোপান। মিলে মিশে কাজ করাই শিক্ষাদানের মূল উপাদান।

শিক্ষককে বিভিন্ন ধরনের বাধা অতিক্রম করতে হয় যেমন-

  • ছেলেরা কাজ করতে ভালবাসেনা, আড্ডা দিতেই বেশী পছন্দ করে। কৌশলে তাদেরকে কাজে লাগাতে হবে।
  • ছাত্ররা তাদের উপর কারো প্রভূত্ব পছন্দ করেনা। তারা স্বাভাবতই নৈরাজ্যবাদী। শিক্ষকের কর্তব্য হবে বিভিন্ন কর্তৃত্বের মধ্যকার পার্থক্য শিখিয়ে দেয়া। ভালকে গ্রহণ করা আর মন্দটিকে বর্জন করা।
  • একাগ্রতাকে তারা ঘৃণা করে- এটি শেখাতে হবে। নিজস্ব স্বাধীনতা বজায় রাখার জন্যই তারা সকল প্রকার উপদেশকে অগ্রাহ্য করে।
  • ছাত্রদের মধ্যে প্রতিরোধের ভাবকে উদ্দীপ্ত করা শিক্ষাদানের একটা প্রকৃষ্ট উপায়। তারপর তাকে ঠিক পথে চালিয়ে নেয়া। এসব বাধা অতিক্রমের জন্য শিক্ষকের ইচ্ছাশক্তি থাকতে হয়।

শিক্ষাদান পদ্ধতি

১। শিক্ষাদান প্রস্তুতি :
  • স্বল্প পরিসরে কাজের প্রস্তুতি সাধারণত বেশ ফলপ্রসু হয়- সুবিস্তৃত পরিসরে প্রস্তুতির ফল ভাল হয় না। সারা বছরের উপযোগী পরিকল্পনা তৈরী না করে আগামী এক দিন বা এক সপ্তাহের কাজ তৈরী বেশী ফলপ্রসু।
  • উদ্দেশ্য সম্মন্ধে সঠিক জ্ঞান থাকাটা শিক্ষাদানের অন্যতম প্রধান সহায়ক। ব্যাপক পরিকল্পনার মধ্যেই মেলে শক্তির পরিচয়। সবচেয়ে ভাল ব্যবস্থা হল ক্লাসের কাজের একটা পরিকল্পনা তৈরী করে ছাত্রদের তা বুঝিয়ে দেয়া।
  • ক্লাসের পড়া শুরু করার আগেই ক্লাসে কি পড়ানো হবে তার একটা আভাস ছাত্রদেরকে দিতে হবে।
  • ছাত্ররা কী কী প্রশ্ন করতে পারে তা আগে থেকে প্রস্তুতি নিতে হবে।
  • ক্লাসের ছাত্র সংখ্যা অনুসারে পড়ানোর কায়দা যথেষ্ট পরিবর্তিত হলেও বিষয়বস্তুর বিভিন্নতার দরুণ পরিকল্পনায় পরিবর্তন আসবে না। একঘেয়েমী বা অবাস্তব কাজ কমিয়ে ব্যাখ্যামূলক বিশ্লেষণ ও আলোচনার পরিধি বাড়িয়ে তোলা। এবং শিক্ষাদানের কায়দা মাঝে মাঝে বদলানো।
  • শেখানোর বিষয়টিকে অপরিচিত শব্দের একটি আকারহীন স্রোতস্বিনী রূপে মনের মধ্যে গ্রহণ না করে বহুঅংশের সমন্বয়ে গঠিত বুদ্ধিগত ও শিক্ষাগত পরিপূর্ণ সৃষ্টি রূপে মানষ পটে একে নেয়া।
  • বক্তৃতার মাঝে মাঝে প্রশ্নোত্তর ও আলোচনার ব্যবস্থা ও রাখতে হবে। বক্তৃতার মাধ্যমে শিক্ষক ছাত্রদের সারা বছরের কাজের একটি মোটামুটি আভাস দিয়ে দেবেন। বই সম্পর্কে ধারণা দিতে হবে, কিভাবে পড়াশুনা করতে হবে তা বুঝিয়ে দিতে হবে।
  • শিক্ষক কিছু কিছু প্রশ্নের জবাব দেবেন আবার কিছু সংখ্যক জবাব এড়িয়ে গিয়ে তাদের জ্ঞানের দ্বার অর্ধ উম্মুক্ত রাখবেন।
  • পাঠ্য তৈরীর সময় খেয়াল রাখতে হবে এটা কি ছাত্রদের কাজে লাগবে? বা এটা কি তারা বুঝতে পারবে? ক্লাসের বক্তৃতার সৌন্দর্য ও শালীনতার প্রয়োজন অত্যন্ত বেশী অর্থাৎ সমগ্র পাঠের গঠন শৈলীই হলো সবচেয়ে মূল্যবান জিনিস।

২। ছাত্রদের মধ্যে জ্ঞান বিতরণ
শেখানোর বিষয়টি আয়ত্ব করার পর শিক্ষকের প্রধান কাজ হলো তার জ্ঞানকে ছাত্রদের নিকট পৌছে দেয়ার তিনটি প্রধান পদ্ধতি -
ক. বক্তৃতা দেয়া :
  • আগে থেকে প্রস্তুত না হয়ে বক্তৃতা দেয়া অসম্ভব। কন্ঠস্বর ও অঙ্গভঙ্গির ওপর বক্তৃতার সাফল্য অনেকখানি নির্ভর করে।
  • বক্তৃতার মাঝে অতিরিক্ত থামা নিকৃষ্ট বক্তার লক্ষণ। কখার মাঝে এ্যা এ্যা করা অমার্জনীয়
  • প্রত্যেক বক্তাকেই বক্তৃতার মাঝে মাঝে থেমে কথা বলে যেতে হবে, যাতে তার কথা শ্রোতাদের মনের ভিতর গিয়ে পৌছে এবং তার স্বরের প্রতিধ্বনি মিলিয়ে যায়।
  • শিক্ষক যে বিষয়গুলি লিখে নেয়ার উপযুক্ত মনে করবেন সেগুলোকে পরিস্কার ও দ্ব্যর্থহীন ভাষায় ধীরে ধীরে বলে যাবেন।
  • স্বরের উঠানামা ও পরিবর্তনে ছাত্রদের মন হয়ে উঠবে চঞ্চল ও উদগ্রীব। স্বত:স্ফুর্ত, জড়তাহীন ও স্বাভাবিক গতিতে কথা বলতে হবে।
  • বর্ণনা, উপমা ও উপযুক্ত যুক্তি প্রয়োগের জন্যে যে সব বিষয় তিনি বলবেন, সেগুলোর বর্ণনাভঙ্গী হবে আলাদা এবং অতি দ্রুত তিনি এ অংশ বলে যাবেন।
  • বক্তা মুখ খুলবার আগে মুখ্য আলোচ্য বিষয়কে বারবার মনের মধ্যে আউড়িয়ে নেবেন।
  • কোনো যুক্তি দাঁড় করার সময় বিশেষ অংশগুলোর মাঝে একটুকানি থেমে যাওয়া। যেন বুঝা যায় যে চিন্তাধারার একটা পুরা অংশ শেষ করা হয়েছে।
  • প্রধান প্রধান বিষয়গুলি ব্ল্যাকবোর্ডে লিখে দেয়া উচিত। সারা পিরিয়ড ধরে বহুবার আপনার মুখ দেখবার একঘেয়েমী থেকে কিছুটা তারা রেহাই পাবে।
খ. টিউটোরিয়াল পদ্ধতি :
  • ছোট ছোট দলে বিভক্ত হয়ে প্রশ্নোত্তরের মাধ্যমে শিক্ষাদানের ব্যবস্থা। সমালোচনামূলক পদ্ধতি এবং নির্দিষ্ট উদ্দেশ্য, এ দুয়ের সংমিশ্রনের মধ্যেই নিহিত রয়েছে- টিউটোরিয়াল পদ্ধতির প্রাণরস।
  • শিক্ষাদানের এটিই হচ্ছে সবচেয়ে পূর্ণাঙ্গ ও স্বার্থক পদ্ধতি অথচ এ পদ্ধতি সবচেয়ে কঠিন এবং এর প্রচলন সবচেয়ে কম। কারন এতে সময়, অর্থ ও পরিশ্রম ব্যয় হয় বেশী।
  • ছাত্রদের দুর্বলতা ধরা পড়ে যায় আর মধুর অথচ জোরালো চাপ দিয়ে সে দুর্বলতা সংশোধন করে নেন।
  • একজন উৎকৃষ্ট শিক্ষকের একটা বিশেষ বৈশিষ্ট যে, ছাত্রদের ভিন্ন ভিন্ন চরিত্রের সাথে তাঁরা নিজেদের খাপ খাইয়ে নিতে পারেন। শিক্ষকের স্বভাব হবে নমনীয় ও পরিবর্তনশীল।

একজন ছাত্র ৩টি কর্মধারা থেকে জ্ঞান লাভ করেন 

১. সৃষ্টি করার কাজ অর্থাৎ নিজের কাজ নিজে একা একা করা।
২. সমালোচনার কাজ অর্থাৎ যে সব ভুল সে ধরতে পারেনি সেগুলো বুঝতে পেরে এবং যে সব ক্ষেত্রে সে ভুল করেনি      অর্থাৎ সে সব বিষয়ে আত্মপক্ষ সমর্থন করতে গিয়ে জ্ঞান লাভ।
৩. সামগ্রিক ভাবে উপলব্ধি করা অর্থাৎ রচনাটি সংশোধিত হলে পরে তা দেখে এবং তার প্রথম শেখার সাথে তুলনা করা।শিক্ষকের এ ক্ষেত্রে প্রধান দায়িত্ব এ তিনটি কাজ যাতে আলাদা আলাদা না হয়ে পড়ে।

গ. ছাত্রদের সামগ্রিকভাবে শিক্ষাদান :
  • এ পদ্ধতির ভিত্তি হল একখানা বই। জ্ঞানের একটা নির্দিষ্ট এলাকাতেই এর কর্মক্ষেত্র সীমাবদ্ধ। ছাত্ররা পূর্ব থেকে ঠিক করে আসবে কোন কাজ শিখে আসবে। এরপর শিক্ষক বিস্তারিত ও বিশদভাবে বুঝিয়ে দিবেন এবং পরীক্ষা করে দেখবেন যে তারা সেটা বুঝেছে কি না।
  • খাতা বা উত্তর পত্রে নম্বর দেয়ার ক্ষেত্রে সবচেয়ে নিশ্চিত উপায় হল কয়েকজন পরীক্ষকের কমিটি গঠন করা। দুজন পরীক্ষক যদি আলাদা ভাবে উত্তরগুলো পড়েন এবং তার জানা থাকে যে অন্য পরীক্ষক এগুলো দেখবেন তাহলে যতদুর সম্ভব সঠিকভাবে নম্বর দিতে চেষ্টা করবেন। প্রথম দুজন দ্বিমত পোষন করলে তৃতীয়জন সমাধান করবেন।
  • পরীক্ষার খাতা একবার না পড়ে অন্তত দুবার পড়ে নম্বর দেয়া উচিত। দু বারের মধ্যে যেন একদিনের ব্যবধান থাকে।একটা একটা করে খাতা না দেখে প্রশ্ন অনুযায়ী সব খাতা এক সঙ্গে দেখা ।
  • শিক্ষাদানের ব্যবস্থা হলো অবিরাম পরিবর্তন ও উন্নতিসাধনের কাজ। ছাত্রদের ব্যক্তিগত ভুলত্রুটির দিকে বেশী দৃষ্টি না দিয়ে শেখাবার বিষয়ের দিকে বেশী গুরুত্ব দিতে হবে।
  • ক্লাসে এমন পরিবেশ সৃষ্টি করতে হবে যাতে প্রশ্নগুলো বুঝে নেয়ার জন্যে তাদের মন সাগ্রহে এগিয়ে আসে। প্রতিযোগিতার ব্যবহার করতে হবে পরিমিত মাত্রায় এবং যোগ্যতার প্রতি সুক্ষ দৃষ্টি রাখতে হবে যাতে এর ভিতর দিয়ে ছাত্রদের সদগুণগুলো প্রকাশ পায়।
  • সবচেয়ে কার্যকরী শাস্তি হল যে, ভুল কাজটি আবার ভালোভাবে করিয়ে নেয়া। যেমন কেউ একটা অংক শুদ্ধ না করা পর্যন্ত তাকে চেষ্টা করেই যেতে হবে।

৩। মনে দাগ কেটে দেয়া :
  • ছাত্রদের যে টুকু জ্ঞান লাভ করা দরকার শুধু তা তার কাছে পৌছে দিলেই শিক্ষকের কাজ শেষ হয়ে যায় না। তাদের মন তো পাথরের মত নয় যে, তার উপর খোদাই করা যাবে না। তাদের মনতো মোমের মত। তাকে গড়ে তুলতে হবে ইচ্ছানুরূপভাবে তারপর তাকে শক্ত করে নিতে হবে।
  • পড়ানোর বিষয়টা কয়েকবার আলোচনা করলে ছাত্ররা বিষয়টির সঙ্গে বেশ ভালোভাবে পরিচিত হয়ে উঠবে।
  • এরপর তাদের কাছ থেকে প্রশ্ন আহবান করতে হবে এবং এর উত্তর প্রদান করা।
  • বিবেক সম্পন্ন শিক্ষকের অন্যতম সংশয় হলো যে, সব সময় তার মনে হবে যেন তার কর্তব্য যথেষ্টভাবে সম্পাদন করে উঠতে পারছেন না।

অপরের কাছে শিক্ষা পৌছে দেয়ার ব্যাপারে যীশু চারটি পদ্ধতির সাহায্য নিয়েছেন 

১. বক্তৃতা।
২. একটি জ্ঞানগর্ভ বাণী উচ্চারণ করার পর নীরবতা পালন।
৩. শেখাবার কাজে হাজারটি মুখের কথার চেয়ে একটি মাত্র ছবি বেশী কার্যকরী হয়, আর কোনো একটা কাজ নিজের হাতে করে নিয়ে অথবা অপর কাউকে করতে দেখে মানুষ অতি অল্প সময়ে এবং অতি সহজে শিখে নিতে পারে। অনেক সময় যীশু গল্প বলে শিক্ষাদান করতেন।
৪. চতুর্থ পদ্ধতি হলো প্রচার।

রেঁনেসা যুগের শিক্ষাদান পদ্ধতি 

  • শিক্ষাদান শুরু হত খুব অল্প বয়সে।
  • শিখবার বিষয়গুলোর সংখ্যা ছিল খুব কম এবং তাতে ছাত্রদের প্রাণশক্তি ছড়িয়ে যেতে পারতো না।
  • রেঁনেসা যুগের স্কুলে কোন শিক্ষক যদি ফরাসী ভাষা শিখাতেন তাহলে তিনি পৃথকভাবে না পড়িয়ে ফরাসী আচার ব্যবহার রীতি-নীতি, ইতিহাস, ভূগোল, সাহিত্য ইত্যাদি নিয়েই পড়াতেন। কোন শিক্ষক যদি শুধু ফরাসী শিক্ষাদানে দক্ষ হন তাহলে তিনি শিক্ষক হওয়ার উপযুক্ত নন।
  • ভালো শিক্ষক কদাচিৎ জোর-জবরদস্তী করতেন অর্থাৎ ছাত্রদের বেত মারতেন।
  • শেষ কথা, রেনেসা যুগের শ্রেষ্ঠ শিক্ষকগণ তাঁদের ছাত্রদের মেরে শাসন না করে খেলার ছলে তাদের মনে প্রেরণা যোগাতেন।

উনবিংশ ও বিংশ শতাব্দীর প্রথমভাগের শিক্ষকদের মধ্যে পাঁচটি বা ছয়টি বৈশিষ্ট্য দেখতে পাওয়া যায় 

  • তাঁরা ছিলেন তীক্ষ্ণ সমালোচক।
  • অন্তকরণের প্রশস্থতা বা আবিস্কারক ছিলেন
  • অন্তর্নিহিত শক্তি যে শক্তি ছিলো দৈহিক ও মানষিক।
  • বন্ধুভাবাপন্ন এবং শক্তির আধার, তেমনি তাদের মন এত প্রশস্ত ছিল যে তাঁরা বহু বিভিন্নমুখী বিষয়কে গ্রহণ করে নিজেদের জীবন যাত্রায় প্রয়োগ করতেন।
  • যুক্তি-শ্রেষ্ঠ ও কার্যকরী বক্তৃতা হলে বক্তা তার ছাত্রদের মনে অনাবিল, নিরবচ্ছিন্ন ও সম্পূর্ণ নিখুঁত চিন্তাধারার সৃষ্টি করতে পারে।
  • বাগ্মীতা- একজন ভাল বাগ্মী তার আকর্ষণীয় কথনভঙ্গী মনে রাখার উপযোগী সুন্দর সুন্দর সংক্ষীপ্ত বাক্য, সুন্দর উপমা এবং সর্বোপরি শ্রোতাদের সঙ্গে একটা ব্যক্তিগত সম্পর্ক গড়ে তুলেন।

আলবার্ট আইনস্টাইন বলেন- জ্ঞান দু ভাবে আহরণ করা যায়-
১. পড়াশোনা এবং গবেষণা।
২. কল্পনা এবং ধ্যান।

ইসলামী ভাবধারার বৈশিষ্ট্য 

  • হযরত মুহম্মদ সা. এর শিক্ষার সর্বপ্রধান বৈশিষ্ট্য ছিল যে, তিনি নিজে যা শিখাতেন ও আচরণ করতেন শুধু তাই অপরকে শিক্ষা দিতেন ( যেমন মধু খাওয়ার ঘটনা )।
  • রসুল সা. এর নিকট যখন ওহি নাযিল হতো তিনি সাহাবীদের কাছে ধীরে ধীরে সুস্পষ্ট করে তা তিনবার আবৃত্তি করতেন। যাতে তারা মুখস্ত করতে ও লিখতে পারে।
  • স্বীয়পুত্রকে উদ্দেশ্য করে হযরত আলী রা. বলেন- যখন যে দেশে থাকো সে দেশের রীতি-নীতি অনুসরণ করো।
  • শিক্ষা প্রসারে হযরত মুহাম্মদ সা. যুদ্ধবন্দীদেরকেও কাজে লাগিয়ে ছিলেন। দশজন বালক বা বালিকাকে লেখাপড়া শেখালে একজন বন্দী মুক্তি পাবে।
  • কোন দেশ জয় করা হলে প্রথমেই তিনি সেখানে শিক্ষক পাঠাতেন।

পরিশেষে বলা যায় শিক্ষণ কলার কলাকৌশল সম্পর্কে যে সকল পদ্ধতির কথা জানলাম তা যথাযথ অনুসরনের মাধ্যমে একদিকে যেমন ভাল শিক্ষক হওয়া সম্ভব তেমনি অন্যদিকে দেশ ও জাতি গঠনে সহায়ক ভূমিকা পালন করবে বলে আশা করি।


এই পোস্টটি পরিচিতদের সাথে শেয়ার করুন

পূর্বের পোস্ট দেখুন পরবর্তী পোস্ট দেখুন
এই পোস্টে এখনো কেউ মন্তব্য করে নি
মন্তব্য করতে এখানে ক্লিক করুন

অর্ডিনারি আইটির নীতিমালা মেনে কমেন্ট করুন। প্রতিটি কমেন্ট রিভিউ করা হয়।

comment url